উপমহাদেশে ইসলামী শাসনের অবসানের পর থেকেই ইসলামপন্থীদের রাজনৈতিক সচেতনতা নিম্নগামী- এবাস্তবতা হকপন্থী ও বিচক্ষণ উলামা-চিন্তাবিদগণ চিহ্নিত করেছেন। ঠিক একইভাবে এই দুর্বলতাকে চিনতে পেরেছে সুবিধাবাদী পপুলিস্ট-সেক্যুলার রাজনীতিবিদ ও এক্টিভিস্টরাও। ১৭৭৬ ও ১৭৮৯ সালে যথাক্রমে আমেরিকান বিপ্লব ও ফ্রেন্ঞ্চ বিপ্লবের পর মূলত লিবারেল রাজনীতির দুই ধারা সামনে চলে আসে- ক) ক্ল্যাসিকাল লিবারেল ধারা বা ডানপন্থা, ও খ) প্রগ্রেসিভ লিবারেল ধারা বা বামপন্থা। সাধারণত, পপুলিস্ট বলতে ক্ল্যাসিকাল লিবারেল বা ডানপন্থীদেরই বোঝানো হয়।
বিংশ শতকে উত্তর-উপনিবেশ কালে শীতল যুদ্ধ চলাকালীন, বামপন্থার উগ্র উত্থান ঘটে। পূর্ব-পশ্চিমের প্রায় সব দেশেই প্রগ্রেসিভ লিবারেল বা বামপন্থীদের ব্যাপক প্রভাব বাড়ে, যারা ক্ল্যাসিকাল লিবারেল বা ডানপন্থীদের মত কেবল শাসনব্যবস্থা থেকে নয় সমাজ, পরিবার ও ব্যাক্তি পর্যায়েও ট্র্যাডিশনাল মূল্যবোধ ও ধর্মের উৎখাতে নেমে পরে।
বরাবরের ন্যায় অতি ক্ষুদ্র মুওয়াহহিদিনদের অংশটি ব্যাতীত উম্মাহর প্রথাগত রাজনৈতিক অংশটি উগ্র বামপন্থার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায়, বিশুদ্ধ ইসলামী আকিদা ও মানহাজের স্থলে ডানপন্থী, পপুলিস্ট সেক্যুলারদের সাথে গাটছড়া বাঁধেন এবং প্রায় অন্ধ তাকলিদের পথ বেছে নেন। যার ফলশ্রুতিতেই ইলেকশন, পার্লামেন্ট, ছঁকবাধা বৈচিত্র্যহীন কর্মসূচী এবং সেক্যুলার রাজনৈতিক ন্যারেটিভে আটকা পরে যান।
এই যখন ইসলামী রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্টদের অবস্থা তখন সামগ্রিক অবস্থা হলো- অতিসরলতা, উদাসীনতা ও অন্যান্য আরো অনিবার্য জটিলতার প্রভাবে, তাদের কাছে কেবল "ইসলামী শা'আয়ের আর পরিভাষার সাথে জড়িত বিষয়"গুলোই প্রাসঙ্গিক মনে করে। অর্থাৎ, দাড়ি, টুপি, কুরআন, সংবিধানে বিসমিল্লাহ-এর মতো ইস্যুতেই ইসলামপন্থীদের অবস্থান জানা যায়। এ বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা অপরিহার্য ও অগ্রাধিকারপ্রাপ্য সন্দেহ নেই। কিন্তু, রাজনৈতিক ইতিহাসের জবরদস্তিমূলক অপব্যাখ্যা, অর্থনৈতিক বৈষম্য, সাধারণ মানুষের উপর নিপীড়ন, শত্রুরাষ্ট্রের (যেমন, ভারত, আমেরিকা) সাথে দীর্ঘমেয়াদী আত্মঘাতি চুক্তিসহ বিভিন্ন জাতীয়, আন্তর্জাতিক ইস্যুতে ইসলামপন্থীদের নিরবতা কাম্য না। কারণ, মানুষের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও জাতীয় সমস্যার সমাধানও ইসলামী বিষয়। তা না হলে শরিয়াহর শাসন বা আল ওয়ালা ওয়াল বা'রার মতো বিষয়গুলো দ্বীন ইসলামে এতো গুরুত্বপূর্ণ কেন?
প্রাত্যাহিক ও জাতীয় জীবনের ঘটনাবলী মানুষ ও জাতিকে সরাসরি প্রভাবিত করে। সরকারী ও পোষা মিডিয়ার গৎবাঁধা বক্তব্যের বাইরে গিয়ে, মানুষ সঠিক বাস্তবতা ও বিশ্লেষণ জানতে চায়, বুঝতে চায়। শূণ্যস্থান পূরণে তাই সাধারণ মুসলিমদের আশ্রয়স্থলে পরিণত হয় বিভিন্ন পপুলিস্ট এক্টিভিস্ট; যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ জণগণের আবেগ ও উত্তেজনাকে কেন্দ্র করে ইতিহাস ও রাজনীতির প্রয়োজনীয় বিশ্লেষণ ও ধারাবিবরণী সাজিয়ে উপস্থাপন করেন। তাই দেখা যায়, অনেক চিহ্নিত সেক্যুলাররাও নিপীড়িত সাধারণ মুসলিম জনতার অন্যতম ‘আশ্রয়’ হয়ে ওঠে!
পপুলিস্ট ডানপন্থীদের চিন্তাধারা হলো, সংখ্যাগরিষ্ঠের আবেগ-অনুভূতির বিরোধিতা না করে, তাদের সমর্থন আদায়কে সামনে রেখে রাজনীতি ও এক্টিভিজম করা। যেখানে মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ সেখানে পপুলিস্টরা মুসলিমদের স্বার্থ-চাহিদাকে প্রাধাণ্য দেয়, যেখানে হিন্দু বা খ্রিস্টানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ সেখানে প্রাধান্য দেয় হিন্দু বা খ্রিস্টানদের। সাধারণভাবে বললে যাদেরকে ডানপন্থী হিসেব আমরা জানি, তারাই মূলত পপুলিস্ট হিসেবে পরিচিত হয়ে থাকে। যেমন, ব্রিটেনের টোরি পার্টি, আমেরিকার রিপাবলিকান পার্টি, ভারতের বিজেপি ইত্যাদি পপুলিস্ট ডানপন্থী সেক্যুলার ধারার রাজনৈতিক দল।
আমাদের দেশে বিএনপি, জাতীয় পার্টি, গণঅধিকার পরিষদ, এধরণের এক্টিভিজম ও রাজনীতিতেই লিপ্ত। স্রোতের বিপরীতে গিয়ে তারা শাসকগোষ্ঠীর বিরোধিতা করছেন; এটা প্রশংসনীয়, সন্দেহ নেই। কিন্তু, মনে রাখা প্রয়োজন, কোনো সুনির্দিষ্ট শাসক দলের পতন ইসলামপন্থীদের মূল লক্ষ্য না; ইসলামের মূল উদ্দেশ্য সেক্যুলার শাসনব্যবস্থার ক্ষয়করণ ও প্রতিস্থাপন। কিংবা অন্তত, আপামর জনসাধারণের কাছে ব্রিটিশ শাসনের ফসল হিসেবে পাওয়া, এই বিষাক্ত চিন্তাধারার অসারতা স্পষ্ট করা।
পপুলিস্ট ধারার বুদ্ধিজীবি, রাজনীতিবিদ ও এক্টিভিস্টরা জানেন-
ক) ইসলামপন্থীদের ব্যাপক সমর্থন ছাড়া- গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় হোক, সামরিক প্রক্রিয়ায় হোক অথবা জনআন্দোলনের আকারে হোক; ক্ষমতার পরিবর্তন ও সুসংহতকরণ সম্ভব না।
খ) ক্ষমতার কাঠামোর পুনর্বিন্যাস যে প্রক্রিয়াতেই (গণতান্ত্রিক, সামরিক বা গণআন্দোলন) হোক না কেন; অসংগঠিত, অসচেতন, মধ্যবিত্ত মানসিকতায় আচ্ছন্ন ও বাগাড়ম্বরে অভ্যস্ত নের্তৃত্বের অনুগত ইসলামপন্থীদের পক্ষে শুধু ক্ষমতার পরিবর্তনে নিয়ামক ভূমিকা রাখা সম্ভব। ক্ষমতার কেন্দ্রে যাওয়ার মতো সক্ষমতা তারা রাখে না। ফলে ক্ষমতার পরিবর্তনের চূড়ান্ত ফলাফল যাবে বিএনপি, সামরিক বাহিনী, ভিপি নূর দের মতো কোনো পশ্চিমাপন্থী, পপুলিস্ট সেক্যুলার গ্রুপের পক্ষেই।
হ্যা, এনাম অথবা কৌশল হিসেবে আপসকামী ইসলামপন্থীদের কাউকে কাউকে শিল্প, কৃষি, সমাজকল্যাণ বা ধর্ম মন্ত্রণালয়ের আলংকরিক পদ হয়তো দেয়া হবে; যেমনটা আগেও হয়েছে। কিন্তু সাধারণত উক্ত মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী বা উপমন্ত্রীর তেমন কিছু করার সক্ষমতা থাকবে না, তাদের কাজ চালিত হবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় নিয়োজিত কোনো প্রভাবশালী সেক্যুলার সচিবের প্রভাবে।
কথাগুলো জটিল মনে হলেও; সংক্ষেপে সম্ভাব্য সংকটের বাস্তব চিত্র এমনটাই।
এ দুটি মৌলিক বাস্তবতা জানেন বলেই, পপুলিস্ট সেক্যুলার বুদ্ধিজীবি, এক্টিভিস্ট ও রাজনীতিবিদরা ইসলামপন্থীদের আবেগ, অনুভূতি ও আকাঙ্ক্ষাকে এত বেশী গুরুত্ব দেন। হতে পারে, নিজ ইচ্ছা বা আদর্শের প্রতি আন্তরিক হয়েই তারা তা করেন; তবে তারা যে সেক্যুলার ফ্রেমওয়ার্কের বাইরে গিয়ে কিছু ভাবেন কিংবা ইসলামী শাসনব্যবস্থার আশা বা কল্পনা করেন, এমনটা আমরা কখনো দেখিনি, দেখিনা।
অতএব, ইসলামপন্থীদের জন্য উচিৎ হবে না,
ক) প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষণ বা ইতিহাসের সঠিক বয়ান জানতে গিয়ে, সেক্যুলারদের আদর্শিক গোলামে পরিণত হওয়া।
খ) হিন্দুত্ববাদ ও উগ্র সেক্যুলারিজমের বিরোধিতা করতে গিয়ে, ইসলামপন্থা বাদ দিয়ে নিজের অজান্তেই পপুলিজমের মোড়কে আবৃত সেক্যুলারিজমকে আঁকড়ে ধরা বা শক্তিশালী করা।
এছাড়াও, ইসলামপন্থীদের মধ্যে অগ্রগামী ও আন্তরিক ভাইদের কর্তব্য হল, প্রয়োজনীয় ও প্রাসঙ্গিক জাতীয়-আন্তর্জাতিক ইতিহাস ও ঘটনাপ্রবাহের বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ জাতির সামনে সামর্থ্য অনুযায়ী তুলে আনা; অন্যথায়, '৪০ ও '৮০র দশকের মতো আবারও একটি সম্ভাবনাময় ইসলামী প্রজন্মের অপমৃত্যু ঘটবে।
উল্লেখ্য, ডানপন্থীদের সবাইই ক্ষমতালোভী, বিষয়টি এমন নয়। বিশেষ ব্যাতিক্রম থাকতেই পারে, এমনকি কখনো ইসলামী শাসন কায়েম হলে তাদের অনেককেই সহযোগী হিসেবেও পাওয়া যাবে হয়তো। তবে সাধারণ অবস্থা তা ই, যা বলা হলো
যেভাবে পপুলিজমের প্রতারণার শিকার হয়ে সে সময়কার ইসলামপন্থীদের উন্মেষ ছিনতাই হয়েছিল জিন্নাহ-জিয়া-এরশাদের মতো অপরচুনিস্ট, লিবারেল ক্ষমতালোভীদের হাতে; যেভাবে তাদের হাতের পুতুলে পরিণত হয়েছিল প্রবঞ্চিত বা প্রলুব্ধ 'ইসলামী' নের্তৃবৃন্দ্ব- ঠিক একই ঘটনা আবারো মঞ্চস্থ হতে পারে- যদি না ইসলামপন্থীরা যুগের দাবী মেটাতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে সক্ষম হয়।
সুবিধাবাদঃ 'ইসলামপন্থায় সওয়ার হয়ে সেক্যুলার শাসন'!
পপুলিস্ট, ডানপন্থী সেক্যুলারদের চিন্তাধারা হচ্ছে, জাতির সংখ্যাগরিষ্ঠের (বাংলাদেশের ক্ষেত্রে, সরলমনা মুসলিমদের) আবেগ-অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে, তাদের সমর্থন আদায়কে সামনে রেখে রাজনীতি চর্চা ও অনলাইন ও অফলাইনের এক্টিভিজম।
রাস্ট্র, মিডিয়া ও শিক্ষাব্যবস্থার বৈরী আচরণের ফলে, ইসলামপন্থীদের মাঝে রাজনীতি ও ইতিহাসের সঠিক বক্তব্যের ও প্ল্যাটফর্মের সংকট রয়েছে। ফলে জনমানুষের মাঝে ইতিহাস, রাজনীতি সম্পর্কে জানার আগ্রহের শূন্যতা পূরণে কেন্দ্রীয় ভূমিকা রাখছে পপুলিস্ট সেক্যুলার রাজনীতিবিদ ও এক্টিভিস্টরা। মানুষ সমস্যার সমাধান না পেলেও, সমস্যা নিয়ে আলোচনা শুনতে, করতে এবং পরিশেষে সমস্যা চিহ্নিতকারীর প্রস্তাবনা দ্বারা প্রভাবিত হতে ভালোবাসে। বঞ্চিত, নিপীড়িত মুসলিম সমাজের আবেগকে সহজেই অবচেতনভাবে তাড়িত ও নিয়ন্ত্রিত করতে, পপুলিস্ট রাজনীতিবিদ ও এক্টিভিস্টরা তাই শাসক শ্রেণীর অন্যায়-অত্যাচারকে ক্রমাগত সামনে আনতে থাকে।
"Populism ask the right set of questions but does not provide a ready made set o answers."
- Christopher Lash; The True and Only Heaven.
সোজা কথায়, পপুলিজম সঠিক প্রশ্নগুলো উত্থাপন করে, কিন্তু সুনির্দিষ্ট কোনো উত্তর পেশ করে না।
এই কায়দা ব্যাবহার করে ইসলামপন্থী ও সরলমনা মুসলিমদের উপর ক্রমান্বয়ে রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তার করছে ফরহাদ মজহার, পিনাকী ভট্টাচার্য, ভিপি নুরু, ডক্টর জাফরুল্লাহ ও বিএনপিপন্থীদের মত পপুলিস্ট সেক্যুলাররা।
শাসকশ্রেণীর অন্যায়ের সমালোচনা জরুরী ও কাম্য, এ নিয়ে ভুল বোঝাবুঝির সুযোগ নেই। কিন্তু আপত্তি হল ন্যায়সংগত কথার অসংগত উদ্দেশ্য নিয়ে। সেক্যুলার পপুলিস্টরা বিদ্যমান সমস্যাবলীর নানামুখী আলোচনার করলেও সমাধান বা বিকল্পের ক্ষেত্রে ভাসা ভাসা বক্তব্য উপস্থাপন করে। ঠিক কিভাবে স্বৈরশাসনের পতনের পর অবস্থার উন্নতি ঘটবে, তা তাদের বক্তব্যে অনুপস্থিত। পপুলিস্ট এক্টিভিস্টদের মূল উদ্দেশ্য হল, আপামর মুসলিম জনতাকে শাসকদের অত্যাচারের বয়ানের সাহায্যে প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রণ করে নিজ রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন করা।
জনসাধারণকে প্রলুব্ধ করতে তাদের নিয়মিত হাতিয়ার হয়ে থাকে:- ডিসইনফরমেশন ও মিসইনফরমেশন। এসকল এক্টিভিস্ট, রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবিদের মেহনতের ফলাফল শেষ অবধি এই দাঁড়ায় যে, জনসাধারণ ফিরআউনের কবল থেকে নমরূদের খপ্পরে গিয়ে পড়ে।
এ ধরনের পরিবর্তনের দুটি ধারা আছে।
ক. গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সুযোগসন্ধানী পপুলিস্ট সেক্যুলাররা কথা ও লেখার জাদুতে মোহগ্রস্ত করে গণহারে সাধারণ, অচেতন মুসলিমদের ভোট বাগিয়ে নেয়। এটা মোটামুটি স্পস্ট তাই এনিয়ে অধিক আলোচনার প্রয়োজন নেই।
খ. চেপে বসা সামরিক শাসন বা স্বৈরশাসনের ফলে, ক্ষমতায় আরোহণে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সফল হবার কোন সম্ভাবনা যদি না থাকে- সেক্ষেত্রে জনসাধারণের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করে সেক্যুলাররা বেছে নেয় গণআন্দোলন আর অভ্যুত্থানের পথ। যেমন, '৬৯ এ আইউববিরোধী অভ্যুত্থান, ৭৫ এ খালেদ মোশাররফের বিরুদ্ধে পরিচালিত অভ্যুত্থান কিংবা ৯০ এর এরশাদবিরোধী গণআন্দোলন।
এভাবেই ইতিপূর্বে, হয় ভোটের মাধ্যমে, অথবা অভ্যুত্থান-বিপ্লবের মাধ্যমে, জিন্নাহ, ভুট্টো, জিয়া বা এরশাদসহ অন্যান্য ডানপন্থীরা মুসলিম জনতার আবেগকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের সেক্যুলার শাসনের বৈধতা ও গ্রহণযোগ্যতা আদায় করে নিয়েছিল।
উল্লেখ্য, জনসমর্থন আদায়ের মাধ্যমে ভোট আদায়ের সমীকরণ সহজে বোধহম্য হলেও, অভ্যুত্থান ও বিপ্লবের ক্ষেত্রে জনসাধারণকে কাজে লাগিয়ে কিভাবে সেক্যুলাররা ক্ষমতায় আসে, তা অনেকের কাছেই পরিস্কার না। কিন্তু এবিষয়টি জানা ও বোঝা, সাধারণ মুসলিম ও আন্তরিক ইসলামপন্থীদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সাধারণত সেক্যুলারদের তত্ত্বগুলো খুব একটা সরল না, আবার বাংগালী মুসলিম মানস দীর্ঘ ও জটিল পাঠে সাবলীল না। যার ফলে পপুলিস্ট গণতান্ত্রিকর কেন ইসলামপন্থীদের উপর রাজনৈতিক আধিপত্য চায় এটা মোটা দাগে বোঝা গেলেও; বিপ্লব বা অভ্যুত্থানের থিওরিতে বিশ্বাসী সেক্যুলারদের, বিশেষত কমিউনিস্টদের তত্ত্ব বোঝাটা তুলনামূলকভাবে কিছুটা জটিল। আপাতত আমি এমন দুটি বক্তব্য তুলে ধরছি, যা থেকে আশা করা যায় সাধারণ ধারণা পাওয়া সম্ভব হবেঃ-
১) বাংলাদেশে ৭ই নভেম্বরের বিপ্লবের রূপকার, জাসদের মাস্টারমাইন্ড, কট্টর বাম-তাত্ত্বিক সিরাজুল আলম খান বলেন,
"বাট থিয়োরি স্ট্যান্ডস। ইভেন রিলিজিয়নকে নালিফাই (নাকচ) করে তুমি। সোশ্যালিস্ট টেকওভারে যেতে পারবে না। মানুষের মধ্যে যেটা আছে এবং থাকবে, সেটাকে তুমি তো ইগনোর করতে পারো না।
যেটা হওয়া উচিত না, সেটা হয়ে গেছে। সেটাকে তুমি অস্বীকার করতে পারো না।"
('প্রতিনায়কঃ সিরাজুল আলম খান', পৃঃ ৪২৩)
অর্থাৎ, ইসলামপন্থার প্রভাব যেহেতু সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে, তাই একে উপেক্ষা করে বিপ্লব (সোশালিস্ট টেকওভার) সম্ভব না। তাই তাদেরকে সাথে না রাখার সুযোগ নেই।
২) ফরহাদ মজহারের বক্তব্য দেখুনঃ-
(বন্ধনী আবৃত বক্তব্য অত্র প্রবন্ধের লেখকের)
"...এই মৈত্রীটাকে আমাদের গড়ে তুলতে হবে। এই মৈত্রীর সাথে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ যাদেরকে আমরা ইসলামপন্থী বলে বিদ্বেষী হয়ে যাই, মৌলবাদ বলে যাদেরকে আমাদের থেকে দূরে সরিয়ে দেই, তাদের সাথে আমাদের মৈত্রীর প্রয়োজন আছে।
কারণ তারাও দেখা যাচ্ছে এই পরিবর্তনটা চায়।
... তারই আরেক ভাই মাদ্রাসায় যাইতেসে, কওমি করুক কি আলিয়া করুক। তার সাথে তুমি মৈত্রী চাবে না কেন?
...৩য় শিক্ষাটা আমরা যেখান থেকে নিবো সেটা হচ্ছে কী করে একটা দলকে দিয়ে জনগণকে উদ্ভুদ্ধ করা এবং সমস্ত কিছু দলের অধীনেই (অর্থাৎ সেক্যুলারদের রাজনৈতিক দল) করতে হবে, দলের লোককে দিয়ে করতে হবে তা না। (অর্থাৎ, দলের বাইরের লোক দিয়েও করতে হবে)
...এবং তাদের কমিটির পরিচালনার অভিমুখটা ঠিক করে দেয়া তাদের আন্দোলনের।
...এবং সহায়তা করা যাতে আগামীতে আমরা একটা গণঅভ্যুত্থান করতে পারি। (অর্থাৎ, বিপ্লব কিভাবে হবে তার অভিমুখ ও ফলাফল নির্ধারণ করবে সেক্যুলারদের দল)
দ্বিতীয়ত, গণঅভ্যুত্থানের পরে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দাড়া করতে পারি। আপনি তার নাম তত্ত্বাবধায়ক সরকার দিতে পারেন। অসুবিধা নাই।"
(মূল আলোচনাঃ ফরহাদ মজহার ।। ফিরে দেখা সোভিয়েত ইউনিয়ন || বোধিচিত্ত - Youtube)
বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতা হল, আওয়ামী শাসন দীর্ঘায়িত হওয়ায় স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতার পালাবদল সূদুরপরাহত হওয়ায়, এদেশের পপুলিস্ট সেক্যুলারদের শেষ আশ্রয় হচ্ছে সেনা অভ্যুত্থান কিংবা গণবিপ্লব। তবে পপুলিস্ট সেক্যুলাররা সাধারণত সেনাবাহিনীর একচেটিয়া শাসন চায় না। আর জনসমর্থনহীন সেনাশাসন শেষ অবধি ব্যার্থ হয়- এই বিবেচনায় তাদের রাজনৈতিক লাইন হয়ে দাঁড়ায়-
সুনির্দিষ্ট সেক্যুলার গোষ্ঠীর রাজনৈতিক নের্তৃত্বের অধীনে ইসলামপন্থীদের ব্যাপক স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন ও গণআন্দোলন।
কারণ,
ক) যদি সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপের আশায় থাকতে হয়, সেক্ষেত্রেও এধরণের পদক্ষেপের উপযোগী পরিস্থিতি (যেমন, জনগণের রাজপথে স্বতঃস্ফূর্ত অবস্থান বা প্রশাসনিক কাঠামো দুর্বল করে দেয়া ইত্যাদি) প্রয়োজন। আর বিএনপি-জামাতের কোমর ভেঙে যাওয়ায়, জনমনে ভারতবিদ্বেষি মনোভাব সৃষ্টি এবং ইসলামপন্থার ব্যাপকতা লাভ করায়- গণ-আন্দোলনে ইসলামপন্থীরাই একমাত্র আশ্রয়।
খ) আর যদি গণবিপ্লব ঘটাতে হয় তবে গত শতাব্দীর রাশিয়া, ইরান বা চীনের মতো, তবে কৃষক বা শ্রমিক আন্দোলনের মাধ্যমে আজকের বাংলাদেশে তা করা সম্ভব না। এক্ষেত্রে, দৃশ্যমান বিকল্প হল ইসলামপন্থীদের কাজে লাগিয়ে শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন এবং অতঃপর অন্তর্বতীকালীন সরকার গঠন।
যদি এতে সফলতা আসে, তাহলে আন্দোলনের রাজনৈতিক নেতৃত্বে যেহেতু আগে থেকেই সেক্যুলারদের হাতে ছিল, তাই নতুন শাসনকাঠামোতে নামেমাত্র অংশগ্রহণ ছাড়া ইসলামপন্থীদের আর কোনো প্রভাব থাকবে না।
ফলাফল হবে, এক সেক্যুলারের বদলে আরেক সেক্যুলারের ক্ষমতায়ন!
এই হল, পপুলিস্ট সেক্যুলারদের বিষাক্ত উদ্দেশ্য।
কট্টর সেক্যুলাররা যদি ইসলামপন্থীদের বুকে গুলি চালিয়ে, বন্দী করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চায়, তাহলে ছদ্মবেশী পপুলিস্ট সেক্যুলাররা চায় ইসলামপন্থীদের ধোঁকায় ফেলে, বন্দুকের নলের মুখোমুখি করে, রাস্তার লাশে পরিণত করে ক্ষমতা অর্জন করতে। কাজেই সুবিধাবাদী সেক্যুলারদের রাজনৈতিক প্রতারণার শিকার হয়ে নিজ জীবন, যৌবন, সম্পদ বিলিয়ে দেয়ার মতো মারাত্মক নির্বুদ্ধিতার কোনো ধরণের বৈধতা নেই।
'৪০ আর '৮০'র দশকের মতো আবারো সেক্যুলারদের আহবানে সাড়া দিয়ে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ব্যার্থতার ঘানি টেনে বেড়াতে না চাইলে, অবশ্যই ইসলামপন্থীদের সচেতন হওয়া কাম্য। পাশাপাশি, সেক্যুলারদের (ডানপন্থী/বামপন্থী) কোনো ধরণের রাজনৈতিক কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত হওয়া থেকে বিরত থাকা ও অন্যকে বিরত রাখা জরুরী।
নিঃসন্দেহে কেবলমাত্র আদর্শের ক্ষেত্রে আপসহীন এবং বিশুদ্ধ মানহাজের অনুসারী ইসলামপন্থী নের্তৃত্বের অধীনে পরিচালিত আন্দোলন ও অভ্যুত্থানের ফলাফলই ইসলামের পক্ষে যাবে। ভিন্ন কিছু নয়।
মূলধারা: ইসলামপন্থী না পপুলিস্ট!?
সেক্যুলার চিন্তাধারা ও কাঠামোর সাথে সংঘর্ষে না জড়িয়ে, যথাসম্ভব 'সম্প্রীতি' বা সম্পর্কে ধরে রেখে ইসলামের খেদমতের দাবীদারকে আমরা "মূলধারা"র ইসলামপন্থী হিসেবে চিহ্নিত হতে দেখি।
পশ্চিমে এরা আধুনিক মুসলিম, রিফরমিস্ট/সংস্কারবাদী মুসলিম, মডারেট মুসলিম, সিভিল ডেমোক্রেটিক মুসলিম, লিবারেল মুসলিম ইত্যাদি নামে পরিচিত হলেও- আমাদের এখানে এশ্রেণীটি নিজেদের "মূলধারা" নামে অভিহিত করতে চায়। মূলত ইখওয়ানি ঘরানা থেকেই এদের উদ্ভব ঘটে থাকে। তবে পরবর্তীতে, দেওবন্দি-কওমি মাসলাকের সাথে নিজেদের সম্পৃক্ত করা অনেকেও স্রোতে গা ভাসিয়ে ‘মূলধারা’য় প্রবেশ করেছেন।
তাদের একাংশ মুভ ফাউন্ডেশনের অধীনে আয়োজিত কর্মশালায় অংশ নিয়ে এঘরানা চরম আলোচিত-সমালোচিত হয়েছিল। মূলধারার ব্যাপারে এঘরানার জনৈক এক্টিভিস্ট উনার লেখায় মূলধারার 'ইসলামপন্থী'দের ব্যাপারে মন্তব্য করেছেন-
"সমালোচনা না থাকলে তাদের দ্বিতীয়-তৃতীয় প্রজন্ম ধার্মিকতা ধরে রাখতে পারবে না। যেমন আবুল হাশিম-আবুল মনসুরের ছেলেরাও বখে গেছে, পরিণত হয়েছে সেকুলারিজমের প্রধান প্রবক্তায়।
ফ্যাসিবাদী সেকুলারিজম আপনাকে পিটাবে, বহুত্ববাদী সেকুলারিজম চোখ আরও দূরে। সে আপনাকে অধিকার দানের বিনিময়ে দ্বিতীয়-তৃতীয় প্রজন্মকে হাতিয়ে নিবে, তাদের টার্গেট বদরুদ্দিন ওমর ও মাহফুজ আনাম উৎপাদন।"
এথেকে যে সকল অনুসিদ্ধান্ত পাওয়া যায়ঃ-
১) মূলধারার উপস্থিত প্রতিভূরা এখনো সেক্যুলার হয়নি। তবে এভাবে চললে তাদের পরের প্রজন্ম সেক্যুলার হয়ে যেতে পারে।
২) মূলধারার প্রবক্তাগণের দৃস্টান্ত হচ্ছে আবুল মনসুর আহমদ ও আবুল হাশিম।
৩) আবুল মনসুর আহমদ ও আবুল হাশিম ধার্মিকতা কিছু ধরে রাখলেও অর্থাৎ সেক্যুলার না হলেও, তাদের পরের প্রজন্ম তথা মাহফুজ আনাম ও বদরুদ্দিন উমররা সেক্যুলারিজমের ধ্বজাধারীতে পরিণত হয়েছে।
বোঝা যাচ্ছে, আবুল হাশিম ও আবুল মনসুর আহমদের পরিচয় জানা গেলেই মূলধারার পরিচয় জানা যাবে, যেহেতু এরাই মূলধারার প্রবক্তা-অনুসারীদের পূর্বসূরী। আলহামদুলিল্লাহ, মূলধারার চিন্তাধারা ও কর্মসূচীর সংজ্ঞায়ন ও বাস্তবতা উপলব্ধির ক্ষেত্রে একটা উপসংহারে পৌঁছানোর জন্য এটি সহায়ক হবে আশা করি।
তাহলে আসুন এ দুজনের পরিচয় জানা যাক।
ক) আবুল হাশিম ও আবুল মনসুর আহমদ, দুজনেই ছিল সেক্যুলার। কিন্তু তাদের রাজনীতি ও এক্টিভিজমের চিন্তাধারা ছিল কিছুটা ডানপন্থী বা রক্ষনশীল ঘরানার।
যেমনটা আমরা ইতিমধ্যে আলোচনা করেছি, পপুলিস্ট সেক্যুলার চিন্তাধারা সংখ্যাগরিষ্ঠের আবেগ-অনুভূতির বিরোধিতা না করে, তাদের সমর্থন আদায়কে সামনে রেখে রাজনীতি ও এক্টিভিজম চর্চা করা। আমাদের দেশে পিনাকী ভট্টাচার্য, ফরহাদ মাজহার এবং বিএনপি-এরশাদপন্থীরা এঘরানার সাধারণ উদাহারণ। তারা দাবী না করলেও, এটা কখনই সঠিক নয় যে- তারা সেক্যুলার নয়।
আবুল হাশিমের ব্যাপারে পাকিস্তানী ইতিহাসবিদ হামযা আলাভি বলেন,
আবুল হাসিম ছিলেন ইসলাম ও সমাজতন্ত্রের এক 'কনফিউজড' বা বিভ্রান্ত মিশ্রনের প্রবক্তা।
Abul Hashim, a man who professed a confused mixture of socialism and Islam, was elected as the partyís secretary.
এছাড়াও, কট্টর সেক্যুলার, বামপন্থী দল জাসদ গঠনের পূর্বে এর নেতাদের আয়োজিত সম্মেলনে ('৭২ এর ছাত্রলীগের ভাঙনের নিয়ামক সম্মেলন) প্রধাণ অতিথির বক্তব্য দিতে নিমন্ত্রত হন আবুল হাশিম!
অন্যদিকে আওয়ামি লীগের এককালের সহসভাপতি আবুল মনসুর আহমদের উইকিপিডিয়া পেজ থেকে পাওয়া যায়,
"আবুল মনসুর আহমদ চল্লিশ, পঞ্চাশ ও ষাটের দশকজুড়ে ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে অবিরাম প্রচারণা চালিয়েছিলেন।"
শেষ জীবনে আবুল মনসুর বিএনপি তে যোগ দেন এবং সংসদ সদস্যও হোন।
খ) সমাজতন্ত্রে মোহাবিষ্ট আবুল হাশিমের ছেলে দেশের অন্যতম র্যাডিকেল কমিউনিস্ট হবেন তা বলাই বাহুল্য। তাই বদরুদ্দিন উমর বখে গিয়েছেন এ কথা বলা ইনসাফপূর্ণ না; বরং তার বাবাই আগে বখে গিয়েছিল, সে আমানত বহন করেছে মাত্র। একইভাবে, ৩০ বছর সেক্যুলারিজমের পক্ষে অবিরাম প্রচারণা চালিয়ে যাওয়া আবুল মনসুর আহমদের ছেলে, ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনামও বখে যাননি। তিনিও তার পিতার পদাংক অনুসরণ করেছেন মাত্র।
গ) মুসলিম লীগ, বিএনপি আর এরশাদের জাতীয় পার্টি করলেই কেউ ধার্মিক বা নন-সেক্যুলার হয়ে যায় না।
উদাহারণত, বিএনপির মহাসচিব মান্নান ভূইয়া ছিল পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক, এরশাদের প্রধানমন্ত্রী কাজী জাফর আহমদ ছিল এদেশের শীর্ষ বাম নেতা।
অতিসরলতা ও অতিসরলীকরণ অসহনীয় বটে!
সারকথাঃ
'মূলধারা' মূলত পপুলিস্ট জাতিয়তাবাদী সেক্যুলার চিন্তাধারার উত্তরসূরী ধারক-বাহক। মার্ক্সিস্ট লেখক তারিক আলীর ভাষায় যে চিন্তাধারার জন্ম হয়েছে, "১৯২০ এর দশকে উত্তর প্রদেশের মধ্যবিত্তের বৈঠকখানায়"।
মূলধারা শুরু সেক্যুলারিজমের গন্ডিতেই ছিল।
শাহবাগী-আওয়ামীরা ফ্যাসিবাদী সেক্যুলার হলে, মূলধারা হচ্ছে ডানপন্থী সেক্যুলার। আর কিছু না। বাহ্যিক বাস্তবতা যা ই হোক, উভয়ের মেহনতের ফলাফল অভিন্ন। নিয়তের কারণে পরিণতি পাল্টায় না।
শাহবাগী সেক্যুলারদের মেহনতের সুবিধাভোগী যদি হয় আওয়ামি-বামরা; তবে মূলধারার মেহনতের সুবিধাভোগী হবে পশ্চিমাপন্থী বিএনপি-জাতীয় পার্টি বা রেজা-কিবরিয়া গং।