গত ১০০ বছরে কোন ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রন (তামকীন) অর্জন করে ইসলামী শাসন বাস্তবায়ন করার উদাহরণ—
১। রীফ ইমারাহ: সময়কাল, ১৯২১-১৯২৬। অঞ্চল; মরক্কোর পাহাড়ি রীফ অঞ্চল। প্রতিষ্ঠাতা; আমীর মুহাম্মাদ বিন আব্দেলকারীম আল-খাত্তাবী, রাহিমাহুল্লাহ।
পদ্ধতি: গেরিলা যুদ্ধ। আল-খাত্তাবীকে আধুনিক গেরিলা যুদ্ধের জনক বলা হয়।
১৯২১ সালে স্প্যানিশ উপনিবেশিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রীফের গোত্রগুলোকে একত্রিত করতে শুরু করেন আমীর আল-খাত্তাবী। সে বছরের এপ্রিলে উলামা ও গোত্রপতিদের ঐক্যমতে তাঁকে আমীর নির্ধারণ করা হয়। ১৯২১ সেপ্টেম্বরে দেয়া হয় ইমারাতের ঘোষণা। রিপাবলিক অফ রীফ। নামে রিপাবলিক হলেও এটি ছিল ইসলামী শরীয়াহ দ্বারা শাসিত ইমারাত। আয়তনে ২০ হাজার বর্গ কিলোমিটার। আজকের কুয়েতের চেয়ে বড়। ৮০ জন গোত্র প্রধান ও আলিমদের নিয়ে গঠিত হয় মজলিশে শূরা। শরীয়াহ আদালতে বিচার হতো মালিকী ফিকহ অনুযায়ী।
১৯২৪ নাগাদ স্প্যানিশদের পাশাপাশি শুরু হয় ফ্রেঞ্চদের আগ্রাসন। মুসলিমদের সাথে গাদ্দারি করে ফ্রেঞ্চদের অধীনস্ত মরক্কোর সুলতান। তবু বিপুল প্রতিকূলতার মুখে আমীর আল-খাত্তাবীর বাহিনী টিকে থাকে। একসময় সাধারন জনগণকে নিশানা বানিয়ে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার শুরু করে স্প্যানিশরা। ১৯২৫ থেকে ১৯২৬ এর মধ্যে বিষাক্ত গ্যাসের প্রভাবে মারা যায় প্রায় দেড় লক্ষ মরক্কোন মুসলিম। সাধারন জনগনকে রক্ষার জন্য শেষ পর্যন্ত আত্মসমর্পণ করেন আমীর আল-খাত্তাবী। [১]
২। প্রথম আফগান ইমারাহ : সময়কাল, ১৯৯৪-২০০১।
পদ্ধতি: গৃহযুদ্ধ, মোবাইল ওয়ারফেয়ার, মিলিশিয়া অফেন্সিভ।
প্রেক্ষাপট: ১৯৯৪ সালে সূচনার পর, ৯৬ নাগাদ পুরো দেশের অধিকাংশ অংশ নিয়ন্ত্রনে নেয় তালেবান আন্দোলন। প্রতিষ্ঠা করে ইসলামী ইমারাহ। গৃহযুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে গেরিলা যুদ্ধের বদলে অনেকটাই কনভেনশানাল মিলিটারি কনকোয়েস্টের আদলে কর্তৃত্ব অর্জন করে তারা। ২০০১-এ অ্যামেরিকার আগ্রাসনের পর পতন ঘটে এই ইমারাতের।
৩। দ্বিতীয় আফগান ইমারাত: সময়কাল, ২০২১-চলমান।
পদ্ধতি: গেরিলা যুদ্ধ।
প্রেক্ষাপট: প্রায় বিশ বছর ধরে গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে ন্যাটো বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে তালেবান শেষ পর্যন্ত ২০২১ সালে ন্যাটো সেনারা আফগানিস্তান ছাড়ার আগেই নিয়ন্ত্রন এনে ফেলে কাবুলসহ প্রায় পুরো দেশ। দ্বিতীয়বারের মতো প্রতিষ্ঠিত হয় ইসলামী ইমারাহ। অনেক বিশেষজ্ঞ মতে ন্যাটোর বিরুদ্ধে তালেবানের প্রতিরোধকে ভিয়েতনামের পর গেরিলা যুদ্ধের সবচেয়ে সফল প্রয়োগ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। [২]
৪। ইসলামি প্রজাতন্ত্রী ইরান: সময়কাল, ১৯৭৯ – চলমান।
পদ্ধতি: গণবিপ্লব
প্রেক্ষাপট: শিয়া সম্প্রদায়ের অন্যতম শীর্ষ বৈশ্বিক ধর্মীয় নেতা তথা ‘আয়াতুল্লাহ’ রুহুল্লাহ খোমেইনির নেতৃত্বে পাহলভী রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে দীর্ঘ গণআন্দোলন যা এক পর্যায়ে বিপ্লবী গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয়। গণঅভ্যুত্থানের সর্বশেষ পর্যায়ে ইরানের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১০% এর মতো রাস্তায় নেমে আসে। অনেক অ্যাকাডেমিক একে আধুনিক সময়ের সর্ববৃহৎ ম্যাস পলিটিকাল মোবালাইযেইশান হিসেবে চিহ্নিত করেছেন [৩]
গণঅভ্যুত্থানের কারণে ইরানের শাহ দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। বিপ্লবী রাজপথে থেকে আন্দোলন চালিয়ে যায়। এক পর্যায়ে সামরিক বাহিনী বিপ্লবীদের নেতৃত্ব মেনে নেয়। ১৯৭৯ সালের এপ্রিলে দেশটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলামী রিপাবলিক ঘোষণা দেয়া হয়।
৫। দায়েশ(ISIS): সময়কাল, ২০১৪-২০১৭, মতান্তরে ২০১৯। অঞ্চল; ইরাক ও সিরিয়ার বিভিন্ন অংশ।
পদ্ধতি: গেরিলা যুদ্ধ, ইনসার্জেন্সি, ‘ব্লিটযক্রিগ’ ধাঁচের অভিযান।
প্রেক্ষাপট: জুন ২০১৪-তে সংগঠনটি ইরাকের মসুল দখল করার পর এককভাবে তাদের নেতাকে ‘খলিফা’ বলে ঘোষণা করে, এবং নিজেদেরকে খিলাফাহ বলে দাবি করে। এই সময়ে সংগঠনটি ইরাক ও সিরিয়ার প্রায় ৯০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছিল।
উল্লেখ্য, এই ঘোষণার সাথে সাথেই সংগঠনটির পক্ষ থেকে জানানো হয় যেকোন অঞ্চলে তাদের পদার্পন হওয়া মাত্রই সেখানকার সকল ইসলামী সংগঠন, জামআহ এবং ইমারাত বাতিল বলে গণ্য হবে। প্রয়োজনে তাদের জোরপূর্বক দমন করা হবে।
পরবর্তীতে সংগঠনটির পক্ষ থেকে এ-ও বলা হয় যে তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করা কার্যত ইসলামী শরীয়াহ প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে লড়াই বলে গণ্য হবে। অতএব, যারাই তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করবে তারা কুফরে লিপ্ত। এই নীতির কারণে সিরিয়া, ইয়েমেন, সোমালিয়া, আফগানিস্তানসহ বিভিন্ন অঞ্চলে তারা অন্যান্য মুসলিম দলগুলোর বিরুদ্ধে সঙ্ঘাতে জড়িয়ে পড়ে এবং এধরণের সব সংগঠনকে কাফির ঘোষণা করে।
২০১৫ সাল থেকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোট বাহিনী এবং অন্যান্য আঞ্চলিক শক্তিগুলো দাঈশের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে। ২০১৭ সালের শেষ দিকে মসুল (ইরাক) এবং রাক্কা (সিরিয়া) তাদের কাছ থেকে পুনর্দখল করা হয়। ২০১৯ সালের মার্চে সিরিয়ার বাঘুজ ছিল তাদের সর্বশেষ ঘাঁটি। এর পতনের পর তাদের দাবিকৃত অধিকাংশ অঞ্চলের নিয়ন্ত্রন তারা হারিয়ে ফেলে।
উল্লেখ্য, তথ্যগত অ্যাকুরেসি, স্বচ্ছতা, এবং আলোচনার খারিতে সর্বশেষ দৃষ্টান্ত দুটি যুক্ত করা হলো। যদিও ইরানি বিপ্লবের শিয়া নেতৃত্ব এবং দায়েশ-এর অবস্থান দুটোকেই আমি আহলুসসুন্নাহ ওয়াল জামাআহ-এর অবস্থানের জায়গা থেকে বিচ্যুত মনে করি।
দেখা যাচ্ছে, ওপরের ৫টি উদাহরণের মধ্যে চারটি ক্ষেত্রেই কর্তৃত্ব ও শাসন প্রতিষ্ঠার ব্যাপারটা ঘটেছে সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে। ব্যতিক্রম ইরান। একই সাথে লক্ষণীয় বিষয় হল, ইরান ছাড়া প্রত্যেক ক্ষেত্রে হয় বাহ্যিক আগ্রাসন ছিল অথবা গৃহযুদ্ধ পরিস্থিতি চলমান ছিল।
সম্ভাব্য হাইব্রিড:
সিরিয়াতে যদি ইসলামী শাসন কায়েম হয় তাহলে তা এই লিস্টে ষষ্ঠ এন্ট্রি হিসেবে যুক্ত হবে। সেক্ষেত্রে তাহলে সিরিয়া গণঅভ্যুত্থান ও গৃহযুদ্ধের একটি হাইব্রিড মডেল হিসেবে গণ্য হতে পারে, কারণে এখানে দুটো পদ্ধতির মিশ্রন ঘটেছে।
সিরিয়াতে প্রথমে নিরস্ত্র গণঅভ্যুত্থান হয়েছে। সরকারের নৃশংসতা এবং নির্মমতার কারনে একসময় তা রূপ নিয়েছে গৃহযুদ্ধে। শেষ পর্যন্ত ১৩ বছরের গৃহযুদ্ধের পর তামকীন অর্জিত হয়েছে।
সশস্ত্রভাবে তামকীন অর্জনের যতোগুলো উদাহরণ আছে তার মধ্যে অধিকাংশ ক্ষেত্রে (চারটির মধ্যে তিনটি) লড়াইয়ের পদ্ধতি ছিল গেরিলা যুদ্ধ। সিরিয়া এখানেও ব্যতিক্রম। সিরিয়াতে যদিও অ্যাসেমেট্রিক ওয়ারফেয়ার বা অসম যুদ্ধ চলেছে, কিন্তু এখানে গেরিলা যুদ্ধের পদ্ধতি ব্যবহার হয়েছে অত্যন্ত কম, বা ব্যবহার করা হয়নি বললেই চলে।
উল্লেখ্য, অ্যাসেমেট্রিক ওয়ারফেয়ার মানেই গেরিলা পদ্ধতি না, আর গৃহযুদ্ধ মানেই গেরিলা যুদ্ধ না। গেরিলা যুদ্ধ, সশস্ত্র যুদ্ধের একটি নির্দিষ্ট ধরণ যার বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য এবং উপাদান আছে। [৪]
নোট ১ – যে পদ্ধতিতে এক ইঞ্চি মাটিতেও আজ পর্যন্ত ইসলামী শাসন (সঠিক, আংশিক, কিংবা ত্রুটিপূর্ণ) কায়েম করা সম্ভব হয়নি; গণতন্ত্র।
নোট ২ - এটা কোন শার'ঈ আলোচনা না। বরং কিছু প্রাসঙ্গিক তথ্য তুলে ধরা এবং প্যাটার্ন রেকগনিশনের চেষ্টা।
আগের পর্বের লিংক:
https://aborton.net/posts/12
______
[১] আমীর আল-খাত্তাবী রাহিমাহুল্লাহকে নিয়ে শাইখ মুসা আল-শারীফের আলোচনা
https://www.youtube.com/watch?v=zTqzWxQ7HvI
Biography:
https://www.youtube.com/watch?v=VjIpVCCy7Us
Father of guerrilla warfare
https://gulfnews.com/world/africa/father-of-guerrilla-warfare-1.790991
Abd-el-Krim al-Khattabi: The Unknown Mentor of Che Guevara:
https://www.tandfonline.com/doi/abs/10.1080/09546553.2014.997355
[২] https://www.abc.net.au/news/2021-08-19/taliban-return-power-afghanistan-mao-zedong-us-lessons-history/100386792
https://foreignpolicy.com/2023/01/24/mao-zedong-taliban-strategy-xi-jinping-china-war/
[৩] Kurzman, Charles. "The Unthinkable Revolution in Iran." (2004).
[৪] https://warisboring.com/not-every-civil-war-is-a-guerilla-war/