গত ২৫০ বছরের ইতিহাসে শাসনব্যবস্থা এবং রাষ্ট্র কাঠামোর মৌলিক পরিবর্তনের ৩টি পথ দেখা যায়-

ক। বহিরাগত শক্তির হস্তক্ষেপ

খ। সশস্ত্র লড়াই (গৃহযুদ্ধ, গেরিলা যুদ্ধ ইত্যাদি) 

গ। গণঅভ্যুত্থান যা বিপ্লবে পরিণত হয়েছে। 

উল্লেখ্য গণঅভ্যুত্থান যেখানে বিপ্লবে পরিণত হতে পারেনি সেখানে শাসনব্যবস্থা এবং রাষ্ট্র কাঠামোর মৌলিক পরিবর্তন আসেনি। 

এই তিন পদ্ধতির কিছু ঐতিহাসিক উদাহরণ দেখা যাক।

ক) বহিরাগত শক্তির হস্তক্ষেপের মাধ্যমে মৌলিক পরিবর্তনের উদাহরণ:

১। নেপোলিয়নিক যুদ্ধ: সময়কাল, ১৮০৩-১৮১৫। নেপোলিয়নের সামরিক আগ্রাসনের ফলে ইউরোপের মানচিত্রে পরিবর্তন আসে, বিভিন্ন অঞ্চলে গঠিত হয় ফ্রান্সের ক্লায়েন্ট স্টেইট। ফরাসী বিপ্লবের চেতনা ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপের বিভিন্ন অংশে। উত্থান ঘটে মতবাদ হিসেবে জাতীয়তাবাদ এবং জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের।

২। পূর্ব ইউরোপে বিভিন্ন কমিউনিস্ট রাষ্ট্রের সূচনা: সময়কাল, ১৯৪৫-১৯৪৯। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে সোভিয়েত ইউনিয়নের দখলকৃত অঞ্চলগুলোতে কমিউনিস্ট সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়; যেমন পূর্ব জার্মানি, পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, চেকোস্লোভাকিয়া, বুলগেরিয়া এবং রোমানিয়া।

উত্তর কোরিয়াকেও এ পদ্ধতির উদাহরণ ধরা যেতে পারে। 

খ) সশস্ত্র লড়াইয়ের মাধ্যমে মৌলিক পরিবর্তনের উদাহরণ-

চীনের কমিউনিস্ট বিপ্লব: সময়কাল, ১৯৩০-এর দশক থেকে ১৯৪৯। মাও সেতুং এর নেতৃত্বে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি গেরিলা যুদ্ধ চালায় এবং বিজয়ী হয়। ১৯৪৯ সালে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় পিপলস রিপাবলিক অফ চায়না। 

কিউবান বিপ্লব: সময়কাল, ১৯৫৩-১৯৫৯। ফিদেল কাস্ত্রো এবং চে গুয়েভারার নেতৃত্বে কিউবান বিপ্লব, যা গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে বাতিস্তা শাসন উৎখাত করে। ১৯৬১ সালে কিউবাকে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ঘোষনা করা হয়।

আফগান ইমারাহ ১: সময়কাল, ১৯৯৪-২০০১, 

১৯৯৪ সালে সূচনার পর, ৯৬ নাগাদ পুরো দেশের অধিকাংশ অংশ নিয়ন্ত্রনে নেয় তালেবান আন্দোলন। ইসলামী ইমারত প্রতিষ্ঠা করে। গৃহযুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে গেরিলা যুদ্ধের বদলে অনেকটাই কনভেনশানাল মিলিটারি কনকোয়েস্টের আদলে কর্তৃত্ব অর্জন করে তারা। 

আফগান ইমারাহ ২: ২০২১ – চলমান। প্রায় বিশ বছর ধরে গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে ন্যাটো বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে তালেবান শেষ পর্যন্ত ২০২১ সালে ন্যাটো সেনারা আফগানিস্তান ছাড়ার আগেই নিয়ন্ত্রন নিয়ে ফেলে কাবুলসহ প্রায় পুরো দেশের। দ্বিতীয়বারের মতো প্রতিষ্ঠিত হয় ইসলামী ইমারাহ। 

এর বাইরে ভিয়েতনাম (১৯৭৬), লাওস (১৯৭৫), ক্যাম্বোডিয়া-খেমার রুজ (১৯৭৫)-কে সশস্ত্র লড়াইয়ের মাধ্যমে শাসন ও রাষ্ট্রে মৌলিক পরিবর্তন আনার উদাহরণ হিসেবে দেখা যায়। 

লক্ষণীয় বিষয় হল, উপরের প্রায় সব ক্ষেত্রে সশস্ত্র লড়াই সফল হয়েছে হয় গৃহযুদ্ধ অথবা বহিরাগত আগ্রাসনের প্রেক্ষাপটে। ব্যতিক্রম কিউবা। কাজেই বলা যেতে পারে, গৃহযুদ্ধ পরিস্থিতি বা বৈদেশিক আগ্রাসনের প্রেক্ষিতে সশস্ত্র পদ্ধতিতে সফল হবার সম্ভাবনা সিগনিফিক্যান্টলি বেড়ে যায়। এর সাথে এ তথ্যও যুক্ত করা যায় যে, যেসব অঞ্চলে গৃহযুদ্ধ পরিস্থিতি এবং বৈদেশিক আগ্রাসন নেই – এমন ক্ষেত্রে সশস্ত্র পদ্ধতি ব্যর্থ হবার সম্ভাবনা অনেক বেশি, বিশেষ করে সমতল ভূমিতে।

গ) গণঅভ্যুত্থান ও গণবিপ্লবের মাধ্যমে মৌলিক পরিবর্তনের উদাহরণ:

১। ফরাসি বিপ্লব: সময়কাল, ১৭৮৯-১৭৯৯। রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থান এবং রাজতন্ত্রের উৎখাত। আধুনিক রিপাবলিকানিসমের সূচনা। ক্ষমতা দখলের পর ক্ষমতা পাকাপোক্ত করা (কনসোলিডেশন)-র জন্য প্রথমে ‘ত্রাসের রাজত্ব’, তারপর গৃহযুদ্ধ। 

রুশ বিপ্লব: সময়কাল, ১৯১৭ ফেব্রুয়ারি এবং ১৯১৭ অক্টোবর। প্রথমে ফেব্রুয়ারিতে জার শাসনের পতন এবং লিবারেল-ডেমোক্রিটিক ধাঁচের সরকার গঠন। তারপর বলশেভিক পার্টির নেতৃত্বে অক্টোবর বিপ্লব, যার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয় সোভিয়েত ইউনিয়ন। বলশেভিক পার্টি ক্ষমতা দখলের পর ক্ষমতা পাকাপোক্ত করা (কনসোলিডেশন)-র জন্য তীব্র গৃহযুদ্ধ শুরু হয়, এ যুদ্ধে বিজয়ী হয় বলশেভিকরা।

ইরানি বিপ্লব: সময়কাল, ১৯৭৯। পাহলভিদের রাজতন্ত্রের উৎখাত এবং রুহুল্লাহ খোমেইনির অধীনে ‘ইসলামি প্রজাতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠা। ক্ষমতা দখলের পর ক্ষমতা পাকাপোক্ত করা (কনসোলিডেশন)-র জন্য শুদ্ধি/নির্মূল অভিযান (পার্জ)। 

নোট ১ - যে পদ্ধতিতে কখনোই শাসনব্যবস্থা এবং রাষ্ট্রকাঠামোর মৌলিক পরিবর্তন আসেনি; নির্বাচনী গণতন্ত্র। 

নোট ২ - এটা কোন শার'ঈ আলোচনা না। বরং কিছু প্রাসঙ্গিক তথ্য তুলে ধরা এবং প্যাটার্ন রেকগনিশনের চেষ্টা।