ইসলামী বিপ্লব এবং বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ইসলামী সমাজ নির্মাণের জন্য হিযবুত তাহরীর বিভিন্ন সাংগঠনিক কর্মসূচি ও কর্মপন্থা গ্রহণ করেছে। তাদের এ সমস্ত কর্মসূচি মূলত রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সদস্যদেরকে প্রশিক্ষিত করে থাকে। কিন্তু ইসলামের অন্যান্য বিষয়ে সদস্যদের ক্রমাগত উন্নতির পথে পরিচালিত করতে পারে না। যার ফলে ইসলামের জন্য প্রয়োজনীয় সঠিক রাজনৈতিক রূপরেখা প্রনয়ণে তারা অক্ষম।
এ সমস্ত চিন্তাধারার কথা বলে তারা উম্মাহকে আশার আলো দেখিয়ে থাকেন। উম্মাহ যেন তাদের এসব চিন্তাধারা গ্রহণ করে নেয় এবং সে অনুসারে কাজ করে তাদের সংগঠনের সদস্য হয়ে যায়, সে আহ্বানও জানাতে থাকেন। এভাবেই তারা শাসন ক্ষমতা পর্যন্ত পৌঁছাতে চায়। চাই সেটা উম্মাহর বৃহৎ অংশ তাদের চিন্তাধারায় চলে আসা মাধ্যমে হোক অথবা রাষ্ট্রপ্রধান, গোত্রপ্রধান কিংবা সামর্থ্যবান অন্য যেকোন সংগঠনের কাছে ‘নুসরাহ্’ তথা সাহায্য প্রার্থনা করার মাধ্যমেই হোক।
নুসরাহ্ কাদের কাছে তলব করা হচ্ছে? তাদের হাকীকত এবং প্রকৃত অবস্থা কী? এ বিষয়গুলোর দিকে নজর দেয়াকে তারা প্রয়োজনীয় মনে করে না। তাদের দাওয়াহ্ ও চিন্তা-ধারা প্রসারের এই কর্মপন্থার মাধ্যমে সামাজিক বিপ্লবের এই নীতির ব্যর্থতা তারা নিজেরাও স্বীকার করেছে। তাদের ভাষায় এই ব্যর্থতার কারণ হচ্ছে, সামাজিক স্থবিরতা। আর এতে করে তারা শক্তি-সামর্থ্য সম্পন্ন, শান শওকত ও ক্ষমতার অধিকারী মহল তথা সেনাবাহিনীর কাছে সাহায্য কামনা করতে বাধ্য হয়েছেন। এই নুসরাহ তথা সাহায্য কামনাকে তারা সাব্যস্ত করেছেন ইসলামী সমাজ বিনির্মাণের জন্য অবশ্য পূরণীয় শর্ত বলে!
হিযবুত তাহরীরের মতে, এই শর্ত পূরণ না হলে ভূপৃষ্ঠে আল্লাহর খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কোনো উপায় নেই। এসবের মধ্য দিয়ে মূলত: হিযবুত তাহরীরের ভাইয়েরা যুগের ফরজে আইন দুই বিধান, ই'দাদ ও জিহাদকেই অকার্যকর করে দিয়েছেন।
হিযবুত তাহরীরের উদ্ভাবিত উপরোক্ত মানহাজ প্রকৃত অর্থে নববী আদর্শের বিরোধী এবং সমাজ বিনির্মাণ ও জাতি গঠনে জগতের প্রাকৃতিক নিয়মের বিপরীত।
উপরোক্ত কারণ ছাড়াও লক্ষ্যে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে তাদের কর্মপন্থা ব্যর্থ হওয়ার আরো একটি কারণ হল, ব্যবহারিক বাস্তব জীবনাচারও তাদের কর্মপন্থার বিপরীত। হিযবুত তাহরীর বিষয়টি এভাবে স্বীকার করেছে –
১) হিযবুত তাহরীর দেখতে পেল, উম্মাহ তাদের আশা-ভরসার স্থল নেতৃবৃন্দ ও কর্ণধারদের প্রতি আস্থাহীন।
২) মুসলিম ভূখন্ডগুলোতে উপর্যুপরি ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের কারণে প্রতিকূল পরিস্থিতি বিরাজ করছে। জনগণের উপর শাসকগোষ্ঠী অন্যায়, অত্যাচার করছে।
৩) সংগঠনের যুবকদের ওপর শাসকদের অবর্ণনীয় নিপীড়ন নিগ্রহের কারণে সামাজিক পরিবেশ বিপ্লবের জন্য অনুর্বর ও স্থবির।
তখন তারা এই অনুর্বরতা ও স্থবিরতা প্রতিকারে সক্ষম সামর্থ্যবান শ্রেণীর কাছে নুসরাহ্ তলবের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। হিযবুত তাহরীরের প্রতিষ্ঠাতা নিজ গ্রন্থ 'আত তাকাত্তুল আল হিযবী'-তে এ বিষয়ে গুরুত্বারোপ করে বলেন,
“তৃতীয় মারহালা হলো: শাসন ক্ষমতা গ্রহণ। সংগঠন, উম্মাহর সাহায্যে এবং নুসরাহ্ তলব প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শাসন ক্ষমতা গ্রহণ করবে।”
নিজেদের আবিষ্কৃত শর্তের ভিত্তিতে নুসরাহ্ তলবের নামে যে বিদআতের কথা তারা সকাল-সন্ধ্যা আড়ম্বরসহকারে বলতে থাকে, তা বাতিল হওয়ার কয়েকটি কারণ আমরা এখানে আলোচনা করছি।
প্রথমত, ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা। আমাদের জীবনের নিশ্চিত-সম্ভাব্য, ছোট-বড় এমন কোনো দিক নেই, যেখানে ইসলামের অনুশাসন ও বিধান নেই। এমনকি একজন মুসলিম কীভাবে মলমূত্র ত্যাগ করবে, ইসলাম সে বিষয়েও নীতিমালা দিয়ে দিয়েছে।
তাহলে আমর বিল মারুফ, নাহি আনিল মুনকার, ইসলামী হদ প্রতিষ্ঠা ও শরীয়তের অন্যান্য বিধান বাস্তবায়নসহ আরো বহু কল্যাণের ভিত্তি খিলাফত ব্যবস্থার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে কোনো রূপরেখা না দিয়ে ইসলাম কীভাবে চুপ করে থাকতে পারে?
তাদের মতে ভূ-পৃষ্ঠে খিলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য অবশ্য পূরণীয় শর্ত হল নুসরাহ তলব। এখন কথা হল, হিযবুত তাহরীরের আবিষ্কৃত পন্থাতেই যদি নুসরাহ্ তলবের বিষয়টি সীমাবদ্ধ থাকত, তবে অবশ্যই কুরআন-হাদীসে সে বিষয়ে সুস্পষ্ট আলোচনা থাকত। আর উলামায়ে কেরামও সে বিষয়ে অবশ্যই সুস্পষ্টভাবে আলোচনা করতেন। কিন্তু এমন কিছু খুঁজে পাওয়া যায় না।
দ্বিতীয়ত, হিযবুত তাহরীর খিলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য সামর্থ্যবান গোত্র, সংগঠন, সেনাবাহিনী ইত্যাদির কাছে নুসরাহ চাওয়ার শর্ত জুড়ে দিয়েছে। অথচ সালফে সালেহীন উলামায়ে কেরামের মধ্যে কেউ ইতিপূর্বে এমন কিছু বলেননি। অতএব, এটা প্রত্যাখ্যাত বিষয়। খিলাফতের অবসান ও বিলুপ্তি ঘটার ব্যাপারে হাদীসে বক্তব্য এসেছে।
উলামায়ে রাব্বানী ও পূর্ববর্তী আলিমরা তাহলে কীভাবে নুসরাহ তালাশ সংক্রান্ত আলোচনার ব্যাপারে উদাসীন থাকতে পারেন? কেন তাঁরা নিজেদের কিতাবাদিতে সংক্ষিপ্তাকারে হলেও এ বিষয় কিছু উল্লেখ করেননি?
আর মুহাম্মাদ ﷺ আনসারদের কাছে যে পদ্ধতিতে নুসরাহ্ তলব করেছিলেন সেটি ছিল সময়োপযোগী, বাস্তবতার দাবি এবং আরবের গোত্রীয় ও গ্রামীণ—সব রকম সামাজিক পরিস্থিতির অনুকূল। কিন্তু আমাদের বাস্তব অবস্থা ব্যতিক্রম। আমাদের এই সময়ে সীমালংঘনকারী, হঠকারীদের দল, উম্মাহর ঘাড়ে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসে আছে। তাই কোনো অবস্থাতেই এই পন্থা বাস্তবায়িত করার সুযোগ নেই। বরং এতে হিতে বিপরীত হবার আশঙ্কা রয়েছে। তাই এভাবে রাষ্ট্রপ্রধান, সেনাবাহিনী ইত্যাদির কাছ থেকে নুসরাহ নিয়ে ক্ষমতালাভ এবং খিলাফত প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দিবাস্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই নয়।
তৃতীয়ত, নবীজি ﷺ আরব গোত্রগুলোর কাছে নুসরাতের যে পন্থা প্রয়োগ করেছেন, তা ছিল মাক্কী যুগে তথা মুসলিমদের দুর্বল অবস্থায়। তখন পর্যন্ত মদীনায় নবীজির নের্তৃত্বে শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়নি। আর এ কারণেই কোনো অবস্থাতেই পিছনে ফিরে তাকানো এবং ইসলামী সমাজ বিনির্মাণের ক্ষেত্রে নুসরাহ তলব করাকে অবশ্য পূরণীয় শর্ত বলে সাব্যস্ত করা আমাদের জন্য জায়েজ হবে না।
চতূর্থত, মুহাম্মাদ ﷺ এর নুসরাহ তালাশের স্থায়িত্ব ছিল দুই বছরের মতো। কিন্তু হিযবুত তাহরীর প্রায় সাত দশক ধরে নুসরাহ্ তলব করেই চলেছে। সাহায্য কামনা করেই যাচ্ছে। আমাদের জীবদ্দশায় আমরা কি দেখে যেতে পারব যে তারা স্বামর্থবানদের থেকে সাহায্য লাভে ধন্য হয়েছে?
পঞ্চমত: হিযবুত তাহরীর ১৩ বছরের অনধিক এক মেয়াদকাল নির্ধারণ করে দিয়েছে প্রতিশ্রুত খিলাফত ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য। নবুওয়্যাত লাভের পর, নুসরাহ্ প্রাপ্তির পূর্বে রাসুলুল্লাহ ﷺ মক্কায় ১৩ বছর অবস্থান করেছিলেন। এখান থেকেই মূলত তাদের এই মেয়াদকাল নির্ধারণ। তাদের নির্ধারিত এই মেয়াদকাল পার হয়ে গিয়েছে অথচ খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
এরপর তারা আবারও অনুরূপ মেয়াদকাল নির্ধারণ করেছে। দ্বিতীয়বারও লক্ষ্যে পৌঁছানো ছাড়াই মেয়াদকাল পার হয়ে গিয়েছে। প্রায় ৭০টি বছর এভাবে চলে গিয়েছে, কিন্তু তারা এখনো মক্কী যুগ থেকে বের হয়ে আসতে পারছে না। আজও তারা অপেক্ষায় রয়েছে নুসরাহ্ প্রাপ্তির।
প্রিয় পাঠক! একটু চিন্তা করে দেখুন, তা কতটা বাস্তবতা-বিবর্জিত!
ষষ্ঠত: হিযবুত তাহরীর যে নুসরাহ্'র স্বপ্ন দেখে যাচ্ছে, তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম যে তা একদিন পূরণ হবে। তবুও তো এর জন্য এমন একদল লোকের প্রয়োজন যারা দুনিয়ার জীবন, খ্যাতি, ক্ষমতার লোভ, ধন-সম্পদকে অবলীলায় তুচ্ছজ্ঞান করতে পারে। এমন গুণাবলীসম্পন্ন একদল মানুষ পাওয়া বর্তমান যুগে ধরতে গেলে প্রায় অসম্ভব।
কারণ, এই যুগে বাতিল শাসকেরা সেনাবাহিনীকে গোলাম বানিয়ে রাখে। আর উম্মাহর কাঁধে চেপে বসা সীমালঙ্ঘনকারী গোষ্ঠীর কর্তৃত্বে যতই দিন অতিবাহিত হচ্ছে, উম্মাহ ততই এ সমস্ত উচ্চ মানবিক গুণ ও উন্নত জীবনাচার থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। অথচ নুসরাহ্'র জন্য এগুলো একান্তই প্রয়োজন।
উপরে যে গুণাবলীর কথা বলা হলো, সাধারণ মানুষের মধ্যেই এগুলো পাওয়া দুষ্কর। হিযবুত তাহরীর খিলাফাহ্ প্রতিষ্ঠার জন্য যাদের সাহায্যের অপেক্ষায় বসে আছে, তাদের মাঝে কীভাবে সেগুলো পাওয়া যেতে পারে?
প্রকৃতপক্ষে, হিযবুত তাহরীর যে নুসরাহ্'র জন্য প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে এবং আশা নিয়ে বসে আছে, তা নিছক কল্পনা ও প্রতারণার মরীচিকা ছাড়া আর কিছুই নয়। তাদের দাবিকৃত এই নুসরাহ্ কেবলই একটি অজুহাত, যা তাদেরকে ইসলামের প্রকৃত মেহনতকে অকার্যকর করার পক্ষে বৈধতা দিচ্ছে। ইচ্ছায় হোক অনিচ্ছায় হোক—তারা মূলত এই কাজই করে যাচ্ছে। তাদের এই নব-উদ্ভাবিত মানহাজ ইতিপূর্বে চর্চা করে গেছে রাফেজী শিয়া গোষ্ঠী ও মুরতাদ কাদিয়ানী গোষ্ঠী। তারা সকলেই ইদাদ ও জিহাদকে অকার্যকর সাব্যস্ত করেছিল।
(২)
তাকিউদ্দিন নাবহানির প্রতিষ্ঠিত এই সংগঠন ও মানহাজের অনুসারীরা ইসলামকে কেবল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সীমাবদ্ধ করে দ্বীনের অন্যান্য বিষয়কে একরকম পাশ কাটিয়ে খিলাফত প্রতিষ্ঠা করতে চায়।
‘বিপ্লব সৃষ্টিতে হিযবুত তাহরীরের পন্থা’ (منهج حزب التحرير في التغيير) গ্রন্থে বলা হচ্ছে -
“যে সমস্ত সংগঠন অরাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত থাকে, মূলধারার ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। খিলাফত পুনরুদ্ধার ও আল্লাহর শাসন প্রতিষ্ঠার যেই লক্ষ্য বাস্তবায়ন মুসলিমদের ওপর ওয়াজিব, এসব সংগঠন কখনোই সে লক্ষ্যে পৌঁছতে সক্ষম নয়। যেমন-
১. যেসব সংগঠন কল্যাণমূলক বিভিন্ন কাজ করে থাকে। যেমন- মাদ্রাসা ও হাসপাতাল চালু, গরীব অসহায় ও দুঃস্থদের সাহায্য করা ইত্যাদি।
২. যেসব সংগঠন ইবাদাত ও সুন্নাহ্ পালনে উৎসাহ প্রদানের কাজ করে থাকে।
৩. যেসব সংগঠন আমর বিল মা'রূফ ও নাহি আনিল মুনকার করে থাকে।
৪. যেসব সংগঠন সমাজ সংশোধন এবং উন্নত চরিত্র বিনির্মাণে কাজ করে থাকে।”
এতে আরও বলা হয়,
“হিযবুত তাহরীর একটি রাজনৈতিক সংগঠন যা ইসলামী চিন্তাধারার ওপর প্রতিষ্ঠিত। এটা রূহানী পুরোহিতের কাজ আঞ্জাম দেয়ার কোনো সংগঠন নয়, না এটি কোন আমলী সংগঠন। কোনো শিক্ষামূলক বা জনকল্যাণমূলক সংগঠনও এটি নয়।”
তাদের এই দৃষ্টিভঙ্গি অবিবেচনা-প্রসূত। এসব বক্তব্যের ব্যাপারে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার পক্ষ থেকে কোনো দলীল প্রমাণ নাযিল হয়নি। এসবের মধ্য দিয়েই হিযবুত তাহরীর ইসলামকে তার অন্যান্য সকল অঙ্গ ও অধ্যায় থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে।
তারা যুক্তি দেখায়, অন্যান্য কর্মসূচী দ্বারা ইসলাম রাজনৈতিক কর্তৃত্ব লাভ করতে পারে না। ক্ষমতার আসনে অধিষ্ঠিত হতে পারে না।
তাদের দৃষ্টিতে রাজনৈতিক অঙ্গন ছাড়া ইসলামে যেন আর কিছুই নেই! তারা জোর করে ইসলামকে শুধু রাজনীতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ করতে চায়। তারা বলতে চায়, শুধু রাজনীতি দ্বারাই খিলাফত পুনঃপ্রতিষ্ঠা লাভ করবে।
এ দলের এটা জানা নেই যে, ইসলাম এমনই পরিপূর্ণ একটি জীবনব্যবস্থা, তা তার শাখা-প্রশাখার পৃথকীকরণ মেনে নেয় না। মানহাজ, আকীদা, আখলাক, মুয়ামালাত, ইবাদাত, আধ্যাত্মিকতা, শরয়ী রাজনীতি, জিহাদ—সবকিছু মিলিয়েই ইসলাম। কখনোই একটির বিপরীতে অন্যটিকে দাঁড় করানো, একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটিকে প্রাধান্য দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। বরং ইসলাম পরিপূর্ণ ও পূর্ণাঙ্গ একটি জীবনব্যবস্থা, যার এক শাখা অন্য শাখার জন্য পরিপূরক। যার একাংশ অন্য অংশের জন্য সত্যায়নকারী।
হিযবুত তাহরীর আরো বলে-
“হিযবুত তাহরীরের সকল কার্যক্রম হচ্ছে রাজনৈতিক। শিক্ষাদানের সঙ্গে তার কার্যক্রমের সম্পর্ক নেই। অতএব, এটি কোনো মাদ্রাসা নয়। একইভাবে ওয়াজ-নসিহত এবং ধর্মীয় দিক-নির্দেশনা প্রদান আমাদের কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত নয়। আমাদের কার্যক্রম শুধুই রাজনৈতিক, যেখানে ইসলামের প্রকৃত চিন্তাধারা, বিধিমালা এবং নিয়ম-নীতি সম্পর্কে জানানো হবে যেন সে অনুসারে কাজ করা যায়।
আরও বলা হচ্ছে—
“হিযবুত তাহরীর একটি রাজনৈতিক সংগঠন। কোনো আধ্যাত্মবাদী সংগঠন নয়। না কোনো আমলের অনুশীলনমূলক সংগঠন, শিক্ষাগত সংগঠন কিংবা কোনো দাতব্য সংগঠনও নয়।”
আরও বলা হচ্ছে-
“হিজবুত তাহরীরের কার্যক্রম সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক, চাই প্রত্যক্ষভাবে শাসন ক্ষমতার সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা থাকুক কিংবা না থাকুক। কিন্তু কখনোই শিক্ষা-দীক্ষা তার কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত নয়। অতএব, এটি কোনো মাদ্রাসা নয়। ওয়াজ-নসিহত এবং ধর্মীয় দিক-নির্দেশনা প্রদান এই সংগঠনের কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত নয়। এর কার্যক্রম শুধুই রাজনৈতিক, যেখানে ইসলামের সঠিক চিন্তা, দর্শন ও বিধিমালা জানানো হবে তদনুযায়ী কাজ করার জন্য।”
আমি এই সংগঠনের লোকদেরকে বলতে চাই—মুফতিরা, আলেমরা, বক্তারা এবং শিক্ষকরা আপনাদের সংগঠনের সদস্য হোক, তা যদি আপনাদের আগ্রহের বিষয় না হয়ে থাকে, তবে আপনারা আসলে কাদেরকে সদস্য করতে আগ্রহী? একদল ডাকাতকে? একদল মূর্খকে? একদল চোরকে? ফিৎনা-ফাসাদ ও অনিষ্ট সৃষ্টিকারীদেরকে? এদেরকে নিয়ে আপনারা উম্মাহর নেতৃত্ব দেবেন? আল্লাহর হুকুম কায়েম করবেন? এদের সাহায্যে মুসলিম সমাজ নির্মাণ করবেন?
হিজবুত তাহরীর আরো বলেছে—
“নিশ্চয়ই হিজবুত তাহরীর মূলগতভাবে একটি ইসলামী সংগঠন। তবে অপরাপর ইসলামী দলগুলোর মত সাধারণ কোনো ইসলামী সংগঠন নয়। হিজবুত তাহরীর মানুষকে ইসলাম শিক্ষা দেয় না। মুসলিমদেরকে ইসলামের দাওয়াত দেয় না। মানুষকে ইসলাম গ্রহণের উপদেশ দেয় না। কারণ, ইসলাম তো এ সংগঠনের কেবল উৎস, কর্মসূচি নয়। ইসলাম তাদের ভিত্তি, পরিচয় নয়।”
আরও বলা হচ্ছে-
“এ কারণে ইসলামী দাওয়াতে নিয়োজিত সংগঠনের অপরিহার্য দায়িত্ব হলো, নিজেকে একটি রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে দাঁড় করানো। আধ্যাত্মিকতা, চারিত্রিক উৎকর্ষ সাধন, আমল-আখলাক, শিক্ষা-দীক্ষা বা এজাতীয় কোনো কিছু দিয়ে নিজের কাঠামোকে সাজানো উচিত নয়। বরং অপরিহার্য হলো, কেবল রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা। আর এ কারণেই হিজবুত তাহরীর— যা একটি ইসলামী সংগঠন—একটি রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে সর্বতোভাবে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত থাকে।”
হে হিজবুত তাহরীরের ভাইয়েরা! মানুষকে যদি আপনারা ইসলাম শিক্ষা না-ই দেন, মানুষের কাছে যদি আল্লাহর দ্বীনের দাওয়াত না-ই পৌঁছান, আমর বিল মারুফ তথা সৎ কাজের আদেশ যদি না-ই করেন, নাহি আনিল মুনকার' তথা অসৎ কাজ থেকে বারণ যদি না-ই করেন, আপনাদের দলের সদস্যদের এবং সাধারণভাবে সকল মুসলিমের আত্মশুদ্ধির চিন্তা যদি আপনাদের মাঝে আসলেই না থাকে, চারিত্রিক উৎকর্ষ সাধনে, মানুষকে তার অনুশীলন ও প্রশিক্ষণ প্রদানে যদি আপনারা নিয়োজিত না হোন, তবে তো আপনাদের ব্যাপারে এমনটাই বলা শোভা পায় যে, আপনারা একটি সেক্যুলার সংগঠনের সদস্য...যারা কেবল ইসলামকে একটি রাজনৈতিক মতবাদ হিসেবে গ্রহণ করেছে।
আল্লাহর দ্বীনের জন্য কাজ করা যদি আপনাদের কর্মসূচিতে না থাকে, আপনাদের বৈশিষ্ট্যের অন্তর্ভুক্ত না হয়, ইসলাম যদি আপনাদের পরিচয় না হয়, তবে আপনাদের সঙ্গে ইসলামের সম্পর্ক কী আর ইসলামের সঙ্গেই বা আপনাদের সম্পর্ক কী?
(আবু উবাইদা আল কুরাইশি রহ. এর রচনা থেকে গৃহীত, পরিমার্জিত)