পিনাকী ভট্টাচার্য, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের একজন সামনের সারির সক্রিয় সমর্থক ও এক্টিভিস্ট। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে রাজনীতি নিয়ে বেশ সহজবোধ্য ও গোছানো আলোচনা করে থাকেন। স্বৈরাচারী শাসনতন্ত্রের শক্তিশালী ও তীর্যক সমালোচনার মাধ্যমে ইতিমধ্যেই তিনি দেশের অন্যতম জনপ্রিয় এক্টিভিস্টে পরিণত হয়েছেন তিনি। সাহস ও জ্ঞানের পরিধির জন্য তিনি প্রশংসার দাবীদার। বাংলাদেশের জনগণের অবদমিত আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন উনার আলোচনায় তীব্রভাবে ঘটে থাকে।

সমস্যা চিহ্নিতকরণের পাশাপাশি দিকনির্দেশনা তুলে ধরার মাধ্যমে, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নিজেকে তিনি ফরাসি বিপ্লবের অন্যতম প্রভাবশালী ব্যাক্তিত্ব Jean-Paul Marat স্তরে নিয়ে গেছেন বলা যায়।

অত:পর,

এক আলোচনায় তিনি জানিয়েছেন, বাংলাদেশে বিপ্লবী পরিস্থিতি উপস্থিত। অতঃপর, এপরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে সমাজ পরিবর্তনের জন্য জনসাধারণকে উৎসাহিত করেছেন। 

বিপ্লবের সূত্র ধরিয়ে দিতে গিয়ে তিনি জনতার উদ্দেশ্যে বলেছেন, 

'বিপ্লবী রাজনীতির অন্যতম কিংবদন্তি ভ্লাদিমির লেনিনের তত্ত্বানুসারে, দেশে বিপ্লবের পরিস্থিতি অনেকটাই উপস্থিত।'

তিনি বলেন,

"লেনিনের মতে বিপ্লবী পরিস্থিতির পূর্বশর্ত হচ্ছে, 

১। শাসক শ্রেনী যখন এমন সংকটে পড়ে, তখন সে আগের মতো করে আর শাসন চালাতে পারেনা। 

২। যখন নিপীড়িত শ্রেনীর দুর্দশা অস্বাভাবিকভাবে আরও তীব্র হয়ে ওঠে। 

৩। যখন উপরের দুই কারণে সমাজে গনঅসন্তোষের জন্য, জনগন রাজনৈতিক পরিবর্তনে তার ঐতিহাসিক ভূমিকা পালনে তৈরি হয়ে উঠবে।"

তিনি আরো বলেছেন যে, 

"প্রথম দুই কারণ এখন উপস্থিত থাকলেও, ৩য় কারণ অনুপস্থিত। এজন্য জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে।"

আসলে এমন বয়ান নিয়ে কেবল পিনাকী ভট্টাচার্য নয়, গণতান্ত্রিক (ইসলামি ও সেক্যুলার) অনেক দলই সময় সময়ে জাতির সামনে হাজির হয়। জনপ্রিয় কলামিস্ট ফরহাদ মজহারও এতত্ত্ব প্রচার করে থাকেন। তত্ত্বটি কে, কখন আনেন বা এনেছেন, তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- মুসলিমপ্রধাণ দেশগুলোতে স্বৈরশাসন চলাকালে এতত্ত্বকে কেন্দ্র করে নানামুখী প্রচেষ্টা প্রায়ই হয়ে থাকে।

উদাহাস্বরূপ, '৭১ পরবর্তী সময়ে জাসদ একই রকম বিপ্লবী স্লোগান তুলে কোটি কোটি মানুষকে বিভ্রান্ত করেছিল। নব্বইয়ের দশকেও মেনন-রনোর মতো দাগী বামপন্থীরাও একই তত্ত্ব কপচিয়ে আপামর জনসাধারণের মেহনতের ফসল ঘরে তোলার প্রোগ্রাম নিয়ে হাজির হয়েছিল। নিকট অতীতে তিউনিশিয়া ও মিশরেও আরব বসন্তে ইসলামী বিপ্লবের স্লোগান তুলে মানুষকে একত্রিত করার পর, সেক্যুলার রাজনৈতিকরা শরিয়াহর পরিবর্তে পশ্চিমা আদলে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাই কায়েম করে।

আমাদের জন্য সবচেয়ে মারাত্মক উদাহারণ হচ্ছে, ১৩ দফাকে সামনে রেখে বাংলাদেশের উলামায়ে কেরামের ২০১৩-এর ৫ই মে'র মহান আন্দোলন। যে আন্দোলন - পরিপক্ক হয়ে ওঠার মুহূর্তে- প্রতিবিপ্লবী জাতিয়তাবাদী, গণতন্ত্রী ও ধর্মনিরপেক্ষ গোষ্ঠীর পাওয়ার স্ট্রাগলের কেন্দ্রে পরিণত হয়। ফলে ধূলিসাৎ হয় একটি অসাধারণ সম্ভাবনা।

এভাবেই নিকট অতীতে প্রায়ই বিপ্লবের আদলে প্রতিবিপ্লবের ফাঁদে ফেলে, জনসাধারণের জান, মাল ও মেহনতের ফসল নিজ ঘরে তুলেছে ক্ষমতালোভী বয়ানবাজের দল। হ্যা, একথা মানতেই হবে, আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে পিনাকি ভট্টাচার্যের উল্লেখ করা প্রথম দুইটি উপাদান প্রায়ই উপস্থিত হয়।

কিন্তু, বাকি থাকা শর্তটি কিভাবে পূরণ হবে? অর্থাৎ, কিভাবে জনগন রাজনৈতিক পরিবর্তনে তার ঐতিহাসিক ভূমিকা পালনে তৈরি হয়ে উঠবে? এটা কি স্বয়ংক্রিয়ভাবে হয়ে থাকে?

এক্ষেত্রে পিনাকিদা যার সূত্র টেনেছেন সেই লেনিনের চিন্তাধারার অবস্থানই দেখা যাক-

"The revolutionary class cannot “spontaneously” develop towards revolutionary consciousness even under the most revolutionary conditions."

"সবচেয়ে উপযোগী পরিস্থিতিতেও বিপ্লবী শ্রেনী স্বতঃস্ফূর্তভাবে বা নিজে নিজে বিপ্লবী চেতনায় উন্নত হতে সক্ষম নয়।"

অর্থাৎ, যদি প্রথম দুই উপাদানকে কেন্দ্র করে জনগণ কখনো একত্রিত হয়ও, তবুও শুধু এর দ্বারা বিপ্লব সম্পাদন সম্ভব না। তাহলে কে বা কারা জনমানুষকে বিপ্লবী চেতনায় ব্যাপকভাবে অনুপ্রাণিত করবে?

বরং, লেনিনীয় মতানুযায়ী,

"বিশুদ্ধ আদর্শের বিশেষায়িত ও দক্ষ ব্যাক্তিত্বের সমন্বয়ে গঠিত অগ্রগামী বাহিনী ব্যতীত, পরিস্থিতি হাজার বার আসলেও সফলতা সম্ভব না।"

অর্থাৎ, বিপ্লব পরিচালিত হতে হবে সঠিক আদর্শের যোগ্য নের্তৃত্বের অধীনে। লেনিনপন্থী দের মতে এ আদর্শটি হচ্ছে "মার্ক্সবাদ", আর বিপরীতে আমাদের জন্য আদর্শ হচ্ছে ইসলাম। "The Leninist Concept of the Revolutionary Vanguard Party" প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃতি দেখা যাকঃ-

"By contrast, Lenin, understanding that revolutionary consciousness did not develop “spontaneously” but had to be constantly fought for, set out to build a vanguard party capable of fighting for the revolutionary program and transforming the revolutionary potential of spontaneous militancy into revolutionary consciousness."

"বিপরীতে লেনিন বুঝেছিলেন যে, বিপ্লবী সচেতনতা নিজে নিজে গড়ে উঠে না, বরং এর জন্য ধারাবাহিক চেষ্টা চলমান থাকতে হয়। এ উদ্দেশ্যে লেনিন ভ্যানগার্ড বা অগ্রগামী সংগঠন গড়ে তোলেন, যেন বিপ্লব কর্মসূচী সঠিকভাবে পরিচালনা করা যায়। এবং নিজে থেকে প্রস্তুত হয়ে ওঠা বিপ্লবের সম্ভাবনাকে সচেতন বিপ্লবে রূপ দেয়া যায়।"

পিনাকি ভট্টাচার্য, ফরহাদ মজহার বা অন্যান্য বিপ্লবের আহবানকারীরা লেনিনের এই অবস্থান জানেন না, এটা প্রায় অসম্ভবের কাছাকাছি। 

লক্ষ্য করা যাক! লেনিন বিপ্লবী পরিস্থিতির জন্য অন্যতম অপরিহার্য উপাদান আরো কী কী উল্লেখ করেছেনঃ-

ক. সুবিধাবাদ ও সামাজিক-উগ্র স্বাদেশিকতাকে বা জাতিয়তাবাদকে সম্পূর্ণভাবে পরাস্ত করে, বিপ্লবীদের অগ্রবাহিনী অর্থাৎ বিপ্লবী আদর্শের সংগঠন, গ্রুপ এবং ধারাসমূহকে আদর্শগতভাবে প্রস্তুত হতে হবে। 

খ. বিপ্লবী শ্রেণির অগ্রবর্তী বাহিনী বা ভ্যানগার্ড সংগঠনের সমর্থনে সমগ্র বিপ্লবী শ্রেণি/বিপ্লবের সমর্থক শ্রেণী ও ব্যাপক জনগণকে এগিয়ে আসতে হবে।

গ. জনগণকে এই নতুন অবস্থানে টেনে আনার জন্যে ভ্যানগার্ড পার্টির মধ্যে বিপ্লবীদের তত্ত্ববাগিশতা এবং তার ভুলত্রুটিসমূহকে নির্মূল ও দূরীভূত করতে হবে। 

ঘ. বিপ্লবের বিরুদ্ধে যে সামাজিক শক্তিসমূহ আছে সেই প্রতিবিপ্লবী শক্তিসমূহের (ইসলামপন্থীরা যদি বিপ্লবী শ্রেণী হয় তবে- জামাত, বিএনপি ও অন্যান্য গণতান্ত্রিক দল, যারা ইসলামপন্থীদের মেহনত ও কুরবানির ফল নিজেদের ঘরে তুলতে চাইবে এবং আবারও সেক্যুলার শাসনই প্রতিষ্ঠা করবে), নিজেদের মধ্যে এমন দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হবে যার কোন মীমাংসার পথ থাকবে না এবং যার ফলে তারা নিজেরা দুর্বল হয়ে পড়বে। (আমাদের ইসলামপন্থীদের বিশ্লেষণ অনুযায়ী পিনাকি ভট্টাচার্য এই প্রতিবিপ্লবীদের কাতারেই পরেন।)

....ইত্যাদি 

এবার মূল কথায় আসা যাক,  পিনাকি ভট্টাচার্য বা অন্যান্য বিপ্লবীরা মৌলিক যে সকল প্রসঙ্গ উত্থাপন করা এড়িয়ে গেছেন ও যাবেন তা হচ্ছেঃ-

১. বিপ্লবের আদর্শ কী হবে? ইসলাম কায়েম না লিবারেল গণতান্ত্রিক রিপাবলিক কায়েম করা?

২. বিপ্লবীদের অগ্রগামী বাহিনী কারা হবে? সেক্যুলার সিস্টেমের বিরুদ্ধাচরণকারী, আপসহীন, বিশুদ্ধ মানহাজের কোনো ইসলামী গোষ্ঠী; না কি সেক্যুলার, গণতান্ত্রিক কোনো রাজনৈতিক দল?

৩. সেক্যুলার, গণতান্ত্রিক আদর্শের অনুগামী রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠী কি এদেশে বিপ্লবী শ্রেণী হতে পারে? না কি এরাই সেই সুবিধাভোগী, প্রতিবিপ্লবীর দল যারা ইসলামপন্থী জনতার ঘাড়ে সওয়ার হয়ে বিপ্লব চায়? যদি তা ই হয়, তাহলে প্রতিবিপ্লবী সেক্যুলার ও গণতান্ত্রিক দলগুলোর দূর্বল, ভিত্তিহীন ও জনসমর্থনহীন হয়ে পড়াই কি বিপ্লবী পরিস্থিতির দাবী হবে না?

এপ্রশ্নগুলোর উত্তর কী হবে?

পিনাকি ভট্টাচার্য, ফরহাদ মজহারসহ অন্যান্য বিপ্লবীদের কাছ থেকে সঠিক উত্তর হাজির হোক বা না হোক; বাস্তবতার দাবী এটাই যে- বিশুদ্ধ আকিদা ও মানহাজের উপর পরিচালিত সঠিক ইসলামী নের্তৃত্বের অধীনে একত্রিত হওয়া ব্যাতীত, ইসলামপন্থীদের জন্য কোনোপ্রকার বিপ্লবের ফসল ঘরে তোলা সম্ভব নয়। যদিও, আমি এও আশা রাখি, ইসলামী শাসন কায়েমের পথে সত্যের প্রতি দায়বদ্ধতা পিনাকি ভট্টাচার্যকে আমাদের পাশেই রাখবে। আর আল্লাহ তা আলা যা চান তা ই তো হয়।  

তাই বাংলাদেশের মুসলিমদের জন্য, আমানতদার, সঠিক নের্তৃত্ব এবং ন্যায়সংগত দাবীর উপস্থিতি ব্যাতীত অযথা বারুদের উত্তাপ অনুভব করানোর চিন্তা থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখা উচিৎ। উলামা, দাঈ, লেখক, এক্টিভিস্টসহ সকল ইসলামপন্থীদের জন্য আমাদের প্রস্তাবনা হল - 

সেক্যুলার আদর্শ ও শাসনের বিধ্বংসী সব আহবান ও আঘাতকে প্রতিহত করতে থাকতে হবে!

এবং, সঠিক নের্তৃত্ব ও মানহাজের দাওয়াত পেলেই কেবল নিজেদের প্রচেষ্টাগুলো একত্রিত করতে হবে, সর্বস্ব নিয়ে ঝাপিয়ে পরতে হবে।