আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআলা বলেন:

هُوَ الَّذِیۡۤ اَرۡسَلَ رَسُوۡلَهٗ بِالۡهُدٰی وَ دِیۡنِ الۡحَقِّ لِیُظۡهِرَهٗ عَلَی الدِّیۡنِ کُلِّهٖ ۙ وَ لَوۡ کَرِهَ الۡمُشۡرِکُوۡنَ ٠

তিনিই (আল্লাহ তায়ালা) তাঁর রসূলকে হিদায়াত ও সত্য দীন সহকারে প্রেরণ করেছেন তাঁর দীনকে অন্য সকল দীনের উপর বিজয়ী করার জন্যেই, যদিও কাফির- মুশরিকরা তা অপছন্দ করে। 

[সূরাহ আল বারাআহ্/আত তাওবাহ্:৩৩]

আল্লাহর মনোনীত এই দীন প্রতিষ্ঠা ও বিজয়ী করার লক্ষ্যেই খিলাফাহ্ অর্জন করা আবশ্যক। আল্লাহ তায়ালা মুমিন ও সৎকর্মশীলদের সাথে এ খিলাফাহরই ওয়াদা করেছেন। তিনি বলেন:

وَعَدَ اللّٰهُ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا مِنۡکُمۡ وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ لَیَسۡتَخۡلِفَنَّهُمۡ فِی الۡاَرۡضِ کَمَا اسۡتَخۡلَفَ الَّذِیۡنَ مِنۡ قَبۡلِهِمۡ ۪ وَ لَیُمَکِّنَنَّ لَهُمۡ دِیۡنَهُمُ الَّذِی ارۡتَضٰی لَهُمۡ وَ لَیُبَدِّلَنَّهُمۡ مِّنۡۢ بَعۡدِ خَوۡفِهِمۡ اَمۡنًا ؕ یَعۡبُدُوۡنَنِیۡ لَا یُشۡرِکُوۡنَ بِیۡ شَیۡئًا ؕ وَ مَنۡ کَفَرَ بَعۡدَ ذٰلِکَ فَاُولٰٓئِکَ 

هُمُ الۡفٰسِقُوۡنَ ٠ 

তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান আনে এবং সৎকর্মসমূহ সম্পাদন করে আল্লাহ তাদেরকে এ মর্মে ওয়াদা দিয়েছেন যে, তিনি নিশ্চিতভাবে তাদেরকে পৃথিবীর (খিলাফাহ্ বা) কর্তৃত্ব ও প্রতিনিধিত্ব দান করবেন, যেমন তিনি প্রতিনিধিত্ব দান করেছিলেন তাদের পূর্ববর্তীদেরকে এবং তিনি অবশ্যই তাদের জন্য শক্তিশালী ও সুপ্রতিষ্ঠিত করবেন তাদের দীনকে, যা তিনি তাদের জন্য মনোনীত করেছেন এবং তিনি তাদের ভয়-ভীতিকে শান্তি-নিরাপত্তায় পরিবর্তিত করে দিবেন। তারা আমারই ইবাদাত করবে, আমার সাথে কোন কিছুকে শরীক করবে না। আর এরপরও যারা কুফরী করবে তারাই ফাসিক।

[সূরাহ আন নূর:৫৫]

এ পুস্তিকায় আমাদের মূল আলোচ্য বিষয় - খিলাফাহ্ ও খলীফাহ্---। 

আমরা এখানে খিলাফাহর পরিচয়, কাঙ্ক্ষিত ও প্রতিশ্রুত খিলাফাহর স্বরূপ এবং সংশ্লিষ্ট শারঈ আহকাম ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা করবো, ইনশাআল্লাহ। 

তবে খিলাফাহ্ সম্পর্কিত মূল আলোচনায় প্রবেশের আগে আমাদের কয়েকটি বিষয় স্মরণ রাখতে হবে, ইনশাআল্লাহ; আর তা হলো:

১. আল্লাহ তায়ালা মুমিন ও সলিহীন তথা সৎকর্মশীলদের জন্য যে খিলাফাহর ওয়াদা করেছেন তা তিনি দান করেছিলেন। প্রথমদিকে ছিল এর স্বর্ণযুগ। তারপর পর্যায়ক্রমে তার মান নিম্নগামী হয়। এরপর তা দুর্বল হতে থাকে। অবশেষে তা সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হয়।

২. এটা স্পষ্ট যে, উম্মাহ্ কয়েক প্রজন্ম যাবৎ খিলাফাহ্ বিহীন অবস্থায় আছে। এখনও তা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। অর্থাৎ খিলাফাহ্ বলতে যা বুঝায় তা এখন পৃথিবীতে নেই। তবে তা অর্জনের প্রচেষ্টা চলছে। আল্লাহ্ তায়ালা তা দান করবেন যোগ্য মুমিন ও সৎকর্মশীলগণকে।

৩. আল্লাহ তায়ালার কালিমাহ্ বা দীনকে বিজয়ী করার প্রচেষ্টায় নিয়োজিত মুমিন-মুজাহিদগণের মাঝে খিলাফাহ্, খলীফাহ্... ইত্যাদি শব্দ ও পরিভাষা বেশ পরিচিত ও আলোচিত। আবার বিশেষ কোন প্রেক্ষিতে এ বিষয়ে আলোচনা বৃদ্ধি পায়---। [যেমন, কয়েক বছর আগে দাওলাতুল ইরাক কর্তৃক কথিত খিলাফাহ্ ঘোষণার প্রেক্ষিতেও এ নিয়ে অনেক আলোচনা চলছে।] 

বস্তুত এটা সহ দীনের সকল বিষয়েই আমাদের মাঝে আলোচনা-পর্যালোচনা চলতে থাকবে যতক্ষণ তার প্রয়োজনীয়তা ও উপযোগিতা থাকবে, ইনশাআল্লাহ।  

আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে দীনের যথাযথ উপলব্ধি ও আমল করার তাওফীক দান করুন। 

৪. এ প্রবন্ধে খিলাফাহ্ সম্পর্কে সে সব আলোচনাও আছে যা সাধারণত বিভিন্ন বইতে সংক্ষেপে উল্লেখ করা হয়েছে, বিস্তারিত আলোচনা করা হয়নি। আল্লাহর ইচ্ছায় আমরা সেগুলো কিছুটা বিস্তারিত ও সাজিয়ে-গুছিয়ে উল্লেখ করার চেষ্টা করছি। এর কিছু কারণ, প্রয়োজনীয়তা ও উপযোগিতা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, আর তা হলো: 

ক. 

দীনের অনেক বিষয়ে বর্তমানে যেরূপ বিস্তারিত মাসাইল ও আহকামের ফিকহী আলোচনা বা বর্ণনার অস্তিত্ব ও প্রয়োজনীয়তা আমরা দেখছি তা ইসলামের প্রথমযুগে ছিল না। কেননা - ঈমান, ইলম, আমল, মেধা, যোগ্যতা, দক্ষতা ইত্যাদি সকল দিক থেকে সাহাবায়ে কিরাম (রাঃ) ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ। আল্লাহর বাণী ও তাঁর রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কথা, কর্ম ও সম্মতি তথা দীনের প্রতিটি বিষয়ের প্রকৃত স্বরূপ, তাৎপর্য ও আকাঙ্ক্ষা তাঁরা সহজেই উপলব্ধি করে তা আমলে বাস্তবায়ন করতে পারতেন এবং করতেন। তখন তাঁদের জন্য অনেক বিষয়ে এত বিস্তারিত ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয়নি। যেহেতু তাঁদের সময় ওহী নাযিল হত এবং রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সংস্পর্শে থাকায় হিদায়াতের আলোর প্রতিফলন ও এর প্রত্যক্ষ প্রভাব তাঁদের উপর ছিল। কিন্তু এর পরের যুগে আগত মানুষের পক্ষে ঐ প্রত্যক্ষ নূরের সরাসরি প্রতিফলন পাওয়া সম্ভব নয়। তাছাড়া পরবর্তী প্রতি যুগেই ক্রমান্বয়ে মানুষের ঈমান, ইলম, মেধা ও যোগ্যতা কমতে থাকে। ফলে উত্তম যুগের পর যারা যত পরে এসেছে তাদের জন্য ততবেশি ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ, আলোচনা জরুরি হয়েছে এবং হচ্ছে। আর এটা কেবল এক-দুটি বিষয়ে হচ্ছে না। বরং দীনের সকল বিষয়েই এরূপ দেখা যায়। একটু লক্ষ্য করলেই বিষয়টি স্পষ্ট হবে, ইনশাআল্লাহ। 

যেমন, রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীগণ (রাঃ)-কে আল কুরআনের তাফসীর বুঝিয়ে দিয়েছেন। এজন্য অনেক বেশি আলোচনার প্রয়োজন হয়নি। 

তারপর সাহাবীগণ (রাঃ) তাবিয়ীগণ (রহঃ)-কে তা আরেকটু বিস্তারিত আকারে উপস্থাপন করেছেন। আবার এর পরের যুগে আরেকটু বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। আর এখন তো ঐ তাফসীরেরও তাফসীর করতে হয় বর্তমান যুগের মানুষকে বুঝানোর জন্য। এজন্য কত আলোচনা, ওয়াজ-নাসীহাত ইত্যাদি করতে হয়---। তারপরেও অনেক কিছু আমরা বুঝতে বা বুঝাতে পারি না। 

দেখুন, সাহাবীগণ (রাঃ)-এর নিকট রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদীস তথা কথা-কর্ম-সম্মতিই ছিল (আল কুরআনের) ব্যাখ্যা। তার পরের যুগসমূহে ঐ হাদীসের আরো বিস্তারিত ব্যাখ্যা করা হয়েছে। আর এখন তো ঐসব ব্যাখ্যারও (আরো বিস্তারিত) ব্যাখ্যা সংকলিত হচ্ছে। এভাবে হয়তো পরবর্তীদের জন্য আরো বিস্তারিত আলোচনা প্রয়োজন হবে। তবে এজন্য যে উসূল বা মূলনীতি আছে তা অক্ষুণ্ণ রেখে এক্ষেত্রেও যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে, ইনশাআল্লাহ। 

ইমাম বুখারী (রহঃ) সহীহ্ বুখারীর কিতাবুল ইলমে একটি অনুচ্ছেদে (বাব) নিম্নরূপ উল্লেখ করেছেন:

العلم قبل القول والعمل٠٠٠

কথা ও আমলের পূর্বে ইলম জরুরী।

আল্লাহ তা’আলার বাণী: 

فَاعْلَمْ أَنَّهُ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ 

সুতরাং জেনে রাখ, আল্লাহ ব্যতীত প্রকৃত কোন উপাস্য নেই। (৪৭:১৯)। 

এখানে আল্লাহ তা’আলা ইলমের কথা আগে বলেছেন। 

আর, আলিমগণই নবীগণের ওয়ারিস। তারা ইলমের ওয়ারিস হয়েছেন। তাই যে ইলম হাসিল করেছে সে বিরাট/পূর্ণ অংশ লাভ করেছে। আর যে ব্যক্তি ইলম হাসিলের উদ্দেশ্যে পথ চলে, আল্লাহ তা’আলা তার জন্য জান্নাতের পথ সহজ করে দেন।

[সহীহ্ আল বুখারী:কিতাবুল ইলম]

খ.

সহীহ্ হাদীস থেকে আমরা নিশ্চিতভাবে জানতে পারি, সুনানু আবি দাউদে বর্ণিত আছে:

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، فِيمَا أَعْلَمُ عَنْ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ:‏ إِنَّ اللَّهَ يَبْعَثُ لِهَذِهِ الأُمَّةِ عَلَى رَأْسِ كُلِّ مِائَةِ سَنَةٍ مَنْ يُجَدِّدُ لَهَا دِينَهَا ‏٠ ‏

আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: নিশ্চয়ই আল্লাহ এই উম্মাতের জন্য প্রতি একশত বছরের মাথায় এমন লোকের আর্বিভাব ঘটাবেন যিনি এই উম্মাহর জন্য তাদের দ্বীনকে পুনর্জীবিত/সঞ্জীবিত করবেন বা নতুন করে পেশ করবেন ।

[আবু দাউদ: যুদ্ধ-সংঘর্ষ (كتاب الملاحم)]

ইমামগণ বলেছেন: দীনকে নতুন করে পেশ করার অর্থ হলো, (পরবর্তী) বিভিন্ন সময় দীনের (শিক্ষা ও আমলের) মধ্যে বিকৃতি, অতিরঞ্জন ইত্যাদি থেকে দীনকে মুক্ত করা এবং বাতিলের মোকাবিলা করা (এভাবে দীনের প্রকৃত নির্দেশনা এবং আকাঙ্ক্ষাকে মানুষের কাছে স্পষ্টরূপে উপস্থাপন করা)। 

[দ্রঃ ইবনু কাসীর : আল বিদায়াহ্ ওয়ান নিহায়াহ্] 

প্রতি যুগের আলিমগণই তাঁদের ছাত্র ও পরবর্তীদের জন্য যে বিশেষ ব্যাখ্যা ও পর্যালোচনা তুলে ধরেছেন তার আরেকটি কারণ হলো, সমসাময়িক ও অন্যান্য বাতিল চিন্তা বা মতাদর্শের উত্থান ও পারিপার্শ্বিক প্রভাবে মানবীয় চিন্তা ও প্রবৃত্তির অনুসরণের চর্চা উম্মাহর (অনেকের) মাঝে দৃশ্যমান হয়। 

যেমন, সাহাবীগণের পরবর্তী যুগে বহু বাতিল আক্বীদাহ্-চিন্তা-দর্শন মুসলিম সমাজে অনুপ্রবেশ করে। তা দূর করে ইসলামী আক্বীদাহ্কে স্পষ্ট করতে ইমামগণ আক্বীদাহ্ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তার উপর ভিত্তি করে বর্তমানেও আরো বিস্তারিত আলোচনা অনেক বিষয়ে করতে হচ্ছে। ঈমান-আকীদাহ সম্পর্কে এবং সলাত সহ অন্যান্য বিষয়ে সংকলিত হাজারো বই-পুস্তকই এর দৃষ্টান্ত। আকীদাহর সাথে সংশ্লিষ্ট কোন বিষয়ে কোন যুগে কোন জনগোষ্ঠীর কোন প্রকার ভুলের আশংকা যখনই দেখা দিয়েছে তখনই যোগ্য আলিমগণ ঐ ভুলকে ভুল প্রমাণ করে প্রকৃত সত্য ও সঠিক বিষয়টি বিস্তারিত আলোচনার মাধ্যমে স্পষ্ট করে দিয়েছেন।

এ বিষয়টি আরো বিভিন্ন হাদীস থেকে আমরা জানতে পারি, যেমন সহীহ্ আল বুখারীতে বর্ণিত আছে: 

بَاب قَوْلِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لاَ تَزَالُ طَائِفَةٌ مِنْ أُمَّتِي ظَاهِرِينَ عَلَى الْحَقِّ وَهُمْ أَهْلُ الْعِلْمِ ٠

 عَنْ الْمُغِيرَةِ بْنِ شُعْبَةَ عَنْ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ لاَ يَزَالُ طَائِفَةٌ مِنْ أُمَّتِي ظَاهِرِينَ حَتَّى يَأْتِيَهُمْ أَمْرُ اللهِ وَهُمْ ظَاهِرُونَ ٠

পরিচ্ছেদ: নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণী: আমার উম্মাতের মধ্যে এক দল সর্বদাই হকের উপর প্রতিষ্ঠিত  থাকবেন--- আর তাঁরা হলেন (দ্বীনী) ইলমের অধিকারী আলিমগণ।

মুগীরাহ ইবনু শু’বাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: কিয়ামত আসা পর্যন্ত আমার উম্মাতের এক দল সর্বদাই সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে, আর তাঁরাই বিজয়ী।

[সহীহ্ আল বুখারী: অধ্যায়-কুরআন ও সুন্নাহকে দৃঢ়ভাবে ধরে থাকা]

ইমাম নাবাবী (রহঃ) এবং ইবনু হাজার আসকালানী (রহঃ) সহ অন্য ইমামগণ এ হাদীসের ব্যাখ্যায় উম্মাহর ইমাম, আলিম, মুজাহিদ, যাহিদগণকে এ দলের অন্তর্ভুক্ত বলে উল্লেখ করেছেন, যারা দীন ও উম্মাহর কল্যাণে নিয়োজিত থাকেন, তাদেরকে সৎপথে পরিচালনার চেষ্টা করেন। তাঁরা বিভিন্ন যুগে/সময়ে এবং বিভিন্ন স্থানে থাকবেন---। 

তবে ইমাম বুখারী (রহঃ) এ অধ্যায়ে এ দলের ব্যাপারে বলেছেন: তারা হলেন, আহলুল ইলম বা দীনী ইলমের ধারক-বাহক তথা প্রকৃত আলিমগণ। 

মূলত তিনি এর পরে উল্লিখিত হাদীস দ্বারাই এ কথার দালীল গ্রহণ করেছেন, তা হলো:

عَنْ ابْنِ شِهَابٍ أَخْبَرَنِي حُمَيْدٌ قَالَ سَمِعْتُ مُعَاوِيَةَ بْنَ أَبِي سُفْيَانَ يَخْطُبُ قَالَ سَمِعْتُ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ مَنْ يُرِدْ اللهُ بِهِ خَيْرًا يُفَقِّهْهُ فِي الدِّينِ وَإِنَّمَا أَنَا قَاسِمٌ وَيُعْطِي اللهُ وَلَنْ يَزَالَ أَمْرُ هَذِهِ الْأُمَّةِ مُسْتَقِيمًا حَتَّى تَقُومَ السَّاعَةُ أَوْ حَتَّى يَأْتِيَ أَمْرُ اللهِ ٠

মুআবিয়া ইবনু আবূ সুফইয়ান (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি যে, আল্লাহ্ যার কল্যাণ চান, তাকে দ্বীনের জ্ঞান দান করেন। আর আমি বণ্টনকারী মাত্র; আল্লাহ্ই দান করে থাকেন। এ উম্মাতের কার্যকলাপ ক্বিয়ামাত (কিয়ামত) অবধি কিংবা বলেছিলেন, মহান আল্লাহ্ তা’আলার হুকুম আসা পর্যন্ত সুপ্রতিষ্ঠিত থাকবে।

[সহীহ্ আল বুখারী:অধ্যায়-কুরআন ও সুন্নাহকে শক্তভাবে ধরে থাকা] 

 

শুধু ঈমান আকীদাহ্ নয়, বরং সলাত, সওম, যাকাত, হাজ্জ, জিহাদ এবং দীনের প্রায় সকল বিষয়ে পৃথক পৃথক গ্রন্থ প্রথমে ছিল না। তারপর উম্মাহর পরবর্তী যুগসমূহে তার বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন হয়েছে। আর এখন তো ঐ বিস্তারিত কিতাবও আবার বুঝিয়ে দিতে হয়। অর্থাৎ প্রত্যেক যুগের মানুষের জন্য উপযোগী ইলমী আলোচনার ধারাবাহিকতা বজায় আছে।   

এটা যে বিচ্ছিন্ন কিছু মানুষ করেন তা নয়। বরং এজন্য হাজার হাজার মাদ্রাসা ও দীনী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লক্ষ লক্ষ আলিম ও উস্তাদ নিয়মিত দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। 

সুতরাং এ বিষয়টি আমাদের নিকট পরিষ্কার যে, যারা সর্বোত্তম যুগের যত নিকটবর্তী তাদের এসব বিষয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যার প্রয়োজন তত কম। আর যারা যত দূরবর্তী ও পরের তাদের জন্য বিস্তারিত আলোচনা ও ব্যাখ্যার প্রয়োজন তত বেশি।

 

গ.

একইভাবে খিলাফাহ্-খলীফাহ্ বিষয়ে আল কুরআন ও হাদীসে বর্ণিত মূল বাণীসমূহ ইসলামের স্বর্ণযুগের মুসলিমগণ তথা সাহাবীগণ (রাঃ) যথাযথ অনুধাবন ও আমল করেছেন। তার পরের যুগসমূহে একটু একটু করে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মাধ্যমে মাসাইল ও আহকাম সংকলিত হতে থাকে। আলহামদুলিল্লাহ, এ বিষয়ে বহু উপকারী কিতাব ইমামগণ সংকলন করেছেন। 

আমাদেরকে ঐসব সংকলিত কিতাবের উপর নির্ভর করেই বর্তমান যুগের মানুষের অনুধাবনের জন্য বিস্তারিত আলোচনা করতে হয়। তবে এক্ষেত্রে স্মরণ রাখতে হবে যে, যখন ইমামগণ ঐসব কিতাব সংকলন করেছেন সেই সময়ের সাথে বর্তমান সময়ের উল্লেখযোগ্য পার্থক্য আছে। তন্মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ (পার্থক্য) হলো, তখন খিলাফাহ্ প্রতিষ্ঠিত ছিল এবং তার বাস্তব রূপ সকলের সামনেই (স্পষ্ট) ছিল। বিধায় তাদের জন্য,এমনকি তাদের সময়ের সাধারণ মানুষের জন্যেও এ আলোচনার প্রয়োজন ছিল না যে, খিলাফাহর বাস্তব রূপ কী?...ইত্যাদি। 

বরং তখন শুধু খিলাফাহ্, খলীফাহ্, খিলাফাহ্ ব্যবস্থাপনা, পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ ইত্যাদি সম্পর্কিত বিস্তারিত মাসাইল ও আহকামের আলোচনাই তাদের জন্য প্রয়োজন ছিল। আর এর স্পষ্ট সমাধানও তাদের কাছে ছিল। তাদের জন্য এ বিষয়ে এটাই ছিল প্রধান আলোচনা।

কিন্তু সহস্র বছর পর তথা খিলাফাহ্ বিলুপ্ত হওয়ার পর বর্তমানে আমাদের সামনে খিলাফাহর বাস্তব রূপ সামনে না থাকায় হঠাৎ কেউ কোন এলাকায় কিছু ভূমি, ক্ষমতা বা কর্তৃত্ব পেয়েই খিলাফাহ্, খলীফাহ্ ইত্যাদি দাবি করে বসে! ফলে উম্মাহর মাঝে এ নিয়ে ব্যাপক সমস্যা, বিশৃঙ্খলা, দলাদলি দেখা দেয় ; ফলে প্রকৃত কর্তব্য পালনে ব্যাঘাত সৃষ্টি হয় এবং কাজের কাজ কিছুই হয় না। সুতরাং এরূপ সমস্যার সমাধান ও যে কোন মন্দ আশংকা ইত্যাদি  প্রতিরোধকল্পে এবং কাঙ্ক্ষিত সফলতা অর্জনের লক্ষ্যে এ সম্পর্কে সামগ্রিক জ্ঞানার্জন করে তা সকলের কাছে স্পষ্ট করা জরুরি। সুতরাং আমাদের এ সম্পর্কে প্রধান আলোচ্য বিষয় হলো: 

খিলাফাহ্ বলতে কী বুঝায়? খিলাফাহর বাস্তব রূপটা কী,যা আগে ছিল কিন্তু এখন নেই? এবং 

খিলাফাহ্ অর্জন করার প্রকৃত চিন্তা ও উপায় কী?... ইত্যাদি। 

এটা অর্জন করার পরে এর পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ঐ সংকলিত মাসাইল, আহকাম সঠিকভাবে প্রয়োগের বিষয়গুলো আসবে, ইনশাআল্লাহ। 

[উল্লেখ্য, খিলাফাহ্ অর্জনের পরেই তা পরিচালনার জন্য ঐ সকল বিষয় প্রয়োজন হবে, তবে এ সম্পর্কিত সামগ্রিক ইলম (অন্তত সংশ্লিষ্ট কিছু ভাইকে) পূর্বেই অর্জন করতে হবে। আমরা এখানে পদক্ষেপ গ্রহণের ব্যাপারে বলছি যে, আগে খিলাফাহ্ অর্জনের বিষয়টি স্পষ্ট নির্ধারণ ও প্রয়োগ  করা কর্তব্য, তারপর তা পরিচালনা সম্পর্কিত বিষয়সমূহ প্রয়োগ করতে হবে, ইনশাআল্লাহ।]

সুতরাং সঙ্গত কারণেই তখন এ সম্পর্কে এত বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন তাদের ছিল না যে - খিলাফাহ্ এবং এর বাস্তব রূপ কী? ... ইত্যাদি। বরং তখন তাদের সামনে খিলাফাহ্ প্রতিষ্ঠিত ছিল বিধায় তাদের সামনে থাকা বাস্তব সক্ষমতা অনুযায়ী তারা আমল করতেন। আর উক্ত বিদ্যমান খিলাফাহর আলোচনা তাফসীর, হাদীস ও ইতিহাসে বর্ণিত আছে। 

সুতরাং পূর্ববর্তীদেরকে অনেক বিষয় এত বিস্তারিত আলোচনা করে বুঝতে হয়নি - যা বুঝতে আমাদের অনেক পড়াশোনা, আলোচনা ও গবেষণার প্রয়োজন হয়। 

আলহামদুলিল্লাহ, যারা খিলাফাহ্ অর্জনের প্রচেষ্টায় নিয়োজিত তাদের অনেকের এই উপলব্ধি আছে। অবশ্য তাদের অধিকাংশ এর বিস্তারিত আলোচনায় লিপ্ত হন না...এতে সমস্যা নেই। কেননা সকলের জন্য এতো বিস্তারিত আলোচনা জরুরি নয়। তবে যারা এ পথে কাজ করেন তাদের (অন্তত) এই উপলব্ধি থাকতে হবে - 

🫶 খিলাফাহর বাস্তব রূপ কী, যা এখনও আমরা অর্জন করতে পারিনি বরং অর্জন করতে হবে?  

🫶 সেই খিলাফাহ্ কোনটি যার ওয়াদা আল্লাহ তায়ালা করেছেন মুমিন ও সৎকর্মশীলদের সাথে?

🫶 আমরা কি আমাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য স্থির/নির্ণয় করতে পেরেছি?... ইত্যাদি। 

এটা স্মরণীয় যে, আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক যুগের মানুষের দীনী-ইলমী কল্যাণের জন্য ঐ যুগের উপযোগী জ্ঞানী, জ্ঞান ও সংশ্লিষ্ট উপায় উপকরণ দান করেন, যার সহায়তায় উম্মাহ্ প্রয়োজনীয় বিষয় জানতে, বুঝতে ও মানতে পারে। 

এরই ধারাবাহিকতায় দীনের অন্যান্য বিষয়ের মত খিলাফাহ্ বিষয়েও বর্তমান যুগের মানুষের অনুধাবনের উপযোগী আলোচনা পর্যালোচনা চলছে। আল্লাহ তায়ালার অনুগ্রহে উম্মাহর (অপেক্ষাকৃত) জ্ঞানী ও যোগ্য ব্যক্তিগণের সহায়তা নিয়ে বাকি সবাই এই বিষয়েও জ্ঞানার্জন করতে পারেন। কেননা, আল্লাহ তায়ালা নির্দেশ দিয়েছেন:

فَاسۡـَٔلُوۡۤا اَهۡلَ الذِّکۡرِ اِنۡ کُنۡتُمۡ لَا تَعۡلَمُوۡنَ ۰... 

...যদি তোমাদের ইলম না থাকে তবে আহলুয যিকর তথা জ্ঞানীদের কাছে প্রশ্ন করে জেনে নাও। 

[সূরা আন নাহল:৪৩]

আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন :

وَ لَا تَقۡفُ مَا لَیۡسَ لَکَ بِهٖ عِلۡمٌ ؕ اِنَّ السَّمۡعَ وَ الۡبَصَرَ وَ الۡفُؤَادَ کُلُّ اُولٰٓئِکَ کَانَ عَنۡهُ مَسۡـُٔوۡلًا ٠

আর যে বিষয় তোমার ইলম নাই তার অনুসরণ করো না। নিশ্চয় কান, চোখ ও অন্তকরণ - এর প্রতিটির ব্যাপারেই জবাবদিহি করা হবে। 

[সূরাহ আল ইসরা/বানী ইসরঈল:৩৬]

উমার ইবনু আব্দিল আযীয (রহঃ) বলেন: ইলম ছাড়া আমল তোমার যতটা উপকার বা সংশোধন করবে তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতি করবে। 

[দ্রঃ ইবনু কাসীর প্রণীত আল বিদায়াহ্ ওয়ান নিহায়াহ্: উমার ইবনু আব্দিল আযীয (রহঃ)-এর জীবনী]

এটাও স্মরণ রাখা জরুরি যে, দীনের কোন বিষয়ে কিছু দালীল, কয়েকটি আয়াত-হাদীস জানা বা মুখস্ত থাকলেই উক্ত বিষয়ের প্রকৃত উপলব্ধি ও যথাযথ আমল করা সম্ভব নয়। বরং দীনের প্রতিটি বিষয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট সকল দালীল, আয়াত ও হাদীসের জ্ঞান এবং এ সকল দালীলের যথাযথ প্রয়োগ করার দালীলসহ শারঈ হুকুম-আহকামের ইলম অর্জন করা জরুরি। উম্মাহর মাঝে প্রত্যেক যুগে অন্ততপক্ষে কিছু সংখ্যক এরূপ আলিম থাকেন, তারা শুধু ইলম বহন (মুখস্ত) করেন না; বরং ইলমের যথাযথ উপলব্ধি ও তা প্রয়োগ করার জ্ঞানও আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে দান করেছেন, আলহামদুলিল্লাহ। তাদের সম্পর্কেই হাদীসে বলা হয়েছ:

عَنْ زَيْدِ بْنِ ثَابِتٍ، قَالَ: سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: نَضَّرَ اللَّهُ امْرَأً سَمِعَ مِنَّا حَدِيثًا، فَحَفِظَهُ حَتَّى يُبَلِّغَهُ، فَرُبَّ حَامِلِ فِقْهٍ إِلَى مَنْ هُوَ أَفْقَهُ مِنْهُ، وَرُبَّ حَامِلِ فِقْهٍ لَيْسَ بِفَقِيهٍ ٠

যায়িদ ইবনু সাবিত (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি আমার নিকট থেকে হাদীস শুনে তা মুখস্থ রাখলো এবং অন্যের নিকট তা পৌঁছে দিলো, আল্লাহ তাকে চির উজ্জ্বল করে রাখবেন। কেননা, ফিকহ বা জ্ঞানের অনেক বাহক তার চেয়ে অধিক জ্ঞানী/সমঝদার লোকের নিকট তা বহন নিয়ে যায়; আর, ফিকহ্ বা জ্ঞানের অনেক বাহক নিজেরা ফাকীহ্ বা জ্ঞানী নয়।

[আবু দাউদ : কিতাবুল ইলম; এছাড়াও হাদীসটি তিরমিযী, নাসায়ী ও ইবনু মাজাহ-তে বর্ণিত আছে] 

সুতরাং তাদের সাথে সরাসরি আলোচনা করে, তাদের বক্তব্য শুনে ও বই পড়ে (সমন্বিতভাবে) উক্ত জ্ঞানার্জন করা সম্ভব। 

আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে উপকারী ইলম দান করুন, ইলমী বিষয় নিয়ে আলোচনার আগ্রহ বৃদ্ধি করে দিন।

আল কুরআন, তাফসীর, হাদীস ও পূর্ববর্তী ইমামগণের সংকলিত ফিকহ ও আহকামের কিতাব সমূহে বর্ণিত খিলাফাহর পরিচয়কে আরো বিস্তারিত ব্যাখ্যার মাধ্যমে (একটু) সহজভাবে উপস্থাপনের প্রয়োজনীয়তার তীব্রতা অনুভূত হয় বিভিন্ন সময়/বিভিন্ন কারণে, বিশেষতঃ যখন (হঠাৎ/মাঝে মধ্যে) কেউ খিলাফাহ্, খলীফাহ্, বাইয়াহ্ ইত্যাদি দাবি করে বসে কিংবা খিলাফাহ্-খলীফাহ্ ইত্যাদি শারঈ পরিভাষার অপপ্রয়োগ বা অপব্যবহার করে। 

গত কয়েক বছর যাবৎ এসব পরিভাষার  অপব্যবহারের বিষয়টি সামনে রেখে এসব দীনী পরিভাষার অপব্যবহার রোধকল্পে এবং প্রকৃত বিষয়টি উম্মাহর কাছে বোধগম্য করতে বিস্তারিত আলোচনা-পর্যালোচনার অংশ হিসেবে আমাদের আলোচ্য পুস্তিকা:

    🫶 খিলাফাহ্ ও খলীফাহ্ 🫶

আল্লাহ তায়ালা আমাদের আলোচনাকে উম্মাহর নিকট স্পষ্ট করে দিন; দীনের প্রতিটি শব্দ ও বাণীর সকল প্রকার অপপ্রয়োগ বন্ধ করে দিন এবং সঠিক ও যথাযথ প্রয়োগের যোগ্যতা আমাদেরকে দান করুন। 

এই পুস্তিকায় আমাদের আলোচ্য বিষয়:

🫶 খিলাফাহ্ ও খলীফাহর আভিধানিক অর্থ এবং আল কুরআন ও হাদীসে এসব শব্দের বহুমুখী ব্যবহার ও বিভিন্নরূপ অর্থ। 

🫶 খিলাফাহ্ ও খলীফাহর পারিভাষিক অর্থ, সংজ্ঞা, পরিচয় এবং সমার্থক অন্যান্য শব্দ ও পরিভাষা। 

🫶 আল কুরআন ও হাদীসে বর্ণিত মুমিন ও সৎকর্মশীলদের প্রতি আল্লাহ তায়ালার ওয়াদাকৃত খিলাফাহর স্বরূপ ও বৈশিষ্ট্য। 

🫶 খিলাফাহ্ ও খলীফাহ্ সংশ্লিষ্ট শারঈ হুকুম-আহকাম

🫶 খিলাফাহ্ ও খলীফাহ্ সংশ্লিষ্ট ভুল ধারণা বা বিভ্রান্তির অপনোদন। 

এ সকল বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা জরুরি। তবে এ পুস্তিকায় শুধু খিলাফাহ্ ও এর স্বরূপ সম্পর্কে কিছুটা বিস্তারিত আলোচনা করেছি। আর উল্লিখিত বাকি বিষয়সমূহে এ প্রবন্ধে সংক্ষেপে আলোচনা করেছি, আলহামদুলিল্লাহ।

[এ পুস্তিকায় উল্লিখিত প্রতিটি বিষয়ে যথাযথ দালীল উপস্থাপনের চেষ্টা করা হয়েছে, আলহামদুলিল্লাহ। আলোচনার সাথে   সংশ্লিষ্ট আয়াত ও অর্থ-অনুবাদের পরে সূরাহ ও আয়াত নম্বর উল্লেখ করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট হাদীস ও অর্থ-অনুবাদের পরে হাদীসগ্রন্থ ও অধ্যায়ের নাম উল্লেখ করা হয়েছে; তবে (বিভিন্ন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রকাশিত হাদীসের নম্বরের মধ্যে পার্থক্য আছে এবং আরো) কিছু যৌক্তিক কারণে উক্ত হাদীসের নম্বর উল্লেখ করা হয় নি।]                

এক.

খিলাফাহ্-খলীফাহর আভিধানিক অর্থ এবং আল কুরআন ও হাদীসে এসব শব্দের বহুমুখী ব্যবহার ও বিভিন্নরূপ অর্থ:

ক.

খিলাফাহ্ (خلافة) শব্দের বিভিন্নরূপ ব্যবহার ও অর্থ উল্লেখ করার আগে এর মূল শব্দ  

خلف এর বিভিন্ন অর্থ ও ব্যবহার উল্লেখ করছি।

খিলাফাহ্ (خلافة) শব্দটি এসেছে خلف শব্দমূল থেকে।

১. خَلٛف শব্দটি পিছন দিক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন আল্লাহ তায়ালার বাণী:

قَالَ فَبِمَا أَغْوَيْتَنِي لَأَقْعُدَنَّ لَهُمْ صِرَاطَكَ الْمُسْتَقِيمَ

ثُمَّ لَآَتِيَنَّهُمْ مِنْ بَيْنِ أَيْدِيهِمْ وَمِنْ خَلْفِهِمْ وَعَنْ أَيْمَانِهِمْ وَعَنْ شَمَائِلِهِمْ وَلَا تَجِدُ أَكْثَرَهُمْ شَاكِرِينَ٠

সে (শাইতন) বলল, আপনি আমাকে পথভ্রষ্ট করেছেন, সে কারণে অবশ্যই আমি তাদের (বিভ্রান্ত করার) জন্য আপনার সরল পথে বসে থাকব।

তারপর অবশ্যই তাদের নিকট উপস্থিত হবো, তাদের সামনে থেকে ও তাদের পেছন থেকে এবং তাদের ডান দিক থেকে ও তাদের বাম দিক থেকে; আপনি তাদের অধিকাংশকে কৃতজ্ঞ পাবেন না।

[সূরাহ আল আরাফ:১৬-১৭] 

এ আয়াত সমূহে ইবলীস/শাইতন কর্তৃক মানুষকে তাদের বিভিন্ন দিক থেকে বিভ্রান্ত করার প্রচেষ্টার ঘোষণা বর্ণিত আছে। 

আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে শাইতনের সকল বিভ্রান্তি থেকে হিফাজত করুন। 

আল্লাহ তায়ালা বলেন:

 لَهٗ مُعَقِّبٰتٌ مِّنۡۢ بَیۡنِ یَدَیۡهِ وَ مِنۡ خَلۡفِهٖ یَحۡفَظُوۡنَهٗ مِنۡ اَمۡرِ اللّٰهِ ؕ اِنَّ اللّٰهَ لَا یُغَیِّرُ مَا بِقَوۡمٍ حَتّٰی یُغَیِّرُوۡا مَا بِاَنۡفُسِهِمۡ ؕ وَ اِذَاۤ اَرَادَ اللّٰهُ بِقَوۡمٍ سُوۡٓءًا فَلَا مَرَدَّ لَهٗ ۚ وَ مَا لَهُمۡ مِّنۡ دُوۡنِهٖ مِنۡ وَّالٍ ۰

মানুষের জন্য রয়েছে সামনে ও পেছনে একের পর এক আগমনকারী প্রহরী, যারা আল্লাহর নির্দেশে তাকে হিফাযত করে। নিশ্চয় আল্লাহ কোন জাতির অবস্থা ততক্ষণ পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজেদের অবস্থা পরিবর্তন করে। আর যখন আল্লাহ কোন জাতির মন্দ চান, তখন তা প্রতিহত করার কেউ নেই এবং তাদের জন্য তিনি ছাড়া কোন অভিভাবক নেই।

[সূরাহ আর র'দ : ১১]

২. خَلٛف শব্দের অর্থ: পিছনে, পশ্চাতে, পরে---ইত্যাদি। 

আল কুরআনে সাধারণভাবে এরূপ অর্থে অনেক আয়াত এসেছে। যেমন:

--- يعلم ما بين ايديهم وما خلفهم--- 

---তিনি জানেন যা তাদের সামনে/আগে আছে এবং যা তাদের পিছনে/পরে আছে---।

[সূরাহ আল বাক্বারাহ:২৫৫]

আল্লাহ তায়ালা বলেন:

یَعۡلَمُ مَا بَیۡنَ اَیۡدِیۡهِمۡ وَ مَا خَلۡفَهُمۡ وَ لَا یُحِیۡطُوۡنَ بِهٖ عِلۡمًا ۰

অর্থাৎ, তিনি তাদের আগের ও পরের সব কিছুই জানেন; কিন্তু তারা জ্ঞান দিয়ে তাঁকে বেষ্টন করতে পারবে না।

[সূরাহ ত-হা: ১১০]

৩. আবার خِلٰفَ শব্দটি পরে/পরবর্তী--- ইত্যাদি অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন আল্লাহ তায়ালার বাণী:

  وَ اِنۡ کَادُوۡا لَیَسۡتَفِزُّوۡنَکَ مِنَ الۡاَرۡضِ لِیُخۡرِجُوۡکَ مِنۡهَا وَ اِذًا لَّا یَلۡبَثُوۡنَ خِلٰفَکَ اِلَّا قَلِیۡلًا ۰

তারা তোমাকে দেশ হতে উৎখাত করার চূড়ান্ত চেষ্টা করেছিল, তোমাকে সেখান হতে বহিস্কার করার জন্য। তাহলে তোমার পরে তারাও সেখানে অল্পকালই টিকে থাকত।

[সূরাহ আল ইসরা/বানী ইসরাঈল:৭৬]

অবশ্য, خِلٰفَ শব্দের অর্থ বিরোধিতাও হতে পারে। 

৪. আবার ًخِلٛفَة শব্দটির অর্থ: পিছনে- পিছনে, একটির পর একটি--- ইত্যাদি। 

যেমন আল্লাহ তায়ালার বাণী:

 وَ هُوَ الَّذِیۡ جَعَلَ الَّیۡلَ وَ النَّهَارَ خِلۡفَۃً لِّمَنۡ اَرَادَ اَنۡ یَّذَّکَّرَ اَوۡ اَرَادَ شُکُوۡرًا ۰

আর তিনিই রাত আর দিনকে করেছেন পরস্পরের অনুগামীরূপে (যারা একের পর এক আসে) তাদের জন্য যারা উপদেশ গ্রহণ করতে চায় কিংবা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে চায়।

[সূরাহ আল ফুরক্বন:৬২]

আবার 'খ' হরফে যবর ও 'লাম' হরফে জযম যোগে এবং 'লাম' হরফে যবর যোগেও خلف শব্দটি ব্যবহৃত হয়।

 

৫. 'খ' হরফে যবর এবং 'লাম' হরফে জযম যোগে خَلٛفُ শব্দটির অর্থ:

পিছন, পশ্চাৎভাগ, উত্তরাধিকারী, বংশধর, সন্তান-সন্ততি, পরবর্তী প্রজন্ম বা পরবর্তী প্রজন্মের লোক--- ইত্যাদি। 

৬. আবার 'খ' এবং 'লাম' হরফদ্বয়ে যবর যোগে خَلَفُ শব্দের অর্থ: উত্তরাধিকারী, সন্তান-সন্ততি, বংশধর, পরবর্তী প্রজন্মের লোক ইত্যাদি। 

অর্থাৎ উভয় শব্দের অর্থ প্রায় একই। তবে এদুটি শব্দের মাঝে একটা পার্থক্য আছে। তা হলো- 

'লাম' হরফে যবর যোগে خَلَفُ দ্বারা সাধারণভাবে ভাল উত্তরাধিকারী বুঝায়। 

যেমন আমরা বলে থাকি বহুল ব্যবহৃত শব্দ সালাফ (লাম হরফে যবর যোগে-سلف) অর্থাৎ যারা পূর্বসূরি হকপন্থী ও অনুসরণীয় ইমাম ও আলিমগণ। 

আর তাদেরই (পরবর্তী হকপন্থী) অনুসারীগণকে বলা হয় খলাফ (লাম হরফে যবর যোগে-خَلَفُ) অর্থাৎ পরবর্তী ইমাম ও আলিমগণ। 

আর 'লাম' হরফে জযম যোগে خَلٛفُ শব্দটি (বিশেষত) মন্দ উত্তরাধিকারী বুঝাতে ব্যবহৃত হয়। (যদিও কখনো এর ব্যতিক্রম ব্যবহার থাকা বা পাওয়া বিচিত্র নয়।)

নিম্নোক্ত আয়াতসমূহে এরূপ অর্থে (অর্থাৎ 'লাম' হরফে জযম যোগে خَلٛفُ শব্দটি মন্দ উত্তরাধিকারী বুঝাতে) ব্যবহৃত হয়েছে---।

আল্লাহ তায়ালা বলেন:

فَخَلَفَ مِنۡۢ بَعۡدِهِمۡ خَلۡفٌ وَّرِثُوا الۡکِتٰبَ یَاۡخُذُوۡنَ عَرَضَ هٰذَا الۡاَدۡنٰی وَ یَقُوۡلُوۡنَ سَیُغۡفَرُ لَنَا ۚ وَ اِنۡ یَّاۡتِهِمۡ عَرَضٌ مِّثۡلُهٗ یَاۡخُذُوۡهُ ؕ اَلَمۡ یُؤۡخَذۡ عَلَیۡهِمۡ مِّیۡثَاقُ الۡکِتٰبِ اَنۡ لَّا یَقُوۡلُوۡا عَلَی اللّٰهِ اِلَّا الۡحَقَّ وَ دَرَسُوۡا مَا فِیۡهِ ؕ وَ الدَّارُ الۡاٰخِرَۃُ خَیۡرٌ لِّلَّذِیۡنَ یَتَّقُوۡنَ ؕ اَفَلَا تَعۡقِلُوۡنَ ۰ 

অতঃপর অযোগ্য উত্তরপুরুষরা একের পর এক তাদের স্থলাভিষিক্তরূপে কিতাবের উত্তরাধিকারী হলো, তারা এই তুচ্ছ দুনিয়ার সামগ্রী গ্রহণ করে এবং বলে আমাদেরকে ক্ষমা করা হবে। কিন্তু এর অনুরূপ সামগ্রী তাদের নিকট আসলে তা-ও তারা গ্রহণ করে! তাদের কাছ থেকে কি কিতাবের অঙ্গীকার নেয়া হয়নি যে, তারা আল্লাহর ব্যাপারে সত্য ছাড়া বলবে না? আর তারা এতে যা আছে, তা পাঠ করেছে এবং আখিরাতের আবাস তাদের জন্য উত্তম যারা তাকওয়া অবলম্বন করে। তোমরা কি বুঝ না?  

[সূরাহ আল আ'রাফ: ১৬৯]।

৭. সাথে সাথে এর ক্রিয়া বাচক শব্দ হিসেবে خَلَفَ ব্যবহৃত হয়। এর অর্থ: পরে আসা, পরবর্তী হওয়া, প্রতিনিধিত্ব করা, উত্তরাধিকারী হওয়া, খলীফাহ্ হওয়া ইত্যাদি।

এর দৃষ্টান্ত উল্লেখ করছি, যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন:

فَخَلَفَ مِنۢ بَعْدِهِمْ خَلْفٌ أَضَاعُواْ ٱلصَّلَوٰةَ وَٱتَّبَعُواْ ٱلشَّهَوَٰتِ ۖ فَسَوْفَ يَلْقَوْنَ غَيًّا ۰

তাদের পরে আসল অপদার্থ পরবর্তীরা (অসৎ বংশধর) তারা সালাত বিনষ্ট করল এবং মন্দপ্রবৃত্তির অনুসরণ করল। সুতরাং শীঘ্রই তারা জাহান্নামের শাস্তি প্রত্যক্ষ করবে।

[সূরাহ মারইয়াম:৫৯]

এছাড়া হাদীসে কারো অনুপস্থিতিতে তার পরিবারের তত্ত্বাবধান বা দেখাশোনা করা অর্থে خَلَفَ শব্দটির ব্যবহার এসেছে:

عن زَيْدُ بْنُ خَالِدٍ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ مَنْ جَهَّزَ غَازِيًا فِيْ سَبِيْلِ اللهِ فَقَدْ غَزَا وَمَنْ خَلَفَ غَازِيًا فِيْ سَبِيْلِ اللهِ بِخَيْرٍ فَقَدْ غَزَا ٠

যায়দ ইবনু খালিদ (রাঃ) হতে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে জিহাদকারীর আসবাবপত্র সরবরাহ করল সে যেন জিহাদ করল। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে কোন জিহাদকারীর পরিবার-পরিজনকে (তার অনুপস্থিতিতে) উত্তমরূপে দেখাশোনা করল, সেও যেন জিহাদ করল।

[সহীহ্ আল বুখারী:কিতাবুল জিহাদি ওয়াস সিয়ার]

৮.যখন কেউ কারো পরে তার স্থলাভিষিক্ত হয় তখন তার ব্যাপারে আরবরা বলে থাকে:

 خلف فلان فلانا۰۰۰

অর্থাৎ, ওমুক ওমুকের স্থলাভিষিক্ত হয়েছে---।

[দ্রঃ তাফসীর ইবনে কাসীর ও অন্যান্য]

যেমন সহীহ্ আল বুখারীর হাদীসে এসেছে,

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

كَانَتْ بَنُوْ إِسْرَائِيْلَ تَسُوْسُهُمْ الأَنْبِيَاءُ كُلَّمَا هَلَكَ نَبِيٌّ خَلَفَهُ نَبِيٌّ وَإِنَّهُ لَا نَبِيَّ بَعْدِيْ وَسَيَكُوْنُ خُلَفَاءُ فَيَكْثُرُوْنَ قَالُوْا فَمَا تَأْمُرُنَا قَالَ فُوْا بِبَيْعَةِ الأَوَّلِ فَالأَوَّلِ أَعْطُوْهُمْ حَقَّهُمْ فَإِنَّ اللهَ سَائِلُهُمْ عَمَّا اسْتَرْعَاهُمْ ٠

(كتاب أحاديث الأنبياء:صحيح البخارى)

বনী ইসরাঈলের নাবীগণ (আঃ) তাঁদের উম্মাতের শাসনব্যবস্থা পরিচালনা করতেন। যখন কোন একজন নবী মৃত্যুবরণ করতেন, তখন অন্য একজন নবী তাঁর স্থলাভিষিক্ত হতেন। কিন্তু আমার পরে কোন নাবী নেই। তবে অনেক খলীফাহ্ হবে। সহাবীগণ (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি আমাদেরকে কী নির্দেশ করছেন? তিনি বললেন, তোমরা পর্যায়ক্রমে তাদের প্রথম জনের বাইআত পূর্ণ করবে। তোমাদের উপর তাদের যে হক রয়েছে তা আদায় করবে। আর নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তাদেরকে জিজ্ঞেস করবেন ঐ সকল বিষয়ে যে সবের দায়িত্ব তাদের উপর অর্পণ করা হয়েছিল।

[সহীহ্ আল বুখারী: কিতাবু আহাদীসিল আম্বিয়া; সহীহ্ মুসলিম---]

৯. কারো মৃত্যুর পরে তার বংশ থেকে তার পরিবারের স্থলাভিষিক্ত ব্যক্তি বা পরবর্তী অভিভাবক বুঝাতে এ শব্দের ব্যবহার করা হয়।

যেমন, রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক সাহাবীর (রাঃ) মৃত্যুর পরে তার জন্য দুআ করার সময় বলেন:

وَاخْلُفْهُ في عَقِبِهِ في الغَابِرِين۰۰۰...

---তার পরে তার পরিবার-বংশ থেকে তার প্রতিনিধি বা স্থলাভিষিক্ত মনোনীত করুন---।

[সহীহ্ মুসলিমের উক্ত হাদীস ও এতে বর্ণিত পূর্ণ দুআটি হল:

باب فِي إِغْمَاضِ الْمَيِّتِ وَالدُّعَاءِ لَهُ إِذَا حُضِرَ٠٠٠

حَدَّثَنِي زُهَيْرُ بْنُ حَرْبٍ، حَدَّثَنَا مُعَاوِيَةُ بْنُ عَمْرٍو، حَدَّثَنَا أَبُو إِسْحَاقَ الْفَزَارِيُّ، عَنْ خَالِدٍ الْحَذَّاءِ، عَنْ أَبِي قِلاَبَةَ، عَنْ قَبِيصَةَ بْنِ ذُؤَيْبٍ، عَنْ أُمِّ سَلَمَةَ، قَالَتْ دَخَلَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم عَلَى أَبِي سَلَمَةَ وَقَدْ شَقَّ بَصَرُهُ فَأَغْمَضَهُ ثُمَّ قَالَ ‏"‏ إِنَّ الرُّوحَ إِذَا قُبِضَ تَبِعَهُ الْبَصَرُ ‏"‏ ‏.‏ فَضَجَّ نَاسٌ مِنْ أَهْلِهِ فَقَالَ ‏"‏ لاَ تَدْعُوا عَلَى أَنْفُسِكُمْ إِلاَّ بِخَيْرٍ فَإِنَّ الْمَلاَئِكَةَ يُؤَمِّنُونَ عَلَى مَا تَقُولُونَ ‏"‏ ‏.‏ ثُمَّ قَالَ ‏"‏ اللَّهُمَّ اغْفِرْ لأَبِي سَلَمَةَ وَارْفَعْ دَرَجَتَهُ فِي الْمَهْدِيِّينَ وَاخْلُفْهُ فِي عَقِبِهِ فِي الْغَابِرِينَ وَاغْفِرْ لَنَا وَلَهُ يَا رَبَّ الْعَالَمِينَ وَافْسَحْ لَهُ فِي قَبْرِهِ  وَنَوِّرْ لَهُ فِيهِ ٠

পরিচ্ছেদ: মাইয়্যিতের (তথা মৃত ব্যক্তির) চোখের পাতা বন্ধ করা এবং মৃত্যু উপস্থিত হলে তার জন্য দুআ করা:

যুহায়র ইবনু হারব (রহঃ)--- উম্মু সালামাহ্ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবূ সালামাহকে দেখতে এলেন, তখন চোখ খোলা ছিল। তিনি তার চোখ বন্ধ করে দিলেন এবং বললেন, যখন রূহ কবয করা হয়, তখন চোখ তার অনুসরণ করে। আবূ সালামাহ এর পরিবারের লোকেরা কান্না শুরু করে দিল। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, তোমরা তোমাদের নিজেদের ব্যাপারে ভাল কথা ছাড়া কোন খারাপ কিছু বলাবলি করো না। কেননা, তোমরা যা কিছু বল তার স্বপক্ষে মালায়িকাহ (ফিরিশতাগণ) আমীন বলে থাকেন। এরপর তিনি এভাবে দু’আ করলেন, 'হে আল্লাহ! আবূ সালামাহ-কে ক্ষমা কর এবং হিদায়াতপ্রাপ্তদের মধ্যে তার মর্যাদাকে উঁচু করে দাও, তুমি তার বংশধরদের কাউকে তার পরিবারের অভিভাবক মনোনীত করো। হে রাব্বুল আলামীন তাকে ও আমাদেরকে ক্ষমা করে দাও। তার কবরকে প্রশস্ত কর এবং তা জ্যোতির্ময় করে দাও।'

(সহীহ্ মুসলিম: জানাযাহ অধ্যায়)---]

১০. কারো সাময়িক অনুপস্থিতিতে তার পক্ষ থেকে দায়িত্ব পালন বা প্রতিনিধিত্ব করা বুঝাতে এ শব্দের ব্যবহার এসেছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন:

 وَ وٰعَدۡنَا مُوۡسٰی ثَلٰثِیۡنَ لَیۡلَۃً وَّ اَتۡمَمۡنٰهَا بِعَشۡرٍ فَتَمَّ مِیۡقَاتُ رَبِّهٖۤ اَرۡبَعِیۡنَ لَیۡلَۃً ۚ وَ قَالَ مُوۡسٰی لِاَخِیۡهِ هٰرُوۡنَ اخۡلُفۡنِیۡ فِیۡ قَوۡمِیۡ وَ اَصۡلِحۡ وَ لَا تَتَّبِعۡ سَبِیۡلَ الۡمُفۡسِدِیۡنَ ۰

আমি মূসার জন্য (সিনাই পর্বতে) ত্রিশ রাত্রি নির্ধারণ করলাম। অতঃপর আরো দশ (বাড়িয়ে) দিয়ে (সেই সময়) পূর্ণ করলাম। এভাবে তার প্রতিপালকের নির্ধারিত চল্লিশ রাত্রি পূর্ণ হল। মূসা তার ভাই হারূনকে বলল, আমার অনুপস্থিতিতে আমার সম্প্রদায়ের মধ্যে তুমি আমার প্রতিনিধিত্ব কর এবং সংশোধন কর আর বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদের অনুসরণ করো না।

[সূরাহ আল আ'রাফ:১৪২]

এরপর মূসা (আঃ) তাঁর ভাই হারূন (আঃ এবং তার কওম)-কে উক্ত দায়িত্ব (প্রতিনিধিত্ব) সম্পর্কে জবাবদিহি করেন। 

আল্লাহ তায়ালা এবিষয়ে বলেন:

وَلَمَّا رَجَعَ مُوسَى إِلَى قَوْمِهِ غَضْبَانَ أَسِفًا قَالَ بِئْسَمَا خَلَفْتُمُونِي مِنْ بَعْدِي أَعَجِلْتُمْ أَمْرَ رَبِّكُمْ وَأَلْقَى الْأَلْوَاحَ وَأَخَذَ بِرَأْسِ أَخِيهِ يَجُرُّهُ إِلَيْهِ قَالَ ابْنَ أُمَّ إِنَّ الْقَوْمَ اسْتَضْعَفُونِي وَكَادُوا يَقْتُلُونَنِي فَلَا تُشْمِتْ بِيَ الْأَعْدَاءَ وَلَا تَجْعَلْنِي مَعَ الْقَوْمِ الظَّالِمِينَ ۰

যখন মুসা ক্রুদ্ধ ও দুঃখিত হয়ে তার সম্প্রদায়ের কাছে ফিরে এলো, তখন সে বলেছিলো, আমার অনুপস্থিতিতে আমার কী নিকৃষ্ট প্রতিনিধিত্বটাই না তোমরা করেছ! তোমাদের রবের আদেশ (পাওয়ার) আগেই তোমরা তাড়াহুড়ো করলে? সে (মুসা) ফলকগুলি নামিয়ে রাখলো এবং নিজের ভাইয়ের মাথার চুল চেপে ধরে নিজের দিকে টানতে লাগলো। তাঁর ভাই (হারুন আঃ) বললেন, হে আমার সহোদর! আমার সম্প্রদায়ের লোকেরা আমাকে দুর্বল মনে করলো এবং আমাকে তো মেরে ফেলারই উপক্রম করেছিল। সুতরাং এমন কিছু করো না, যাতে শত্রুরা আনন্দ পায়। আর আমাকে যালিমদের সারিতে গণ্য করো না। 

[সূরাহ আল আরাফ:১৫০]

(প্রায় অনুরূপ অর্থে) আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন:

 وَ لَوۡ نَشَآءُ لَجَعَلۡنَا مِنۡکُمۡ مَّلٰٓئِکَۃً فِی الۡاَرۡضِ یَخۡلُفُوۡنَ ۰ 

আর যদি আমি চাইতাম, তবে আমি তোমাদের পরিবর্তে ফেরেশতা সৃষ্টি করে পাঠাতাম যারা জমিনে তোমাদের উত্তরাধিকারী হতো।

[সূরাহ আয যুখরুফ: ৬০]

১১. আল্লাহ তায়ালা মুমিন ও সৎকর্মশীলদেরকে পৃথিবীতে যে ক্ষমতা ও শাসন-কর্তৃত্বদানের ওয়াদা করেছেন সে সম্পর্কিত আয়াতে উক্ত শব্দের পরিবর্তিত ক্রিয়ারূপ ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন তিনি বলেন:

وَعَدَ اللّٰهُ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا مِنۡکُمۡ وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ لَیَسۡتَخۡلِفَنَّهُمۡ فِی الۡاَرۡضِ کَمَا اسۡتَخۡلَفَ الَّذِیۡنَ مِنۡ قَبۡلِهِمۡ ۪ وَ لَیُمَکِّنَنَّ لَهُمۡ دِیۡنَهُمُ الَّذِی ارۡتَضٰی لَهُمۡ وَ لَیُبَدِّلَنَّهُمۡ مِّنۡۢ بَعۡدِ خَوۡفِهِمۡ اَمۡنًا ؕ یَعۡبُدُوۡنَنِیۡ لَا یُشۡرِکُوۡنَ بِیۡ شَیۡئًا ؕ وَ مَنۡ کَفَرَ بَعۡدَ ذٰلِکَ فَاُولٰٓئِکَ 

هُمُ الۡفٰسِقُوۡنَ ٠ 

তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান আনে এবং সৎকর্ম করে আল্লাহ তাদেরকে এ মর্মে ওয়াদা দিয়েছেন যে, তিনি নিশ্চিতভাবে তাদেরকে পৃথিবীর কর্তৃত্ব-প্রতিনিধিত্ব দান করবেন, যেমন তিনি কর্তৃত্ব-প্রতিনিধিত্ব দান করেছিলেন তাদের পূর্ববর্তীদেরকে এবং তিনি অবশ্যই তাদের জন্য শক্তিশালী ও সুপ্রতিষ্ঠিত করবেন তাদের দীনকে, যা তিনি তাদের জন্য মনোনীত করেছেন এবং তিনি তাদের ভয়-ভীতিকে শান্তি-নিরাপত্তায় পরিবর্তিত করে দিবেন। তারা আমারই ইবাদাত করবে, আমার সাথে কোন কিছুকে শরীক করবে না। আর এরপরও যারা কুফরী করবে তারাই ফাসিক।

[সূরাহ আন নূর:৫৫]

খলীফাহ্ কে? 

খলীফাহ্ বা প্রতিনিধি কার পক্ষ থেকে (মনোনীত)?

খলীফাহ্ শব্দের অর্থ হিসেবে বাংলায় সাধারণত প্রতিনিধি শব্দটিই বেশি ব্যবহৃত হয়। এছাড়া স্থলাভিষিক্ত ও অনুরূপ শব্দসমূহও ব্যবহৃত হয়। 

বস্তুতঃ মানুষ পৃথিবীতে আল্লাহর পক্ষ থেকে নিযুক্ত প্রতিনিধি। 

সুতরাং প্রতিনিধি স্বয়ং মালিক বা কর্তৃত্বের অধিকারী নয়। বরং প্রতিনিধি হলো মালিকের পক্ষ থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত। প্রতিনিধির বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য-গুণাবলী থাকতে হয়।  অন্যভাবে বললে, বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলীসম্পন্ন লোকই প্রতিনিধি মনোনীত হয়ে থাকেন এবং তাদের বিশেষ দায়িত্ব ও কর্তব্য থাকে।

প্রতিনিধির মধ্যে ন্যূনতম যেসব বৈশিষ্ট্য বা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বা বিষয় থাকা অপরিহার্য তা হলো:

এক. বিশ্বাস ও আস্থা : অর্থাৎ মালিকের প্রতি সর্বোচ্চ/যথাযথ বিশ্বাস ও আস্থা থাকতে বা রাখতে হবে। 

দুই. নিষ্ঠা-আন্তরিকতা: মালিকের প্রতি পরিপূর্ণ নিষ্ঠা-আন্তরিকতা থাকতে হবে; অর্থাৎ, তাঁরই প্রতি সর্বদা একনিষ্ঠ থাকতে হবে।    

তিন. আনুগত্য: মূলত মালিকের পক্ষ থেকেই প্রতিনিধি মনোনীত হয়ে থাকে। সুতরাং প্রতিনিধি অবশ্যই সেই মালিকের পরিপূর্ণ আনুগত্য করবে এবং কখনো তাঁর আনুগত্যের বাইরে যাবে না। 

চার. আমানদারিতা: প্রতিনিধি মালিক নয়, বরং সে মালিকের পক্ষ থেকে নিযুক্ত আমানতদার। সুতরাং মালিকের পক্ষ থেকে তার নিকট যত প্রকার বিষয়-বস্তু, উপায়-উপকরণ ও সামর্থ্য-সক্ষমতা থাকবে, সে নিজেকে সেগুলোর মালিক মনে করবে না। বরং সেগুলো মালিকের পক্ষ থেকে আমানত হিসেবে যথাযথ সংরক্ষণ ও সঠিকভাবে এর ব্যবহার বা প্রয়োগ করবে। কোন প্রকার অপব্যবহার বা অপপ্রয়োগ করবে না। 

পাঁচ. জবাবদিহিতার অনুভূতি: সদা-সর্বদা সে মালিকের নিকট জবাবদিহিতার সম্মুখীন হওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকবে। সকল কাজে এসব বিষয় সর্বদা স্মরণ রাখবে। কখনো অসতর্ক হবে না। 

আর এর অন্তর্ভুক্ত হলো : সংশ্লিষ্ট সকল নিয়ম ও বিধিনিষেধ পূর্ণমাত্রায় মেনে কর্মসম্পাদন ও দায়িত্ব পালন শেষে তাঁকে সবকিছু বুঝিয়ে দিবে।

এরূপ উত্তম বৈশিষ্ট্যসম্পন্নরাই প্রতিনিধি এবং  প্রতিনিধি মনোনীত হওয়ার যোগ্য। 

খলীফাহ্ কার পক্ষ থেকে (মনোনীত)?

তিনি কার প্রতিনিধিত্ব করবেন?

উপরের আলোচনায় খলীফাহ্ হলো মানুষ। আর মানুষ পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধি। এটা এক অর্থে প্রযোজ্য।  

আবার,

আমরা যে (পারিভাষিক) অর্থে এখানে খলীফাহ্ নিয়ে আলোচনা করছি সেই খলীফাহ্ মূলত/সাধারণত মুসলিমদের পক্ষ থেকে মনোনীত হয়ে থাকেন।

সুতরাং তিনি মুসলিমদের প্রতিনিধি। বিধায়, কিতাবুল্লাহ্ ও সুন্নাহ্ অনুযায়ী তিনি মুসলিমদেরই প্রতিনিধিত্ব করবেন।  

খ.

خلافة শব্দের অর্থ:

...

والخِلافةُ النّيابة عن الغير إمّا لغيبة المنوب عنه، وإمّا لموته، وإمّا لعجزه، وإمّا لتشريف المستخلف ...

খিলাফাহ হল, অন্যের পক্ষ থেকে তার অনুপস্থিতিতে প্রতিনিধিত্ব করা বা দায়িত্ব পালন করা, কারো সাময়িক অনুপস্থিতির সময় কিংবা তার মৃত্যুর পর অথবা তার অক্ষমতা বা অনুরূপ কারণে কিংবা কারো পক্ষ থেকে নিযুক্ত হয়ে তার প্রতিনিধিত্ব করা বুঝায়।

[المفردات في غريب القرآن]

 

লিসানুল আরব-এ এসেছে:

خَلَفَهُ يَخْلُفُهُ صَارَ خَلْفَهُ... وَالخَلِيفةُ الَّذِي يُسْتَخْلَفُ مِمَّنْ قَبْلَهُ، وَالْـخِلافَةُ الإِمَارَةُ٠٠٠

ابن منظور: لسان العرب، مادة: خلف٠٠٠]

খিলাফাহ্ শব্দের অর্থ: একজন আরেকজনের পেছনে হওয়া..., 

খলীফাহ্ হলো, যে ব্যক্তি তার পূর্ববর্তী ব্যক্তির স্থলাভিষিক্ত বা প্রতিনিধি হয়,

আর খিলাফাহ্ হলো, ইমারাহ্ তথা শাসন-ক্ষমতা, কর্তৃত্ব ও নেতৃত্ব।

[লিসানুল আরব...]

গ. 

এবার আমরা আলোচনা করছি خلیفة শব্দের বিভিন্নরূপ অর্থ ও ব্যবহার সম্পর্কে:

খলীফাহ্ শব্দের অর্থ হিসেবে বাংলায় সাধারণত প্রতিনিধি শব্দটিই বেশি ব্যবহৃত হয়। এছাড়া স্থলাভিষিক্ত ও অনুরূপ শব্দসমূহও ব্যবহৃত হয়। 

বস্তুতঃ মানুষ পৃথিবীতে আল্লাহর পক্ষ থেকে নিযুক্ত প্রতিনিধি। 

সুতরাং প্রতিনিধি স্বয়ং মালিক বা কর্তৃত্বের অধিকারী নয়। বরং প্রতিনিধি হলো মালিকের পক্ষ থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত। প্রতিনিধির বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য-গুণাবলী থাকতে হয়।  অন্যভাবে বললে, বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলীসম্পন্ন লোকই প্রতিনিধি মনোনীত হয়ে থাকেন এবং তাদের বিশেষ দায়িত্ব ও কর্তব্য থাকে।

প্রতিনিধির মধ্যে ন্যূনতম যেসব বৈশিষ্ট্য বা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বা বিষয় থাকা অপরিহার্য তা হলো:

এক. বিশ্বাস ও আস্থা : অর্থাৎ মালিকের প্রতি সর্বোচ্চ/যথাযথ বিশ্বাস ও আস্থা থাকতে বা রাখতে হবে। 

দুই. নিষ্ঠা-আন্তরিকতা: মালিকের প্রতি পরিপূর্ণ নিষ্ঠা-আন্তরিকতা থাকতে হবে; অর্থাৎ, তাঁরই প্রতি সর্বদা একনিষ্ঠ থাকতে হবে।    

তিন. আনুগত্য: মূলত মালিকের পক্ষ থেকেই প্রতিনিধি মনোনীত হয়ে থাকে। সুতরাং প্রতিনিধি অবশ্যই সেই মালিকের পরিপূর্ণ আনুগত্য করবে এবং কখনো তাঁর আনুগত্যের বাইরে যাবে না। 

চার. আমানদারিতা: প্রতিনিধি মালিক নয়, বরং সে মালিকের পক্ষ থেকে নিযুক্ত আমানতদার। সুতরাং মালিকের পক্ষ থেকে তার নিকট যত প্রকার বিষয়-বস্তু, উপায়-উপকরণ ও সামর্থ্য-সক্ষমতা থাকবে, সে নিজেকে সেগুলোর মালিক মনে করবে না। বরং সেগুলো মালিকের পক্ষ থেকে আমানত হিসেবে যথাযথ সংরক্ষণ ও সঠিকভাবে এর ব্যবহার বা প্রয়োগ করবে। কোন প্রকার অপব্যবহার বা অপপ্রয়োগ করবে না। 

পাঁচ. জবাবদিহিতার অনুভূতি: সদা-সর্বদা সে মালিকের নিকট জবাবদিহিতার সম্মুখীন হওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকবে। সকল কাজে এসব বিষয় সর্বদা স্মরণ রাখবে। কখনো অসতর্ক হবে না। 

আর এর অন্তর্ভুক্ত হলো : সংশ্লিষ্ট সকল নিয়ম ও বিধিনিষেধ পূর্ণমাত্রায় মেনে কর্মসম্পাদন ও দায়িত্ব পালন শেষে তাঁকে সবকিছু বুঝিয়ে দিবে।

এরূপ উত্তম বৈশিষ্ট্যসম্পন্নরাই প্রতিনিধি এবং  প্রতিনিধি মনোনীত হওয়ার যোগ্য। 

এবার আমরা উল্লেখ করছি খলীফাহ্ শব্দের বহুরূপ ব্যবহার ও বিভিন্ন অর্থ:

১.আল্লাহ তায়ালা বলেন: 

 وَ اِذۡ قَالَ رَبُّکَ لِلۡمَلٰٓئِکَۃِ اِنِّیۡ جَاعِلٌ فِی الۡاَرۡضِ خَلِیۡفَۃً ؕ قَالُوۡۤا اَتَجۡعَلُ فِیۡهَا مَنۡ یُّفۡسِدُ فِیۡهَا وَ یَسۡفِکُ الدِّمَآءَ ۚ وَ نَحۡنُ نُسَبِّحُ بِحَمۡدِکَ وَ نُقَدِّسُ لَکَ ؕ قَالَ اِنِّیۡۤ اَعۡلَمُ مَا لَا تَعۡلَمُوۡن ۰

স্মরণ কর, তোমার প্রতিপালক যখন ফিরিশতাদেরকে বললেন, আমি পৃথিবীতে খলীফাহ বা প্রতিনিধি সৃষ্টি করছি; তারা বলল, আপনি কি সেখানে এমন কাউকে সৃষ্টি করবেন যে অশান্তি সৃষ্টি করবে ও রক্তপাত ঘটাবে? আমরাই তো আপনার সপ্রশংস তাসবীহ পাঠ ও পবিত্রতা ঘোষণা করছি। তিনি বললেন, আমি যা জানি তোমরা তা জান না।

[সূরা আল বাক্বারাহ:৩০]

এ আয়াতে উল্লিখিত খলীফাহ্ خلیفة শব্দের অর্থ তাফসীরে ইবনে কাসীরে এসেছে: 

أي : قوما يخلف بعضهم بعضا قرنا بعد قرن وجيلا بعد جيل ۰۰۰

অর্থাৎ, যুগের পর যুগ একের পর এক আগত মানবগোষ্ঠী বা প্রজন্মের পর প্রজন্ম, যারা একে অপরের স্থলাভিষিক্ত হয় বা প্রতিনিধিত্ব করে। 

অন্যান্য তাফসীর ও অভিধানেও প্রায় অনুরূপ এসেছে।

আরো কিছু আয়াতেও এ শব্দটি (একবচন ও বহুবচনে) অনুরূপ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। 

২. আল কুরআনে খলীফাহ্ (خليفة) শব্দের বহুবচন খলায়িফ (خلاءف) শব্দটি তুলনামূলক বেশি ব্যবহৃত হয়েছে। পৃথিবীতে ক্রমান্বয়ে আগমন করা মানবগোষ্ঠী বুঝাতে এ শব্দের ব্যবহার এসেছে। 

যেমন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা আরো বলেন:

هُوَ الَّذِیۡ جَعَلَکُمۡ خَلٰٓئِفَ فِی الۡاَرۡضِ ؕ فَمَنۡ کَفَر فَعَلَیۡهِ کُفۡرُهٗ ؕ وَ لَا یَزِیۡدُ الۡکٰفِرِیۡنَ کُفۡرُهُمۡ عِنۡدَ رَبِّهِمۡ اِلَّا مَقۡتًا ۚ وَ لَا یَزِیۡدُ الۡکٰفِرِیۡنَ کُفۡرُهُمۡ اِلَّا خَسَارًا ٠

তিনিই তোমাদেরকে জমিনের মধ্যে খলীফা করেছেন। সুতরাং যে কুফরী করবে, তার কুফরী তার উপরই (বর্তাবে)। আর কাফিরদের জন্য তাদের কুফরী তাদের রবের নিকট কেবল ক্রোধই বৃদ্ধি করে এবং কাফিরদের জন্য তাদের কুফরী কেবল ক্ষতিই বৃদ্ধি করে। 

[সূরাহ ফাতির:৩৯]

আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন:

 وَ هُوَ الَّذِیۡ جَعَلَکُمۡ خَلٰٓئِفَ الۡاَرۡضِ وَ رَفَعَ بَعۡضَکُمۡ فَوۡقَ بَعۡضٍ دَرَجٰتٍ لِّیَبۡلُوَکُمۡ فِیۡ مَاۤ اٰتٰکُمۡ ؕ اِنَّ رَبَّکَ سَرِیۡعُ الۡعِقَابِ ۫ۖ وَ اِنَّهٗ لَغَفُوۡرٌ رَّحِیۡمٌ ٠

 আর তিনিই তোমাদেরকে জমিনের খলীফা বানিয়েছেন এবং তোমাদের কতককে কতকের উপর মর্যাদা দিয়েছেন,যাতে তিনি তোমাদেরকে যা প্রদান করেছেন তাতে তোমাদেরকে পরীক্ষা করেন। নিশ্চয় তোমার রব দ্রুত শাস্তিদানকারী এবং তিনি অবশ্যই ক্ষমাশীল,পরম দয়ালু।

[সূরাহ আল আনআম:১৬৫]

৩. পূর্বের মানবগোষ্ঠী বা প্রজন্মের পরবর্তী মানবগোষ্ঠী বা প্রজন্ম বুঝাতে অনুরূপ শব্দের ব্যবহার এসেছে। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন:

ثُمَّ جَعَلۡنٰکُمۡ خَلٰٓئِفَ فِی الۡاَرۡضِ مِنۡۢ بَعۡدِهِمۡ لِنَنۡظُرَ کَیۡفَ تَعۡمَلُوۡنَ ٠

অতঃপর তাদের পর আমি তোমাদেরকে পৃথিবীতে তাদের স্থলাভিষিক্ত করেছি এটা দেখার জন্য যে তোমরা কেমন আমল কর। [সূরা ইউনুস:১৪]

আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন:

فَکَذَّبُوۡهُ فَنَجَّیۡنٰهُ وَ مَنۡ مَّعَهٗ فِی الۡفُلۡکِ وَ جَعَلۡنٰهُمۡ خَلٰٓئِفَ وَ اَغۡرَقۡنَا الَّذِیۡنَ کَذَّبُوۡا بِاٰیٰتِنَا ۚ فَانۡظُرۡ کَیۡفَ کَانَ عَاقِبَۃُ الۡمُنۡذَرِیۡنَ ٠

কিন্তু তারা তাকে অস্বীকার করলো (মিথ্যা বলে অমান্য করল)। তখন আমি তাকে এবং তার সঙ্গে যারা নৌকায় ছিল তাদেরকে রক্ষা করলাম, আর তাদেরকে (পৃথিবীতে) উত্তরাধিকারী বানালাম, আর যারা আমার আয়াতসমূহকে মিথ্যা বলে অমান্য করেছিল তাদেরকে ডুবিয়ে মারলাম। এখন দেখ যাদেরকে সতর্ক করা হয়েছিল (তারা সতর্ক না হওয়ায়) তাদের পরিণাম কী হয়েছিল!

[সূরাহ ইউনুস:৭৩]

কখনো উক্ত শব্দের ক্রিয়ারূপ ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন:

فَاِنۡ تَوَلَّوۡا فَقَدۡ اَبۡلَغۡتُکُمۡ مَّاۤ اُرۡسِلۡتُ بِهٖۤ اِلَیۡکُمۡ ؕ وَ یَسۡتَخۡلِفُ رَبِّیۡ قَوۡمًا غَیۡرَکُمۡ ۚ وَ لَا تَضُرُّوۡنَهٗ شَیۡئًا ؕ اِنَّ رَبِّیۡ عَلٰی کُلِّ شَیۡءٍ حَفِیۡظٌ ٠

অতঃপর তোমরা যদি বিমুখ হও, তবে যা নিয়ে আমি তোমাদের কাছে প্রেরিত হয়েছি তা তো তোমাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছি। আর আমার রব তোমাদেরকে ছাড়া অন্য এক জাতিকে (তোমাদের) স্থলাভিষিক্ত করবেন। আর তোমরা তাঁর কোন ক্ষতি করতে পারবে না। নিশ্চয় আমার রব সব কিছুর হেফাযতকারী।

[সূরা হূদ:৫৭]

৪. আবার খলীফাহ্ শব্দের আরেকটি বহুবচন রূপ খুলাফা (خلفاء) শব্দও অনেক ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে পরবর্তী মানবগোষ্ঠী অর্থে। অবশ্য এটি خليف শব্দের বহুবচন হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন:

اَوَ عَجِبۡتُمۡ اَنۡ جَآءَکُمۡ ذِکۡرٌ مِّنۡ رَّبِّکُمۡ عَلٰی رَجُلٍ مِّنۡکُمۡ لِیُنۡذِرَکُمۡ ؕ وَ اذۡکُرُوۡۤا اِذۡ جَعَلَکُمۡ خُلَفَآءَ مِنۡۢ بَعۡدِ قَوۡمِ نُوۡحٍ وَّ زَادَکُمۡ فِی الۡخَلۡقِ بَصۜۡطَۃً ۚ فَاذۡکُرُوۡۤا اٰلَآءَ اللّٰهِ لَعَلَّکُمۡ تُفۡلِحُوۡنَ ٠

তোমরা কি আশ্চর্য হচ্ছো যে, তোমাদের রবের পক্ষ থেকে তোমাদের মধ্যকার এক ব্যক্তির নিকট উপদেশ এসেছে, যাতে সে তোমাদেরকে সতর্ক করে? আর তোমরা স্মরণ কর, যখন তিনি তোমাদেরকে নূহের কওমের পর স্থলাভিষিক্ত করেছিলেন এবং সৃষ্টিতে তোমাদেরকে দৈহিক গঠন ও শক্তিতে সমৃদ্ধ করেছেন। সুতরাং তোমরা স্মরণ কর আল্লাহর নিআমতসমূহকে, যাতে তোমরা সফলকাম হও।

[সূরাহ আল আরাফ:৬৯]

আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন:

وَ اذۡکُرُوۡۤا اِذۡ جَعَلَکُمۡ خُلَفَآءَ مِنۡۢ بَعۡدِ عَادٍ وَّ بَوَّاَکُمۡ فِی الۡاَرۡضِ تَتَّخِذُوۡنَ مِنۡ سُهُوۡلِهَا قُصُوۡرًا وَّ تَنۡحِتُوۡنَ الۡجِبَالَ بُیُوۡتًا ۚ فَاذۡکُرُوۡۤا اٰلَآءَ اللّٰهِ وَ لَا تَعۡثَوۡا فِی الۡاَرۡضِ مُفۡسِدِیۡنَ ٠

স্মরণ কর, 'আদ জাতির পরে তিনি তোমাদেরকে তাদের স্থলাভিষিক্ত করেছেন আর তোমাদেরকে যমীনে বসতি দান করেছেন, তোমরা এর সমতলে প্রাসাদ নির্মাণ করছ আর পাহাড় কেটে ঘর তৈরি করছ, কাজেই আল্লাহর অনুগ্রহের কথা স্মরণ কর এবং পৃথিবীতে ফাসাদ সৃষ্টি করো না।  [সূরাহ আল আরাফ:৭৪]

আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন:

اَمَّنۡ یُّجِیۡبُ الۡمُضۡطَرَّ اِذَا دَعَاهُ وَ یَکۡشِفُ السُّوۡٓءَ وَ یَجۡعَلُکُمۡ خُلَفَآءَ الۡاَرۡضِ ؕ ءَ اِلٰهٌ مَّعَ اللّٰهِ ؕ قَلِیۡلًا مَّا تَذَکَّرُوۡنَ ٠

নাকি তিনিই (শ্রেষ্ঠ) যিনি আর্তের আহবানে সাড়া দেন যখন সে তাঁকে ডাকে এবং দুঃখ-কষ্ট দূর করেন আর তোমাদেরকে পৃথিবীর উত্তরাধিকারী করেন? আল্লাহর সঙ্গে অন্য কোন ইলাহ্ আছে কি? অতি সামান্য উপদেশই তোমরা গ্রহণ কর! 

[সূরাহ আন নামল:৬২]

রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদীসে এ উম্মাহর খলীফাগণ সম্পর্কে خلفاء শব্দের ব্যবহার এসেছে। যেমন সহীহ্ আল বুখারীতে বর্ণিত আছে :

 بَابُ مَا ذُكِرَ عَنْ بَنِيْ إِسْرَائِيْل٠

حَدَّثَنِيْ مُحَمَّدُ بْنُ بَشَّارٍ حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ جَعْفَرٍ حَدَّثَنَا شُعْبَةُ عَنْ فُرَاتٍ الْقَزَّازِ قَالَ سَمِعْتُ أَبَا حَازِمٍ قَالَ قَاعَدْتُ أَبَا هُرَيْرَةَ خَمْسَ سِنِيْنَ فَسَمِعْتُهُ يُحَدِّثُ عَنْ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ كَانَتْ بَنُوْ إِسْرَائِيْلَ تَسُوْسُهُمْ الأَنْبِيَاءُ كُلَّمَا هَلَكَ نَبِيٌّ خَلَفَهُ نَبِيٌّ وَإِنَّهُ لَا نَبِيَّ بَعْدِيْ وَسَيَكُوْنُ خُلَفَاءُ فَيَكْثُرُوْنَ قَالُوْا فَمَا تَأْمُرُنَا قَالَ فُوْا بِبَيْعَةِ الأَوَّلِ فَالأَوَّلِ أَعْطُوْهُمْ حَقَّهُمْ فَإِنَّ اللهَ سَائِلُهُمْ عَمَّا اسْتَرْعَاهُمْ ٠

(كتاب أحاديث الأنبياء:صحيح البخارى)

পরিচ্ছেদ: বনী ইসরাঈল সম্পর্কে যা বর্ণিত হয়েছে।

আবূ হাযিম (রহ.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি পাঁচ বছর যাবৎ আবূ হুরাইরাহ্ (রাঃ)-এর সাহচর্যে ছিলাম। তখন আমি তাঁকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে হাদীস বর্ণনা করতে শুনেছি যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, বনী ইসরাঈলের নবীগণ তাঁদের উম্মাতকে শাসন করতেন। যখন কোন একজন নবী মারা যেতেন, তখন অন্য একজন নবী তাঁর স্থলাভিষিক্ত হতেন। আর আমার পরে কোন নবী নেই। তবে অনেক খলীফাহ্ হবে। সহাবীগণ (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি আমাদেরকে কী  নির্দেশ করছেন? তিনি বললেন, তোমরা একের পর এক তথা পর্যায়ক্রমে প্রথম জনের বাইয়াহ্ পূর্ণ করবে। তোমাদের উপর তাদের যে হক রয়েছে তা আদায় করবে। আর নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তাদেরকে জিজ্ঞেস করবেন ঐ সকল বিষয়ে যে সবের দায়িত্ব তাদের উপর অর্পণ করা হয়েছিল।

[সহীহ্ আল বুখারী:কিতাবু আহাদীসিল আম্বিয়া; সহীহ্ মুসলিম...]

৫. আল্লাহ তায়ালা তাঁর নাবী দাউদ (আঃ)-এর ব্যাপারে খলীফাহ্ শব্দের ব্যবহার করেছেন,আর তাঁকে এ সংক্রান্ত নির্দেশনা দান করেছেন। এসম্পর্কে তিনি বলেন:

یٰدَاوٗدُ اِنَّا جَعَلۡنٰکَ خَلِیۡفَۃً فِی الۡاَرۡضِ فَاحۡکُمۡ بَیۡنَ النَّاسِ بِالۡحَقِّ وَ لَا تَتَّبِعِ الۡهَوٰی فَیُضِلَّکَ عَنۡ سَبِیۡلِ اللّٰهِ ؕ اِنَّ الَّذِیۡنَ یَضِلُّوۡنَ عَنۡ سَبِیۡلِ اللّٰهِ لَهُمۡ عَذَابٌ شَدِیۡدٌۢ بِمَا نَسُوۡا یَوۡمَ الۡحِسَابِ ٠

হে দাঊদ! নিশ্চয় আমি তোমাকে জমিনে খলীফা বানিয়েছি, অতএব তুমি মানুষের মধ্যে ন্যায়বিচার কর আর প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না, কেননা তা তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করবে। নিশ্চয় যারা আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত হয় তাদের জন্য কঠিন আযাব রয়েছে। কারণ তারা হিসাব দিবসকে ভুলে গিয়েছিল। 

[সূরা সদ:২৬] 

 

৬. কোন কোন হাদীসে আল্লাহ তায়ালাকেও  খলীফাহ্ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন   দাজ্জাল সম্পর্কিত দীর্ঘ হাদীসে রসূলুল্লাহ্ (সঃ) থেকে বর্ণিত আছে:

...

إن يخرج وأنا فيكم فأنا حجيجه دونكم وإن يخرج ولست فيكم فامرؤ حجيج نفسه والله خليفتي على كل مسلم٠٠٠ 

صحيح مسلم

كتاب الفتن وأشراط الساعة 

باب ذكر الدجال وصفته وما معه

রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: সে (দাজ্জাল) যদি আমার জীবদ্দশায় আত্মপ্রকাশ করে তবে আমিই তোমাদের হয়ে তার মোকাবিলা করবো, আর সে যদি আমার অবর্তমানে আবির্ভূত হয়, তাহলে প্রত্যেক ব্যক্তিই তাকে প্রতিহত করবে। আর আল্লাহই আমার পক্ষ থেকে প্রত্যেক মুসলিমের জন্য খলীফাহ্ বা তত্ত্বাবধায়ক। 

[সহীহ্ মুসলিম] 

হাদীসে আল্লাহ্ তায়ালাকে খলীফাহ বলা হয়েছে এরূপ আরো দৃষ্টান্ত আছে,যেমন রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সফরকালে যে দুআ পাঠ করতেন তাতে আছে: 

اللَّهُمَّ أَنْتَ الصَّاحِبُ في السَّفَرِ، وَالْخَلِيفَةُ فى الأهْل٠٠٠

صحيح مسلم

كتاب الحج

باب مَا يَقُولُ إِذَا رَكِبَ إِلَى سَفَرٍ الْحَجِّ وَغَيْرِهِ 

...হে আল্লাহ!আপনি আমাদের সফরের সাথী এবং আমাদের পরিবার-পরিজনের তত্ত্বাবধানকারী...[সহীহ্ মুসলিম:কিতাবুল হাজ্জ]

..................

নোট:১.

সফরের পূর্ণ দুআ ও এসম্পর্কিত হাদীসটি হল:

আবদুল্লাহ ইবন উমর রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন সফরের উদ্দেশ্যে উটের পিঠে আরোহণ করতেন, তখন বলতেন:

اللهُ أَكْبَرُ، اللهُ أَكْبَرُ، اللهُ أَكْبَرُ، سُبْحانَ الذِيْ سَخَّرَ لَنَا هَذَا وَمَا كُنَّا لَهُ مُقْرِنِينْ، وإِنَّا إِلَى ربِّنَا لَمُنْقَلِبُون، الَّلهُمَّ إِنَّا نَسْألُكَ فِيْ سَفَرِِنا هَذَا البِرَّ والتَّقْوى، ومِنَ الْعَمَلِ ما تَرْضَى، الَّلهُمَّ هوِّن عَلَيْنا سَفَرَنا هَذَا واطْوِعنَّا بُعدَه، الَّلهُمَّ أنْتَ الصَّاحِبُ في السَّفَرِ، وَالْخَلِيْفَةُ فِي الأَهْلِ، الَّلهُمَّ إِنِّيْ أَعُوْذُ بِكَ مِنْ وَعْثَاءِ السَّفَرِ وَكَآبَةِ الْمَنْظَر، وَسُوءِ المُنْقَلَبِ فِيْ الْمَالِ والأَهْلِ ٠

كتاب الحج

باب مَا يَقُولُ إِذَا رَكِبَ إِلَى سَفَرٍ الْحَجِّ وَغَيْرِهِ

আল্লাহ মহান। আল্লাহ মহান। আল্লাহ মহান। পবিত্র সেই মহান সত্তা যিনি আমাদের জন্য একে বশীভূত করেছেন, যদিও আমরা একে বশীভূত করতে সক্ষম ছিলাম না। আর আমরা অবশ্যই ফিরে যাব আমাদের রবের নিকট। হে আল্লাহ! আমাদের এ সফরে আমরা আপনার নিকট প্রার্থনা জানাই সৎকাজ ও তাকওয়ার এবং এমন আমলের যাতে আপনি সন্তুষ্ট হন। হে আল্লাহ! আমাদের জন্য এ সফর সহজ করুন এবং এর দূরত্ব কমিয়ে দিন। হে আল্লাহ! এ সফরে আপনিই আমাদের সাথী এবং পরিবার-পরিজনের আপনিই তত্ত্বাবধানকারী। হে আল্লাহ! আমরা আপনার আশ্রয় প্রার্থনা করছি সফরের কষ্ট ও অবাঞ্ছিত দৃশ্য থেকে এবং সম্পদ ও পরিজনের মধ্যে মন্দ প্রত্যাবর্তন থেকে।

আর সফর থেকে ফিরেও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উক্ত দোআ পড়তেন এবং সাথে এ অংশটি যোগ করতেন-

آئِبُوْنَ، تَائِبُوْنَ، عَابِدُوْنَ، لِرَِبِنَا حَامِدُوْنَ ٠

আমরা আমাদের রবের উদ্দেশ্যে প্রত্যাবর্তনকারী, তওবাকারী, ইবাদতকারী ও আমাদের রবের প্রশংসাকারী।

[সহীহ্ মুসলিম ]‏‏

নোট:২.

অনেক হাদীসে আল্লাহ তায়ালার ক্ষেত্রে এরূপ কিছু নাম, শব্দ ও পরিভাষা ব্যবহৃত হয়েছে, তবে এগুলোকে আল্লাহ তায়ালার আসমা ওয়াল হুসনা-এর অন্তর্ভুক্ত বিবেচনা করা হয় না। যেমন: খলীফাহ, রফীক, জামীল...ইত্যাদি। এ সম্পর্কিত কয়েকটি হাদীস:

عَنْ عَائِشَةَ ـ رضى الله عنها ـ قَالَتِ اسْتَأْذَنَ رَهْطٌ مِنَ الْيَهُودِ عَلَى النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم فَقَالُوا السَّامُ عَلَيْكَ‏.‏ فَقُلْتُ بَلْ عَلَيْكُمُ السَّامُ وَاللَّعْنَةُ‏.‏ فَقَالَ ‏"‏ يَا عَائِشَةُ إِنَّ اللَّهَ رَفِيقٌ يُحِبُّ الرِّفْقَ فِي الأَمْرِ كُلِّهِ ‏"‏‏.‏ قُلْتُ أَوَلَمْ تَسْمَعْ مَا قَالُوا قَالَ ‏"‏ قُلْتُ وَعَلَيْكُمْ ‏"‏‏.‏

আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদল ইহুদী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকটে প্রবেশের অনুমতি চাইল (প্রবেশ করতে গিয়ে) তারা বলল "আসসামু আলাইকা"(অর্থাৎ,তোমার মৃত্যু হোক)। তখন আমি বললাম, বরং তোদের উপর মৃত্যু ও লানত পতিত হোক। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: হে আয়িশা! আল্লাহ রফীক বা কোমল। তিনি সকল কাজে কোমলতা পছন্দ করেন। আমি বললাম, আপনি কি শুনেননি তারা কি বলেছে? তিনি বললেন: আমিও তো বলেছি ওয়া-আলাইকুম (এবং তোমাদের উপরও)।

এ হাদিসটি এভাবেও বর্ণিত আছে:

عن عائشة رضي الله عنها: أَن النبيَّ ﷺ قَالَ: إِنَّ اللَّهَ رَفِيقٌ يُحِبُّ الرِّفقَ، وَيُعْطِي على الرِّفق ما لا يُعطي عَلى العُنفِ، وَما لا يُعْطِي عَلى مَا سِوَاهُ ٠ 

رواه مسلم

আয়িশাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: নিশ্চয় আল্লাহ রফীক বা কৃপাময়। তিনি নম্রতা পছন্দ করেন। আর নম্রতার উপর যা প্রদান করেন তা কঠোরতার উপর/মাধ্যমে প্রদান করেন না; এমনকি এ ব্যতীত অন্য কিছুর উপর/মাধমেও তা প্রদান করেন না। [সহীহ্ মুসলিম]

আরেকটি হাদীস:

وَعَن عَبدِ اللهِ بنِ مَسعُودٍ رضي الله عنه، عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم، قَالَ: «لاَ يَدْخُلُ الجَنَّةَ مَنْ كَانَ في قَلْبِهِ مِثْقَالُ ذَرَّة مِنْ كِبْرٍ ! » فَقَالَ رَجُلٌ: إنَّ الرَّجُلَ يُحِبُّ أنْ يَكُونَ ثَوْبُهُ حَسَناً، ونَعْلُهُ حَسَنَةً ؟ قَالَ:«إنَّ اللهَ جَمِيلٌ يُحِبُّ الجَمَالَ، الكِبْرُ: بَطَرُ الحَقِّ وَغَمْطُ النَّاسِ » رواه مسلم

আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যার অন্তরে অণু পরিমাণ অহংকার থাকবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। একটি লোক বলল, মানুষ তো ভালবাসে যে, তার পোশাক সুন্দর হোক ও তার জুতো সুন্দর হোক, (তাহলে)? তিনি বললেন, আল্লাহ সুন্দর, তিনি সৌন্দর্যকে ভালবাসেন। (সুন্দর পোশাক ও সুন্দর জুতো ব্যবহার অহংকার নয়, বরং) অহংকার হল, সত্য প্রত্যাখ্যান করা এবং মানুষকে তুচ্ছজ্ঞান করা। 

[সহীহ্ মুসলিম]

....................

এসব আয়াত ও সংশ্লিষ্ট দালীলসমূহ থেকে জানা যায়, মানুষকে খলীফাহ্ বলা হয়েছে। 

আবার বিশেষভাবে দাউদ (আঃ)-কেও খলীফাহ্ বলা হয়েছে (সূরা স-দ:২৬)। 

আর এই উম্মাহর মধ্যে সর্বপ্রথম খলীফাহ্ উপাধি প্রদান করা হয়েছে, আবু বাকর (রাঃ)-কে। কারণ, উম্মাহর নেতৃত্বে তিনিই রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতিনিধি মনোনীত হয়েছেন...।

[ইবনু কাসীর:আল বিদায়াহ্ ওয়ান নিহায়াহ্...]

সুতরাং, আল কুরআনের বিভিন্ন আয়াত ও সহীহ্ হাদীসে বর্ণিত দালীলসমূহ থেকে খলীফাহ্ (এবং বহুবচনে- খুলাফা ও খলায়িফ) শব্দের বিভিন্ন অর্থ জানা যায়; যেমন: 

এক. খলীফাহ্ অর্থ একের পর এক মানব প্রজন্ম,

দুই. খলীফাহ্ অর্থ পৃথিবীতে মানুষের কোন সভ্যতা বা জাতি ধ্বংস হওয়ার পর আগত নতুন মানবগোষ্ঠী, 

তিন. খলীফাহ্ মানে ইমাম বা নেতা,  

খলীফাহ্ মানে আমীর বা শাসক, 

খলীফাহ্ মানে মালিক বা রাজা, বাদশাহ, সুলতান, ক্ষমতাবান ইত্যাদি।

চার. কোন পরিবারের প্রধান বা অভিভাবককেও (শাব্দিক অর্থে) খলীফাহ্ বলা যেতে পারে।   

পাঁচ. কোন প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির পক্ষ থেকে কোন বিশেষ কর্ম বা দায়িত্বে নিযুক্ত প্রতিনিধি বা পরিচালককেও (শাব্দিক অর্থে) খলীফাহ বলা যায়।

ছয়. এছাড়াও হাদীসে আল্লাহ্ তায়ালাকেও খলীফাহ্ বলা হয়েছে।  

ইমাম ইবনু তাইমিয়াহ (রহঃ) বলেছেন:

الإمامُ هو الَّذي يُؤتَمُّ به، وذلك على وَجهَين أحَدُهما: أن يَرجِعَ إليه في العِلمِ والدِّينِ بحَيثُ يُطاعُ باختيارِ المُطيعِ؛ لكَونِه عالِمًا بأمرِ اللهِ عَزَّ وجَلَّ آمِرًا به، فيُطيعُه المُطيعُ لذلك، وإن كان عاجِزًا عن إلزامِه الطَّاعةَ

والثَّاني: أن يَكونَ صاحِبَ يَدٍ وسَيفٍ، بحَيثُ يُطاعُ طَوعًا وكَرْهًا؛ لكَونِه قادِرًا على إلزامِ المُطيعِ بالطَّاعةِ

وقَولُه تعالى: يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ [النساء: 59]  قد فُسِّر بالأمراءِ بذَويِ القُدرةِ كأُمراءِ الحَربِ، وفُسِّر بأهلِ العِلمِ والدِّينِ، وكِلاهما حَقٌّ .

منهاج السنة النبوية:[4/106]]

অর্থাৎ, ইমাম সেই ব্যক্তি যার অনুসরণ করা হয়, এটি দুই ধরণের। 

তন্মধ্যে একটি হলো: ইলম এবং দীনের বিষয়ে তার দারস্থ হওয়া যাতে অনুগতরা স্বেচ্ছায় তার অনুসরণ করতে পারে। যেহেতু তিনি পরাক্রমশালী এবং মহিমান্বিত আল্লাহর আদেশ সম্পর্কে সচেতন হয়েই আদেশ করছেন; তাই আনুগত্যকারী তার আনুগত্য করে থাকে, সে তাকে মানতে বাধ্য করতে সক্ষম না হলেও। 

দ্বিতীয়টি হলো: তিনি হবেন ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের অধিকারী, ফলে স্বেচ্ছায় এবং অনিচ্ছায় তার আনুগত্য করা হবে; কেননা অধীনস্থকে/অনুগতকে আনুগত্য করতে বাধ্য করার সক্ষমতা তার আছে। 

আল্লাহ্ তায়ালা বলেছেন: ওহে যারা ঈমান এনেছ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর এবং রসূলের আনুগত্য কর, আর তোমাদের মধ্যে যারা উলুল আমর বা দায়িত্ব-কর্তৃত্বপ্রাপ্ত তাদেরও (আনুগত্য করো) [সূরাহ আন নিসা:৫৯] 

এ আয়াতের তাফসীরে এটাকে ক্ষমতার অধিকারীদের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে যেমন, যুদ্ধ...ইত্যাদির পরিচালক; আবার, এটাকে ইলম ও দীনের ধারক-বাহকদের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা হয়েছে এবং উভয়টিই সঠিক।

[মিনহাজুস সুন্নাহ:ইমাম ইবনু তাইমিয়াহ্ (রহঃ)] 

দুই.

খিলাফাহ্ শব্দের পারিভাষিক অর্থ, সংজ্ঞা ও পরিচয়:

ইতোপূর্বে আমরা খিলাফাহ্ শব্দের আভিধানিক অর্থ উল্লেখ করেছি। 

ইনশাআল্লাহ্ এবার আমরা আলোচনা করবো খিলাফাহ্-র পরিচয় সম্পর্কে...   

খিলাফাহ্ কী?

আলিমগণ খিলাফাহ পরিভাষাটিকে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। যেমন: 

ইমাম মাওয়ারদী (রহঃ) বলেন:

الْإِمَامَة مَوْضُوعَةٌ لِخِلَافَةِ النُّبُوَّةِ فِي حِرَاسَةِ الدِّينِ وَسِيَاسَةِ الدُّنْيَا، وَعَقْدُهَا لِمَنْ يَقُومُ بِهَا فِي الْأُمَّةِ وَاجِبٌ بِالْإِجْمَاعِ٠٠٠

অর্থাৎ, ইমামত (বা ইসলামী শাসন-ব্যবস্থা, কর্তৃত্ব ও নেতৃত্ব) প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নুবুওয়াতের প্রতিনিধি হিসেবে দীনের সুরক্ষা ও ভূপৃষ্ঠের রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করার উদ্দেশ্যে। আর এই মহান দায়িত্ব যে ব্যক্তি ভালভাবে পালন করতে পারে তাকে নেতা হিসেবে মেনে নেয়ার লক্ষ্যে ইমাম বা খলীফাহ্ নির্ধারণ করা ওয়াজিব। 

[الأحكام السلطانية

البَابُ الأَوَّلُ: فِي عَقدِ الْإِمَامَةِ]

ইবনু খালদুন (রহঃ) বলেন:

هي: خِلافةٌ عن صاحِبِ الشَّرعِ في حِراسةِ الدِّينِ وسياسةِ الدُّنيا به ٠

এককথায়, শারীআহর বিধি-বিধানের উপর ভিত্তি করে দীন-ধর্মের সুরক্ষা এবং ভূ-রাজনীতির উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করার নাম খিলাফাহ্।

[العبر وديوان المبتدأ والخبر]

ইমামুল হারামাইন আবুল মাআলী আল জুওয়াইনী (রহঃ) বলেন:

الإمامةُ رياسةٌ تامَّةٌ، وزَعامةٌ عامَّةٌ تَتَعَلَّقُ بالخاصَّةِ والعامَّةِ في مُهمَّاتِ الدِّين والدُّنيا ٠

অর্থাৎ, ইমামাত হল ধর্মীয় ও পার্থিব কাজে অভিজাত ও জনসাধারণের সাথে সম্পর্কিত সাধারণ ও ব্যাপক নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব।

 [غياث الأمم في التياث الظلم]

আর লিসানুল আরব-এ এসেছে:

خَلَفَهُ يَخْلُفُهُ صَارَ خَلْفَهُ... وَالخَلِيفةُ الَّذِي يُسْتَخْلَفُ مِمَّنْ قَبْلَهُ، وَالْـخِلافَةُ الإِمَارَةُ٠٠٠

ابن منظور: لسان العرب، مادة خلف٠٠٠]

খিলাফাহ্ শব্দের অর্থ:একজন আরেকজনের পেছনে হওয়া..., খলীফাহ্ হলো,যে ব্যক্তি তার পূর্ববর্তী ব্যক্তির স্থলাভিষিক্ত বা প্রতিনিধি হয়,আর খিলাফাহ্ হলো,ইমারাহ্ তথা,শাসন-ক্ষমতা,কর্তৃত্ব,নেতৃত্ব। 

[লিসানুল আরব]

অন্যত্র এসেছে, 

الخلافة:الملك والامارة٠٠٠

অর্থাৎ, খিলাফাহ হলো,মুলক বা রাজত্ব ও ইমারাহ্ বা কর্তৃত্ব...।

[বিস্তারিত দ্রঃ  

مسائل في فقه الخلافة

الإمامة العظمى عند أهل السنة والجماعة

ইত্যাদি কিতাব]

মোটকথা, খিলাফাহ্ হল: ইসলামী শাসন, ক্ষমতা, কর্তৃত্ব, রাজত্ব... ইত্যাদি।

উল্লেখ্য, خلافة খিলাফাহ্ শব্দটি দু'ভাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে: 

প্রথমতঃ পৃথিবীতে ইসলামী শাসন-কর্তৃত্বকে খিলাফাহ্ বলা হয়ে থাকে। সাধারণত,যখন শুধু খিলাফাহ্ শব্দ ব্যবহার করা হয় (কোন যুগ/ব্যক্তি/খলীফাহর সাথে সংশ্লিষ্ট না করে) তখন এ শব্দ দ্বারা বৈশ্বিক ইসলামী রাষ্ট্র, এর বিস্তৃতি-সীমানা ও শাসন-কর্তৃত্বকে বুঝায়। আর

দ্বিতীয়তঃ যখন কোন ব্যক্তি/যুগ বা কোন খলীফাহর সাথে সংশ্লিষ্ট করে খিলাফাহ্ শব্দের ব্যবহার করা হয় তখন উক্ত যুগের খলিফাহর বিস্তৃতি, সীমানা বা খলীফাহর শাসনামল ও শাসন-কর্তৃত্বকে খিলাফাহ্ বলা হয়ে থাকে।

যেমন: খিলাফাতু আবি বাকর (রাঃ) বা আবু বাকর (রাঃ)-এর খিলাফাহ্, খিলাফাতু উমার (রাঃ) বা উমার (রাঃ)-এর খিলাফাহ্; অর্থাৎ তাঁদের শাসনামল, শাসন ব্যবস্থা, তাদের সময়ে ইসলামী রাষ্ট্রের বিস্তৃতি ও সীমানা...,

খিলাফাহ্ আলা মিনহাজিন নুবুওয়্যাহ্ বা খিলাফাতুন নুবুওয়্যাহ্ তথা নুবুওয়াতের আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত খিলাফাহ্... ইত্যাদি।

মূলত বৈশ্বিক/উল্লেখযোগ্য ইসলামী শাসন-ক্ষমতাকেই খিলাফাহ্ বলা হয়, আর এটা যথাযথ প্রতিষ্ঠিত থাকলেই কেবল তার পরিচালক বা খলীফাহর শাসন ও শাসনামলকে খিলাফাহ্ বলা যায়। যদি (প্রকৃত অর্থে) খিলাফাহ্ই প্রতিষ্ঠিত না থাকে তবে তার শাসক বা শাসন ব্যবস্থা থাকবে কিভাবে? এমতাবস্থায় তা দাবি করার কোন অর্থ নেই এবং এরূপ অবাস্তব দাবি করার কোন সুযোগ শারীআহ্তে নেই।

সুতরাং এসব আলোচনা ও দালীলের মাধ্যমে স্পষ্ট হয়েছে যে, 

খিলাফাহ্ মানে প্রতিনিধিত্ব, আর খলীফাহ্ মানে প্রতিনিধি;

খিলাফাহ্ মানে ইমারাহ্ বা শাসন-কর্তৃত্ব, আর খলীফাহ্ হলেন আমীর বা শাসনকর্তা, শাসক;

খিলাফাহ্ মানে ইমামাহ্ বা নেতৃত্ব, আর খলীফাহ্ হলেন ইমাম;

খিলাফাহ্ মানে মুলক বা রাজত্ব, আর খলীফাহ্ হলেন মালিক বা রাজা-বাদশাহ্;

খিলাফাহ্ মানে শাসন ক্ষমতা, শাসনব্যবস্থা, প্রশাসন, আর খলীফাহ্ হলেন শাসন ক্ষমতা, শাসনব্যবস্থা, প্রশাসনের পরিচালক ... ইত্যাদি। 

 

:খিলাফাহ্ ও খলীফাহ্ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য শব্দ ও পরিভাষা:

আল কুরআন, হাদীস এবং ফিকহ ও আহকামের কিতাবসমূহে খিলাফাহ্ ও খলীফাহ্-এর বেশ কিছু সমার্থবোধক শব্দ ও পরিভাষা ব্যবহৃত হয়েছে। এগুলোর কিছু দৃষ্টান্ত:

১.خلافة এবং خليفة

(খিলাফাহ্ এবং খলীফাহ্)

এর দৃষ্টান্ত ইতোপূর্বে এবং এই নিবন্ধের বিভিন্ন স্থানে উল্লেখ করেছি, যেমন: ২:৩০, ৩৮:২৬, এবং বুখারী, মুসলিম ও অন্যান্য কিতাবে বর্ণিত হাদীস দ্রঃ।

যেমন:

عَنْ أَبِي سَعِيدٍ الْخُدْرِيِّ عَنْ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ مَا بَعَثَ اللهُ مِنْ نَبِيٍّ وَلاَ اسْتَخْلَفَ مِنْ خَلِيفَةٍ إِلاَّ كَانَتْ لَهُ بِطَانَتَانِ بِطَانَةٌ تَأْمُرُهُ بِالْمَعْرُوفِ وَتَحُضُّهُ عَلَيْهِ وَبِطَانَةٌ تَأْمُرُهُ بِالشَّرِّ وَتَحُضُّهُ عَلَيْهِ فَالْمَعْصُومُ مَنْ عَصَمَ اللهُ تَعَالَى  

 [كتاب الاحكام:صحيح البخاري]

আবূ সা’ঈদ খুদরী (রাঃ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, আল্লাহ্ যাকেই নবী হিসাবে পাঠান এবং যাকেই খলীফা নিযুক্ত করেন, তার জন্য দু’জন করে ঘনিষ্ঠ সহযোগী থাকে। এক ঘনিষ্ঠ সহযোগী তাকে ভাল কাজের আদেশ দেয় এবং তাকে তার প্রতি উৎসাহিত করে। আর এক ঘনিষ্ঠ জন তাকে মন্দ কাজের আদেশ দেয় এবং তার প্রতি উৎসাহিত করে। কাজেই নিষ্পাপ ঐ ব্যক্তিই যাকে আল্লাহ্ তা’আলা রক্ষা করেন।

[সহীহ্ আল বুখারী,কিতাবুল আহকাম]

২.امارة এবং امير

(ইমারাহ এবং আমীর) 

عن أبي هريرة رضي الله عنه مرفوعاً: من أطاعني فقد أطاع الله، ومن عصاني فقد عصى الله، ومن يطع الأمير فقد أطاعني، ومن يعص الأمير فقد عصاني  

[صحيح] - [متفق عليه]

আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু কর্তৃক মারফূ‘ হিসেবে বর্ণিত, “যে ব্যক্তি আমার আনুগত্য করল, সে তো আল্লাহর আনুগত্য করল এবং যে আমার অবাধ্যতা করল, সে তো আল্লাহর অবাধ্যতা করল। আর যে ব্যক্তি নেতার আনুগত্য করবে, সে তো আমার আনুগত্য করল এবং যে নেতার অবাধ্যতা করবে, সে তো আমার অবাধ্যতা করল।”  

[সহীহ বুখারী ও মুসলিম]

সহীহ বুখারীতে আরো বর্ণিত আছে :

بَاب مَنْ لَمْ يَسْأَلْ الإِمَارَةَ أَعَانَهُ اللهُ عَلَيْهَا

حَجَّاجُ بْنُ مِنْهَالٍ حَدَّثَنَا جَرِيرُ بْنُ حَازِمٍ عَنْ الْحَسَنِ عَنْ عَبْدِ الرَّحْمَنِ بْنِ سَمُرَةَ قَالَ قَالَ لِي النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم يَا عَبْدَ الرَّحْمَنِ بْنَ سَمُرَةَ لاَ تَسْأَلْ الإِمَارَةَ فَإِنَّكَ إِنْ أُعْطِيتَهَا عَنْ مَسْأَلَةٍ وُكِلْتَ إِلَيْهَا وَإِنْ أُعْطِيتَهَا عَنْ غَيْرِ مَسْأَلَةٍ أُعِنْتَ عَلَيْهَا وَإِذَا حَلَفْتَ عَلَى يَمِينٍ فَرَأَيْتَ غَيْرَهَا خَيْرًا مِنْهَا فَكَفِّرْ عَنْ يَمِينِكَ وَأْتِ الَّذِي هُوَ خَيْرٌ

অনুচ্ছেদ:যে লোক নেতৃত্ব চায় না তাকে (দায়িত্ব দেয়া হলে) আল্লাহ্ সাহায্য করেন।

আবদুর রহমান ইবনু সামুরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: হে আবদুর রহমান ইবনু সামুরাহ! তুমি নেতৃত্ব চেয়ো না। কারণ চাওয়ার পর যদি তোমাকে তা দেয়া হয়, তবে তার দায়িত্ব তোমার উপরই বর্তাবে। আর যদি চাওয়া ছাড়াই তা তোমাকে দেয়া হয় তবে এ ক্ষেত্রে তোমাকে সাহায্য করা হবে। আর কোন বিষয়ে কসম করার পর, তার বিপরীত দিকটিকে যদি তার চেয়ে কল্যাণকর মনে কর, তাহলে কসমের কাফ্‌ফারা আদায় কর এবং কল্যাণকর কাজটি বাস্তবায়িত করো। 

[সহীহ্ আল বুখারী]

ইমাম বুখারী আরো বর্ণনা করেছেন:

بَاب مَا يُكْرَهُ مِنْ الْحِرْصِ عَلَى الإِمَارَةِ

أَحْمَدُ بْنُ يُونُسَ حَدَّثَنَا ابْنُ أَبِي ذِئْبٍ عَنْ سَعِيدٍ الْمَقْبُرِيِّ عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ عَنْ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ إِنَّكُمْ سَتَحْرِصُونَ عَلَى الإِمَارَةِ وَسَتَكُونُ نَدَامَةً يَوْمَ الْقِيَامَةِ فَنِعْمَ الْمُرْضِعَةُ وَبِئْسَتْ الْفَاطِمَةُ٠٠٠

পরিচ্ছেদ: নেতৃত্বের লোভ পছন্দনীয় নয়।

আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেছেন: তোমরা নিশ্চয়ই নেতৃত্বের লোভ কর, অথচ কিয়ামতের দিন তা লজ্জার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। কত উত্তম দুগ্ধদায়িনী এবং কত মন্দ দুগ্ধ পানে বাধা দানকারিণী (অর্থাৎ এর প্রথম দিক দুগ্ধদানের মত তৃপ্তিকর, আর পরিণাম দুধ ছাড়ানোর মত যন্ত্রণাদায়ক)।

[সহীহ্ আল বুখারী,কিতাবুল আহকাম]

৩. سلطة/سلطان এবং سلطان

(সুলত্বন/সুলতহ এবং সুলত্বন)

রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

مَن أَهانَ سلطانَ اللَّهِ في الأرضِ أَهانَهُ اللَّهُ

যে ব্যক্তি আল্লাহর মনোনীত সুলতানকে লাঞ্ছিত করবে তাকে আল্লাহ তায়ালা লাঞ্ছিত করবেন। [তিরমিযী:কিতাবুল ফিতান...]

৪. امر এবং اولوا الامر

(আমর এবং উলুল আমর)

আল্লাহ তায়ালা বলেন:

اَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اَطِیۡعُوا اللّٰهَ وَ اَطِیۡعُوا الرَّسُوۡلَ وَ اُولِی الۡاَمۡرِ مِنۡکُمۡ ۚ فَاِنۡ تَنَازَعۡتُمۡ فِیۡ شَیۡءٍ فَرُدُّوۡهُ اِلَی اللّٰهِ وَ الرَّسُوۡلِ اِنۡ کُنۡتُمۡ تُؤۡمِنُوۡنَ بِاللّٰهِ وَ الۡیَوۡمِ الۡاٰخِرِ ؕ ذٰلِکَ خَیۡرٌ وَّ اَحۡسَنُ تَاۡوِیۡلًا ٠

 হে মুমিনগণ, তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর ও আনুগত্য কর রাসূলের এবং তোমাদের মধ্য থেকে কর্তৃত্বের অধিকারীদের। অতঃপর কোন বিষয়ে যদি তোমরা মতবিরোধ কর তাহলে তা আল্লাহ ও রাসূলের দিকে প্রত্যার্পণ করাও- যদি তোমরা আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি ঈমান রাখ। এটি উত্তম এবং পরিণামে উৎকৃষ্টতর।

[সূরা আন নিসা:৫৯]

রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

 إِنَّ هَذَا الأَمْرَ فِي قُرَيْشٍ لاَ يُعَادِيهِمْ أَحَدٌ إِلاَّ كَبَّهُ اللهُ فِي النَّارِ عَلَى وَجْهِهِ مَا أَقَامُوا الدِّينَ٠٠٠

(খিলাফাতের) এ বিষয়টি কুরাইশদের মধ্যেই থাকবে, যদ্দিন তারা দ্বীনের উপর দৃঢ় থাকবে। যে কেউ তাদের বিরোধিতা করে তবে আল্লাহ্ তাকেই অধোমুখে নিপতিত করবেন।

[সহীহ্ আল বুখারী,কিতাবুল আহকাম,পরিচ্ছেদ: আমীর কুরাইশদের মধ্যে থেকে হবে। (بَاب الْأُمَرَاءُ مِنْ قُرَيْش)]

৫. امامة এবং امام

(ইমামাহ্ এবং ইমাম)

হাদীসে বর্ণিত আছে:

عَنْ ‏ ‏أَبِي هُرَيْرَةَ ‏ ‏عَنْ النَّبِيِّ ‏ ‏صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ‏ ‏قَالَ ‏ ‏إِنَّمَا الْإِمَامُ ‏ ‏جُنَّةٌ ‏ ‏يُقَاتَلُ مِنْ وَرَائِهِ وَيُتَّقَى بِهِ فَإِنْ أَمَرَ بِتَقْوَى اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ وَعَدَلَ كَانَ لَهُ بِذَلِكَ أَجْرٌ وَإِنْ يَأْمُرْ بِغَيْرِهِ كَانَ عَلَيْهِ مِنْهُ٠ ‏

আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন…

ইমাম হলো ঢাল স্বরূপ। তাঁর নেতৃত্বে যুদ্ধ এবং তাঁরই মাধ্যমে নিরাপত্তা অর্জন করা হয়। অতঃপর যদি সে আল্লাহর তাকওয়ার নির্দেশ দেয় এবং সুবিচার প্রতিষ্ঠা করে, তবে তার জন্য এর পুরস্কার রয়েছে আর যদি সে এর বিপরীত করে তবে এর মন্দ পরিণাম তার উপরই বর্তাবে।

[বুখারী, মুসলিম]

আল্লাহ তায়ালা বলেন:

اِذِ ابۡتَلٰۤی اِبۡرٰهٖمَ رَبُّهٗ بِکَلِمٰتٍ فَاَتَمَّهُنَّ ؕ قَالَ اِنِّیۡ جَاعِلُکَ لِلنَّاسِ اِمَامًا ؕ قَالَ وَ مِنۡ ذُرِّیَّتِیۡ ؕ قَالَ لَا یَنَالُ عَهۡدِی الظّٰلِمِیۡنَ ٠

এবং স্মরণ কর যখন ইবরাহীমকে তার প্রতিপালক কতিপয় বিষয়ে পরীক্ষা করলেন, অতঃপর সে সেগুলো পূর্ণ করল, তখন আল্লাহ বললেন, ‘আমি তোমাকে মানবজাতির নেতা মনোনীত করছি’। ইবরাহীম (আঃ) বললেন, ‘আর আমার বংশধর হতেও’? নির্দেশ হল, আমার অঙ্গীকার যালিমদের জন্য প্রযোজ্য নয়।

[সূরাহ আল বাকারাহ:১২৪]

৬. الامام الاعظم

(আল ইমামুল আ'জম)

ইমাম বুখারী বর্ণনা করেছেন:

حدثنا إسماعيل حدثني مالك عن عبد الله بن دينار عن عبد الله بن عمر رضي الله عنهما أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال : ( ألا كلكم راع وكلكم مسئول عن رعيته فالإمام الأعظم الذي على الناس راع وهو مسئول عن رعيته والرجل راع على أهل بيته وهو مسئول عن رعيته والمرأة راعية على أهل بيت زوجها وولده وهي مسئولة عنهم وعبد الرجل راع على مال سيده وهو مسئول عنه ألا فكلكم راع وكلكم مسئول عن رعيته ٠ 

আবদুল্লাহ ইবনু উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: জেনে রেখো! তোমাদের প্রত্যেকেই একজন দায়িত্বশীল; আর তোমরা প্রত্যেকেই নিজ অধীনস্থদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। অতএব প্রধান ইমাম যিনি জনগণের দায়িত্বশীল, তিনি তার অধীনস্থদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবেন। পুরুষ গৃহকর্তা তার পরিবারের দায়িত্বশীল; সে তার অধীনস্থদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। নারী তার স্বামীর পরিবার, সন্তান-সন্ততির উপর দায়িত্বশীল, সে এসব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। কোন ব্যাক্তির দাস স্বীয় মালিকের সম্পদের দায়িত্বশীল; সে এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। অতএব জেনে রাখ, প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং তোমাদের প্রত্যেকেই নিজ নিজ দায়িত্বাধীন বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।

[বুখারী]

[উল্লেখ্য, সহীহ্ আল বুখারীর (অন্য অনেক কিতাবেও) বিভিন্ন সংস্করণে হাদীসের শব্দের মধ্যে সামান্য কমবেশি আছে। যেমন উপরের হাদীসে فالامام الاعظم এর স্থলে কোন কোন সংস্করণে শুধু فالامام শব্দ এসেছে। আমি উপরের হাদীসটি (শাইখ ফুয়াদ আব্দুল বাকীর তারতীবে) কায়রোর দারুল হাদীস থেকে প্রকাশিত কিতাব থেকে উল্লেখ করেছি।... যাতে অন্য সংস্করণে সামান্য শাব্দিক পার্থক্য দৃষ্ট হলে কোন সংশয় সৃষ্টি না হয়।]   

৭. امام عامة

(ইমামুুন আম্মাহ্)

ইমাম বুখারী বর্ণনা করেছেন:

بَاب إِمَامَةِ الْمَفْتُونِ وَالْمُبْتَدِعِ

قَالَ أَبُو عَبْدِ اللَّهِ وَقَالَ لَنَا مُحَمَّدُ بْنُ يُوسُفَ حَدَّثَنَا الأَوْزَاعِيُّ، حَدَّثَنَا الزُّهْرِيُّ، عَنْ حُمَيْدِ بْنِ عَبْدِ الرَّحْمَنِ، عَنْ عُبَيْدِ اللَّهِ بْنِ عَدِيِّ بْنِ خِيَارٍ، أَنَّهُ دَخَلَ عَلَى عُثْمَانَ بْنِ عَفَّانَ ـ رضى الله عنه ـ وَهْوَ مَحْصُورٌ فَقَالَ إِنَّكَ إِمَامُ عَامَّةٍ، وَنَزَلَ بِكَ مَا تَرَى وَيُصَلِّي لَنَا إِمَامُ فِتْنَةٍ وَنَتَحَرَّجُ‏.‏ فَقَالَ الصَّلاَةُ أَحْسَنُ مَا يَعْمَلُ النَّاسُ، فَإِذَا أَحْسَنَ النَّاسُ فَأَحْسِنْ مَعَهُمْ، وَإِذَا أَسَاءُوا فَاجْتَنِبْ إِسَاءَتَهُمْ‏.‏ 

পরিচ্ছেদ: ফিতনাবাজ ও বিদ্‘আতীর ইমামাত।

وَقَالَ الْحَسَنُ صَلِّ وَعَلَيْهِ بِدْعَتُهُ.

হাসান (রহ.) বলেন, তাঁর পিছনেও সালাত আদায় করে নিবে। তবে বিদ্‌’আতের গুনাহ তার উপরই বর্তাবে।

আবূ আবদুল্লাহ্ (ইমাম বুখারী (রহ.) বলেন, আমাকে মুহাম্মাদ ইবনু ইউসুফ (রহ.) উবাইদুল্লাহ্ ইবনু আদী ইবনু খিয়ার (রহ.) হতে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি উসমান ইবনু আফফান (রাযি.) অবরুদ্ধ থাকার সময় তাঁর নিকট গিয়ে বললেন, আসলে আপনিই জনগণের ইমাম। আর আপনার বিপদ কী তা নিজেই বুঝতে পারছেন। আর আমাদের ইমামাত করছে বিদ্রোহীদের নেতা। ফলে আমরা গুনাহগার হবার ভয় করছি। তিনি বললেন, মানুষের ’আমলের মধ্যে সালাতই সর্বোত্তম। কাজেই লোকেরা যখন উত্তম কাজ করে, তখন তুমিও তাদের সাথে উত্তম কাজে অংশ নিবে, আর যখন তারা মন্দ কাজে লিপ্ত হয়, তখন তাদের মন্দ কাজ হতে বেঁচে থাকবে।

[সহীহ্ আল বুখারী,কিতাবুল আযান]

৮. تمكين (তামকীন) এবং এ শব্দের সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন শব্দ

আল কুরআনে এ শব্দের ক্রিয়ারূপ ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন, আল্লাহ তায়ালা যুলকরনাইন (আঃ)-কে পৃথিবীতে যে কর্তৃত্ব দান করেছিলেন সে সম্পর্কে বলেন:

اِنَّا مَکَّنَّا لَهٗ فِی الۡاَرۡضِ وَ اٰتَیۡنٰهُ مِنۡ کُلِّ شَیۡءٍ سَبَبًا ٠

আমি তাকে পৃথিবীতে কর্তৃত্ব দিয়েছিলাম এবং প্রত্যেক বিষয়ের উপায় ও পন্থা নির্দেশ করেছিলাম। 

[সূরাহ আল কাহাফ:৮৪]

আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন:

اَلَّذِیۡنَ اِنۡ مَّکَّنّٰهُمۡ فِی الۡاَرۡضِ اَقَامُوا الصَّلٰوۃَ وَ اٰتَوُا الزَّکٰوۃَ وَ اَمَرُوۡا بِالۡمَعۡرُوۡفِ وَ نَهَوۡا عَنِ الۡمُنۡکَرِ ؕ وَ لِلّٰهِ عَاقِبَۃُ الۡاُمُوۡرِ ٠

আমি তাদেরকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত করলে বা কর্তৃত্ব দান করলে তারা সালাত কায়েম করবে, যাকাত দিবে এবং সৎকাজের আদেশ করবে ও অসৎকাজ হতে নিষেধ করবে। সকল কাজের পরিণাম আল্লাহর ইখতিয়ারে। 

[সূরাহ আল হাজ্জ:৪১]

আর হাদীসে تمكين (তামকীন) শব্দের ব্যবহার এসেছে:

عَنْ أُبَيِّ بْنِ كَعْبٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بَشِّرْ هَذِهِ الْأُمَّةَ بِالسَّنَاءِ وَالرِّفْعَةِ وَالدِّينِ وَالتَّمْكِينِ فِي الْأَرْضِ فَمَنْ عَمِلَ مِنْهُمْ عَمَلَ الْآخِرَةِ لِلدُّنْيَا لَمْ يَكُنْ لَهُ فِي الْآخِرَةِ نَصِيبٌ. رواه أحمد وابن حبان في صحيحه والحاكم والبيهقي وقال الحاكم صحيح الإسناد

উবাই বিন কাব (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: এই উম্মতকে দ্বীনের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে সম্মান ও মর্যাদার সুসংবাদ দাও আর সুসংবাদ দাও পৃথিবীতে রাজত্ব-কর্তৃত্ব লাভের। সুতরাং যে ব্যাক্তি দুনিয়ার উদ্দেশ্যে আখেরাতের কাজ করবে, পরকালে তার জন্য কোনই অংশ থাকবে না।

[আহমাদ, ইবনে হিব্বান সহীহ গ্রন্থে, হাকেম ও বাইহাকী হাদীছটি বর্ণনা করেছেন]

বাইহাকীর অপর বর্ণনায় রয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:

بَشِّرْ هَذِهِ الْأُمَّةَ بِالتَّيْسِيرِ، وَالسَّنَاءِ، وَالرِّفْعَةِ فِي الدِّينِ، وَالتَّمْكِينِ فِي الْبِلَادِ، وَالنَّصْرِ، فَمَنْ عَمِلَ مِنْهُمْ عَمَلًا بِعَمَلِ الْآخِرَةِ لِلدُّنْيَا فَلَيْسَ لَهُ فِي الْآخِرَةِ مِنْ نَصِيبٍ

এই উম্মতকে সুসংবাদ দাও- সহজতা ও দ্বীনের মাধ্যমে আল্লাহর দরবারে উচ্চ মর্যাদা ও সম্মানের। আরো (সুসংবাদ দাও) দেশে দেশে কর্তৃত্ব-আধিপত্য প্রতিষ্ঠার ও বিজয় লাভের। সুতরাং যে ব্যাক্তি দুনিয়ার উদ্দেশ্যে আখেরাতের আমল করবে, তার জন্য পরকালে কোনই অংশ থাকবে না।

[আত্ তারগীব ওয়াত্ তারহীব: কিতাবুল ইখলাস]

৯. ملك এবং مالك

(মুলক এবং মালিক)

ইউসুফ (আঃ)-এর দুআ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন:

رَبِّ قَدۡ اٰتَیۡتَنِیۡ مِنَ الۡمُلۡکِ وَ عَلَّمۡتَنِیۡ مِنۡ تَاۡوِیۡلِ الۡاَحَادِیۡثِ ۚ فَاطِرَ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ ۟ اَنۡتَ وَلِیّٖ فِی الدُّنۡیَا وَ الۡاٰخِرَۃِ ۚ تَوَفَّنِیۡ مُسۡلِمًا وَّ اَلۡحِقۡنِیۡ بِالصّٰلِحِیۡنَ ٠

হে আমার প্রতিপালক! তুমি আমাকে রাজত্ব দান করেছ, আর আমাকে স্বপ্নের ব্যাখ্যা শিখিয়েছ। আসমান যমীনের সৃষ্টিকর্তা! তুমিই দুনিয়ায় আর আখেরাতে আমার অভিভাবক, তুমি মুসলিম অবস্থায় আমার মৃত্যু দান করো এবং আমাকে সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত করো। 

[সূরাহ ইউসুফ:১০১]

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা বলেন:

اَلَمۡ تَرَ اِلَی الۡمَلَاِ مِنۡۢ بَنِیۡۤ اِسۡرَآءِیۡلَ مِنۡۢ بَعۡدِ مُوۡسٰی ۘ اِذۡ قَالُوۡا لِنَبِیٍّ لَّهُمُ ابۡعَثۡ لَنَا مَلِکًا نُّقَاتِلۡ فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰهِ ؕ قَالَ هَلۡ عَسَیۡتُمۡ اِنۡ کُتِبَ عَلَیۡکُمُ الۡقِتَالُ اَلَّا تُقَاتِلُوۡا ؕ قَالُوۡا وَ مَا لَنَاۤ اَلَّا نُقَاتِلَ فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰهِ وَ قَدۡ اُخۡرِجۡنَا مِنۡ دِیَارِنَا وَ اَبۡنَآئِنَا ؕ فَلَمَّا کُتِبَ عَلَیۡهِمُ الۡقِتَالُ تَوَلَّوۡا اِلَّا قَلِیۡلًا مِّنۡهُمۡ ؕ وَ اللّٰهُ عَلِیۡمٌۢ بِالظّٰلِمِیۡنَ ٠ 

তুমি কি মূসার পরবর্তী বানী ইসরাঈলের প্রধানদের প্রতি লক্ষ্য করনি? তারা তাদের নাবীকে বলেছিল, ‘আমাদের জন্য একজন রাজা নিযুক্ত করুন, যাতে আমরা আল্লাহর পথে জিহাদ করি’। নির্দেশ হল, ‘এমন সম্ভাবনা আছে কি যে, যদি তোমাদেরকে যুদ্ধের বিধান দেয়া হয় তবে তোমরা যুদ্ধ  করবে না’? তারা বলল, ‘আমরা কী কারণে আল্লাহর পথে কিতাল করব না, যখন আমরা আমাদের গৃহ ও সন্তানাদি হতে বহিস্কৃত হয়েছি’। অতঃপর যখন তাদের প্রতি কিতালের হুকুম হল, তখন তাদের অল্প সংখ্যক লোক ছাড়া সকলেই পৃষ্ঠপ্রদর্শন করল! আর আল্লাহ যালিমদের সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞান রাখেন।

[সূরাহ আল বাকারাহ:২৪৬]

وَ قَالَ لَهُمۡ نَبِیُّهُمۡ اِنَّ اللّٰهَ قَدۡ بَعَثَ لَکُمۡ طَالُوۡتَ مَلِکًا ؕ قَالُوۡۤا اَنّٰی یَکُوۡنُ لَهُ الۡمُلۡکُ عَلَیۡنَا وَ نَحۡنُ اَحَقُّ بِالۡمُلۡکِ مِنۡهُ وَ لَمۡ یُؤۡتَ سَعَۃً مِّنَ الۡمَالِ ؕ قَالَ اِنَّ اللّٰهَ اصۡطَفٰىهُ عَلَیۡکُمۡ وَ زَادَهٗ بَسۡطَۃً فِی الۡعِلۡمِ وَ الۡجِسۡمِ ؕ وَ اللّٰهُ یُؤۡتِیۡ مُلۡکَهٗ مَنۡ یَّشَآءُ ؕ وَ اللّٰهُ وَاسِعٌ عَلِیۡمٌ ٠ 

আর তাদেরকে তাদের নবী বলল, নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের জন্য তালূতকে রাজারূপে পাঠিয়েছেন। তারা বলল, ‘আমাদের উপর কীভাবে তার রাজত্ব হবে, অথচ আমরা তার চেয়ে রাজত্বের অধিক হকদার? আর তাকে সম্পদের প্রাচুর্যও দেয়া হয়নি’। সে বলল, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তাকে তোমাদের উপর মনোনীত করেছেন এবং তাকে জ্ঞানে ও দেহে অনেক সমৃদ্ধ করেছেন। আর আল্লাহ যাকে চান, তাকে তাঁর রাজত্ব দান করেন। আর আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ’। 

[সূরাহ আল বাকারাহ:২৪৭]

আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন:

 وَ اِذۡ قَالَ مُوۡسٰی لِقَوۡمِهٖ یٰقَوۡمِ اذۡکُرُوۡا نِعۡمَۃَ اللّٰهِ عَلَیۡکُمۡ اِذۡ جَعَلَ فِیۡکُمۡ اَنۡۢبِیَآءَ وَ جَعَلَکُمۡ مُّلُوۡکًا ٭ۖ وَّ اٰتٰىکُمۡ مَّا لَمۡ یُؤۡتِ اَحَدًا مِّنَ الۡعٰلَمِیۡنَ ٠

আর যখন মূসা তার কওমকে বলল, হে আমার কওম! স্মরণ কর তোমাদের উপর আল্লাহর নিআমত, যখন তিনি তোমাদের মধ্যে নবী বানিয়েছেন এবং তোমাদেরকে রাজা-বাদশাহ বানিয়েছেন, আর তোমাদেরকে দান করেছেন এমন কিছু যা সকল সৃষ্টির মধ্যে কাউকে দান করেননি। 

[সূরাহ আল মায়িদাহ্:২০]

এছাড়াও হাদীসে মুলক (বা রাজত্ব) শব্দের ব্যবহার এসেছে। যেমন:

عَنْ ثَوْبَانَ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ‏ "‏ إِنَّ اللَّهَ زَوَى لِيَ الأَرْضَ فَرَأَيْتُ مَشَارِقَهَا وَمَغَارِبَهَا وَإِنَّ أُمَّتِي سَيَبْلُغُ مُلْكُهَا مَا زُوِيَ لِي مِنْهَا وَأُعْطِيتُ الْكَنْزَيْنِ الأَحْمَرَ وَالأَبْيَضَ وَإِنِّي سَأَلْتُ رَبِّي لأُمَّتِي أَنْ لاَ يُهْلِكَهَا بِسَنَةٍ بِعَامَّةٍ وَأَنْ لاَ يُسَلِّطَ عَلَيْهِمْ عَدُوًّا مِنْ سِوَى أَنْفُسِهِمْ فَيَسْتَبِيحَ بَيْضَتَهُمْ وَإِنَّ رَبِّي قَالَ يَا مُحَمَّدُ إِنِّي إِذَا قَضَيْتُ قَضَاءً فَإِنَّهُ لاَ يُرَدُّ وَإِنِّي أَعْطَيْتُكَ لأُمَّتِكَ أَنْ لاَ أُهْلِكَهُمْ بِسَنَةٍ بِعَامَّةٍ وَأَنْ لاَ أُسَلِّطَ عَلَيْهِمْ عَدُوًّا مِنْ سِوَى أَنْفُسِهِمْ يَسْتَبِيحُ بَيْضَتَهُمْ وَلَوِ اجْتَمَعَ عَلَيْهِمْ مَنْ بِأَقْطَارِهَا - أَوْ قَالَ مَنْ بَيْنَ أَقْطَارِهَا - حَتَّى يَكُونَ بَعْضُهُمْ يُهْلِكُ بَعْضًا وَيَسْبِي بَعْضُهُمْ بَعْضًا٠

সাওবান (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: আল্লাহ তা'আলা গোটা পৃথিবীকে সংকুচিত করে আমার সম্মুখে রেখে দিলেন। অতঃপর আমি এর পূর্বপ্রান্ত থেকে পশ্চিমপ্রান্ত পর্যন্ত প্রত্যক্ষ করেছি। পৃথিবীর যে অংশটুকু গুটিয়ে আমার সম্মুখে রাখা হয়েছিল সে পর্যন্ত আমার উম্মাতের কর্তৃত্ব পৌছবে। আমাকে লাল (স্বর্ণ) ও সাদা (রৌপ্য) দু’ প্রকারের গুপ্তধন দেয়া হয়েছে। আমি আমার উম্মাতের জন্য আমার রবের কাছে এ দুআ করেছি, যেন তিনি তাদেরকে সাধারণ দুর্ভিক্ষের দ্বারা ধ্বংস না করেন এবং যেন তিনি তাদের উপর নিজেদের ছাড়া এমন কোন শক্ৰকে চাপিয়ে না দেন যারা তাদের দলকে ভেঙ্গে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে দিবে। এ কথা শুনে আমার পালনকর্তা বললেন, হে মুহাম্মাদ! আমি যা সিদ্ধান্ত করি তা কখনো পরিবর্তন হয় না, আমি তোমার দুআ কবুল করেছি। আমি তোমার উম্মাতকে সাধারণ দুর্ভিক্ষের দ্বারা ধ্বংস করব না এবং তাদের উপর তাদের নিজেদের ছাড়া অন্য এমন কোন শত্রুকে চাপিয়ে দেব না যারা তাদের সমষ্টিকে বিক্ষিপ্ত ও ধ্বংস করতে সক্ষম হবে। যদিও পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত হতে লোক একত্রিত হয়ে প্রচেষ্টা করে না কেন। তবে মুসলিমগণ নিজেদের মধ্যে পরস্পর একে অপরকে হত্যা করবে এবং একে অপরকে বন্দী করবে।

[সহীহ্ মুসলিম:কিতাবুল ফিতান ওয়া আশরতুস সা'আহ্...,প্রায় অনুরূপ হাদীস তিরমিযীতেও বর্ণিত আছে, দেখুন - তিরমিযী:কিতাবুল ফিতান...]

এছাড়া সুনানু আবু দাউদের বর্ণনাটি নিম্নরূপ:

عَنْ ثَوْبَانَ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: إِنَّ اللَّهَ زَوَى لِي الْأَرْضَ - أَوْ قَالَ: إِنَّ رَبِّي زَوَى لِي الْأَرْضَ، فَرَأَيْتُ مَشَارِقَهَا وَمَغَارِبَهَا، وَإِنَّ مُلْكَ أُمَّتِي سَيَبْلُغُ مَا زُوِيَ لِي مِنْهَا، وَأُعْطِيتُ الْكَنْزَيْنِ الْأَحْمَرَ وَالْأَبْيَضَ، وَإِنِّي سَأَلْتُ رَبِّي لِأُمَّتِي أَنْ لَا يُهْلِكَهَا بِسَنَةٍ بِعَامَّةٍ، وَلَا يُسَلِّطَ عَلَيْهِمْ عَدُوًّا مِنْ سِوَى أَنْفُسِهِمْ، فَيَسْتَبِيحَ بَيْضَتَهُمْ، وَإِنَّ رَبِّي قَالَ لِي: يَا مُحَمَّدُ، إِنِّي إِذَا قَضَيْتُ قَضَاءً، فَإِنَّهُ لَا يُرَدُّ، وَلَا أُهْلِكُهُمْ بِسَنَةٍ بِعَامَّةٍ، وَلَا أُسَلِّطُ عَلَيْهِمْ عَدُوًّا مِنْ سِوَى أَنْفُسِهِمْ، فَيَسْتَبِيحَ بَيْضَتَهُمْ، وَلَوِ اجْتَمَعَ عَلَيْهِمْ مِنْ بَيْنِ أَقْطَارِهَا - أَوْ قَالَ بِأَقْطَارِهَا - حَتَّى يَكُونَ بَعْضُهُمْ يُهْلِكُ بَعْضًا، وَحَتَّى يَكُونَ بَعْضُهُمْ يَسْبِي بَعْضًا، وَإِنَّمَا أَخَافُ عَلَى أُمَّتِي الْأَئِمَّةَ الْمُضِلِّينَ، وَإِذَا وُضِعَ السَّيْفُ فِي أُمَّتِي لَمْ يُرْفَعْ عَنْهَا إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ، وَلَا تَقُومُ السَّاعَةُ حَتَّى تَلْحَقَ قَبَائِلُ مِنْ أُمَّتِي بِالْمُشْرِكِينَ، وَحَتَّى تَعْبُدَ قَبَائِلُ مِنْ أُمَّتِي الْأَوْثَانَ، وَإِنَّهُ سَيَكُونُ فِي أُمَّتِي كَذَّابُونَ ثَلَاثُونَ، كُلُّهُمْ يَزْعُمُ أَنَّهُ نَبِيٌّ، وَأَنَا خَاتَمُ النَّبِيِّينَ لَا نَبِيَّ بَعْدِي، وَلَا تَزَالُ طَائِفَةٌ مِنْ أُمَّتِي عَلَى الْحَقِّ - قَالَ ابْنُ عِيسَى: ظَاهِرِينَ ثُمَّ اتَّفَقَا - لَا يَضُرُّهُمْ مَنْ خَالَفَهُمْ، حَتَّى يَأْتِيَ أَمْرُ اللَّهِ صحيح

সাওবান (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ (অথবা) আমার রব পৃথিবীকে আমার জন্য সংকুচিত করে দিয়েছেন এবং আমাকে এর পূর্ব ও পশ্চিম সীমানা দেখানো হয়েছে। আর যুতটুকু আমার জন্য সংকুচিত করা হয়েছে, ততটুকুতে অচিরেই আমার উম্মাতের রাজত্ব বিস্তার লাভ করবে। আমাকে লাল ও সাদা (স্বর্ণ ও রূপার) দু’টি ধনভাণ্ডার দেয়া হয়েছে। আর আমি আমার মহান প্রতিপালকের নিকট আমার উম্মাতের জন্য এই কথার আবেদন করছি যে, তিনি তাদের সবাইকে যেন দুর্ভিক্ষে ধ্বংস না করেন এবং তাদের নিজেদের ব্যতীত কোনো শত্রু যেন তাদের উপর কর্তৃত্ব করতে না পারে যারা তাদের ধ্বংস করে দিবে।

নিশ্চয়ই আমার রব আমাকে বলেছেন, হে মুহাম্মাদ! আমি যা ফায়সালা করি, তা বাতিল হয় না। তবে আমি তাদের সবাইকে একসঙ্গে দুর্ভিক্ষে ধ্বংস করবো না এবং তাদের নিজেদের ছাড়া দিকবিদিক থেকে আগত তাদের সমূলে বিনাশকারী বিধর্মী শত্রুকে তাদের উপর কর্তৃত্ব করতে দিবো না, তবে তাদের কতক অপরদের ধ্বংস করবে এবং কতক অপরকে বন্দী করবে।

আর আমি আমার উম্মাতের পথভ্রষ্ট নেতাদের ব্যাপারে শঙ্কিত। আমার উম্মত যখন পরস্পর যুদ্ধে লিপ্ত হবে, তখন কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তারা বিরত হবে না। আর আমার উম্মাতের কিছু সংখ্যক মুশরিকদের সঙ্গে মিলিত না হওয়া পর্যন্ত এবং আমার উম্মাতের কতিপয় গোত্র মূর্তি পূজায় লিপ্ত না হওয়া পর্যন্ত কিয়ামত সংঘটিত হবে না। অবিলম্বে আমার উম্মাতের মধ্যে ত্রিশজন মিথ্যাবাদীর আবির্ভাব ঘটবে, তাদের প্রত্যেকেই নিজেকে নবী বলে দাবী করবে। অথচ আমিই সর্বশেষ নবী এবং আমার পরে আর কোনো নবী আসবে না। তবে আমার উম্মাতের একটি দল সর্বদা সত্যের উপর অটল থাকবে। যারা তাদের বিরোধিতা করবে, তারা তাদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না, এমন কি এ অবস্থায় আল্লাহর নির্দেশ (কিয়ামত) এসে যাবে।

[আবু দাউদ:কিতাবুল ফিতান ওয়াল মালাহিম(সহীহ)]

রাসূলুল্লাহ (সঃ) আরো বলেছেন:

 الخلافة بعدي ثلاثون سنة ، ثم يكون ملكا عضوضا٠

আমার (ইন্তেকালের) পরে ত্রিশ বছর পর্যন্ত খিলাফত থাকবে, তারপর দন্তকর্তিত রাজ্য হয়ে যাবে। 

[এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ), ইমাম আবু দাউদ (রঃ), ইমাম তিরমিযী (রঃ) এবং ইমাম নাসাঈ (রঃ) প্রমুখ বর্ণনা করেছেন।]

উল্লেখ্য, উক্ত ৩০ বছর ছিল ইসলামী খিলাফাহর আসল রূপ এবং স্বর্ণযুগ  'খুলাফাউ রশিদীন'। এরপরও বহু বছর ইসলামী শাসন ব্যবস্থা ছিল,তবে তা ঐরূপ ছিল না। যদিও তা ছিল ইসলামী শাসন ও রাজত্ব। অবশ্য উম্মাহর ইমামগণ এবং উম্মাহ  এটাকেও খিলাফাহ নামে অভিহিত করেছেন। কেননা, তা মোটাদাগে ইসলামী শাসন ব্যবস্থাই ছিল, এবং রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদীস থেকেও তা প্রমাণিত হয়। 

যেমন ইমাম বুখারী বর্ণনা করেছেন:

حَدَّثَنِيْ مُحَمَّدُ بْنُ بَشَّارٍ حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ جَعْفَرٍ حَدَّثَنَا شُعْبَةُ عَنْ فُرَاتٍ الْقَزَّازِ قَالَ سَمِعْتُ أَبَا حَازِمٍ قَالَ قَاعَدْتُ أَبَا هُرَيْرَةَ خَمْسَ سِنِيْنَ فَسَمِعْتُهُ يُحَدِّثُ عَنْ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ كَانَتْ بَنُوْ إِسْرَائِيْلَ تَسُوْسُهُمْ الأَنْبِيَاءُ كُلَّمَا هَلَكَ نَبِيٌّ خَلَفَهُ نَبِيٌّ وَإِنَّهُ لَا نَبِيَّ بَعْدِيْ وَسَيَكُوْنُ خُلَفَاءُ فَيَكْثُرُوْنَ قَالُوْا فَمَا تَأْمُرُنَا قَالَ فُوْا بِبَيْعَةِ الأَوَّلِ فَالأَوَّلِ أَعْطُوْهُمْ حَقَّهُمْ فَإِنَّ اللهَ سَائِلُهُمْ عَمَّا اسْتَرْعَاهُمْ ٠

(كتاب أحاديث الأنبياء:صحيح البخارى)

আবূ হাযিম (রহ.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি পাঁচ বছর যাবৎ আবূ হুরাইরাহ্ (রাঃ)-এর সাহচর্যে ছিলাম। তখন আমি তাঁকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে হাদীস বর্ণনা করতে শুনেছি যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, বনী ইসরাঈলের নবীগণ তাঁদের উম্মাতকে শাসন করতেন। যখন কোন একজন নবী মারা যেতেন, তখন অন্য একজন নবী তাঁর স্থলাভিষিক্ত হতেন। আর আমার পরে কোন নবী (আঃ) নেই। তবে অনেক খলীফাহ্ হবে। সহাবাগণ (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি আমাদেরকে কী নির্দেশ করছেন? তিনি বললেন, তোমরা একের পর এক তাদের বাইআতের হক আদায়/পূর্ণ করবে। তোমাদের উপর তাদের যে হক রয়েছে তা আদায় করবে। আর নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তাঁদেরকে জিজ্ঞেস করবেন ঐ সকল বিষয়ে যে সবের দায়িত্ব তাদের উপর অর্পণ করা হয়েছিল।

[সহীহ্ আল বুখারী:কিতাবু আহাদীসিল আম্বিয়া; এছাড়াও হাদীসটি সহীহ্ মুসলিম ও অন্যান্য কিতাবে বর্ণিত আছে।]

পূর্ববর্তী ইমামগণও এসব হাদীসের ভিত্তিতে খুলাফায়ি রশিদীনের পরের বৈশ্বিক ইসলামী রাষ্ট্রকে খিলাফাহ্ এবং এর পরিচালকদেরকে খলীফাহ্ হিসাবে গণ্য করেছেন।

[এ বিষয়ে বিস্তারিত দেখুন: শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়াহ প্রণীত - আল খিলাফাতু ওয়াল মুলক... ইত্যাদি]

১০. حكم এবং حاكم

(হুকম এবং হাকিম) 

এর ব্যবহার এসেছে। যেমন,আল্লাহ তায়ালা বলেন:

وَ مَنۡ لَّمۡ یَحۡکُمۡ بِمَاۤ اَنۡزَلَ اللّٰهُ فَاُولٰٓئِکَ هُمُ الۡکٰفِرُوۡنَ ٠

...আল্লাহ যা নাযিল করেছেন, সে অনুযায়ী যারা বিধান দেয় না বা বিচার ফায়সালা করে না তারাই কাফির। 

[সূরাহ আল মায়িদাহ্: ৪৪]

এছাড়াও এসব শব্দ সহীহ্ বুখারীসহ বিভিন্ন  কিতাবে শাসক অর্থেও ব্যবহৃত হয়েছে। 

যেমন, ইমাম বুখারী (রহঃ) একটি বাব বা অনুচ্ছেদ উল্লেখ করেছেন:

بَاب كِتَابِ الْحَاكِمِ إِلَى عُمَّالِهِ وَالْقَاضِي إِلَى أُمَنَائِهِ

(বিভিন্ন দায়িত্বে নিয়োজিত)কর্মকর্তাদের নিকট শাসনকর্তার পত্র এবং সচিবদের নিকট বিচারকের পত্র।

[এ অধ্যায়ে ইমাম বুখারী সংশ্লিষ্ট হাদীস বর্ণনা করেছেন। দ্রঃ সহীহ্ আল বুখারী,কিতাবুল আহকাম]

১১. خليفة المسلمين  

(খলীফাতুল মুসলিমীন)

এবং 

১২. امير المؤمنين

(আমীরুল মু'মিনীন)

...এসব শব্দ ও পরিভাষা সাহাবায়ি কিরাম (রাঃ) ব্যাপকভাবে ব্যবহার করতেন,যা বিভিন্ন হাদীস এবং তাঁদের জীবনী গ্রন্থসমূহে বর্ণিত আছে।

১৩. راع এবং رعية 

যেমন সহীহ্ আল বুখারীতে বর্ণিত আছে: 

عَنْ الْحَسَنِ أَنَّ عُبَيْدَ اللهِ بْنَ زِيَادٍ عَادَ مَعْقِلَ بْنَ يَسَارٍ فِي مَرَضِهِ الَّذِي مَاتَ فِيهِ فَقَالَ لَهُ مَعْقِلٌ إِنِّي مُحَدِّثُكَ حَدِيثًا سَمِعْتُهُ مِنْ رَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم سَمِعْتُ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ مَا مِنْ عَبْدٍ اسْتَرْعَاهُ اللهُ رَعِيَّةً فَلَمْ يَحُطْهَا بِنَصِيحَةٍ إِلاَّ لَمْ يَجِدْ رَائِحَةَ الْجَنَّةِ ٠

হাসান বাসরী (রহ.) হতে বর্ণিত যে, উবাইদুল্লাহ্ ইবনু যিয়াদ (রহ.) মাকিল ইবনু ইয়াসারের মৃত্যুশয্যায় তাকে দেখতে গেলেন। তখন মাকিল (রাঃ) তাকে বললেন, আমি তোমাকে এমন একটি হাদীস বর্ণনা করছি যা আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে শুনেছি। আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে শুনেছি যে, কোন বান্দাকে যদি আল্লাহ্ জনগণের নেতৃত্ব প্রদান করেন, আর সে কল্যাণ কামনার সঙ্গে তাদের তত্ত্বাবধান না করে, তাহলে সে জান্নাতের ঘ্রাণও পাবে না।

[সহীহ্ আল বুখারী:কিতাবুল আহকাম]

সহীহ্ আল বুখারীতে আরো বর্ণিত আছে: 

عَنْ عَبْدِ اللهِ أَنَّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ كُلُّكُمْ رَاعٍ فَمَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ فَالأَمِيرُ الَّذِي عَلَى النَّاسِ رَاعٍ وَهُوَ مَسْئُولٌ عَنْهُمْ وَالرَّجُلُ رَاعٍ عَلَى أَهْلِ بَيْتِهِ وَهُوَ مَسْئُولٌ عَنْهُمْ وَالْمَرْأَةُ رَاعِيَةٌ عَلَى بَيْتِ بَعْلِهَا وَوَلَدِهِ وَهِيَ مَسْئُولَةٌ عَنْهُمْ وَالْعَبْدُ رَاعٍ عَلَى مَالِ سَيِّدِهِ وَهُوَ مَسْئُولٌ عَنْهُ أَلاَ فَكُلُّكُمْ رَاعٍ وَكُلُّكُمْ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ ٠

আবদুল্লাহ [ইবনু উমার (রাঃ)] হতে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল। কাজেই প্রত্যেকেই নিজ অধীনস্থদের বিষয়ে জিজ্ঞাসার সম্মুখীন হবে। যেমন- জনগণের শাসক তাদের দায়িত্বশীল, কাজেই সে তাদের বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে। একজন পুরুষ তার পরিবার পরিজনের দায়িত্বশীল, কাজেই সে তাদের বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে। স্ত্রী স্বামীর ঘরের এবং তার সন্তানের দায়িত্বশীল, কাজেই সে তাদের বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে। আর ক্রীতদাস আপন মনিবের সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণকারী। কাজেই সে বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে। শোন! তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল। কাজেই প্রত্যেকেই আপন অধীনস্থদের বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে।

[সহীহ্ আল বুখারী: ক্রীতদাস আযাদ করা (كتاب العتق)]

এছাড়াও এ বিষয়ে ক্ষেত্রবিশেষে - ولى/ولاية -ورثة/وارث / ميراث এবং আরো কিছু শব্দের ব্যবহার পাওয়া যায়।  

উল্লিখিত পরিভাষা সমূহের ব্যবহার সম্পর্কিত বিবেচ্য বিষয় এবং সংশ্লিষ্ট হুকুম:

খলীফাহ্কে ইমাম, আমীর, নেতা, শাসক, সুলতন, রাজা, বাদশাহ ইত্যাদি উপাধিতে ভূষিত করা যেতে পারে। এছাড়াও আরো অনেক শব্দ ও পরিভাষা খলীফাহ্ শব্দের সমার্থক হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। 

এ বিষয়ে উল্লখযোগ্য ইমামগণের বক্তব্যের অংশবিশেষ উল্লেখ করছি: 

قال النَّوَويُّ: يَجوزُ أن يُقال للإمامِ: الخَليفةُ، والإمامُ، وأميرُ المُؤمنين٠

অর্থাৎ, ইমাম নববী (রহঃ) বলেন: ইমামকে খলীফাহ্, ইমাম, আমীরুল মুমিনীন ইত্যাদি নামে অভিহিত করা যায়।

[روضة الطالبين]

وقال ابنُ خَلدونِ: وإذ قد بَيَّنَّا حَقيقةَ هذا المَنْصِبِ، وأنَّه نيابةٌ عن صاحِبِ الشَّريعةِ في حِفظِ الدِّينِ وسياسةِ الدُّنيا به، تَسَمَّى خِلافةً وإمامةً، والقائِمُ به خَليفةً وإمامًا٠

ইবনু খালদুন (রহঃ) বলেন: যেহেতু আমরা এই অবস্থানের বাস্তবতাকে স্পষ্ট করে দিয়েছি, এই খিলাফাহর মাধ্যমে শরীয়তের মালিকের পক্ষ থেকে দ্বীনের হিফাজত এবং  বিশ্বের রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়, তাই একে বলা হয় খিলাফত ও ইমামত, আর এর দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে বলা হয় খলিফাহ্ এবং ইমাম। 

(مقدمة ابن خلدون)

وقال ابنُ منظورٍ: الخِلافةُ: الإمارةُ٠

ইবনু মানযুর (রহঃ) বলেন: 

খিলাফাহ্ হলো:শাসন কর্তৃত্ব-নেতৃত্ব।

[لسان العرب]

وقال مُحَمَّد رَشيد رِضا: الخِلافةُ، والإمامةُ العُظمَى، وإمارةُ المُؤمنين، ثَلاثُ كلِماتٍ مَعناها واحِدٌ، وهو رِئاسةُ الحُكومةِ الإسلاميَّةِ الجامِعةِ لمَصالِحِ الدِّين والدُّنيا٠

মুহাম্মাদ রশীদ রিযা (রহঃ) বলেন: খিলাফাহ্, ইমামাতুল উজমা, ইমারাতুল মুমিনীন এ তিনটি শব্দের অর্থ একই; আর তা হলো: দীন ও দুনিয়ার কল্যাণের লক্ষ্যে ইসলামী হুকুমাতের সামগ্রিক নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব।

[الخلافة]

[বিস্তারিত দ্রঃ...

 الامامة العظمى عند اهل السنة والجماعة٠

مساءل في فقه الخلافة ٠

ইত্যাদি কিতাব।]

আল কুরআন, হাদীস এবং ফিকহ্ ও আহকামের কিতাব সমূহে খিলাফাহ্ ও 

খলীফাহ্ শব্দ/পরিভাষার যতগুলো সমার্থক শব্দ ও পরিভাষা আমরা উল্লেখ করেছি এগুলোর কোন একটা বা সবগুলোই ব্যবহার করা যায়। এক্ষেত্রে প্রত্যেকটির সক্ষমতা, মান,উপযোগিতা ও বাস্তবে বিদ্যমান থাকা ইত্যাদি বিবেচনায় রাখতে হবে। 

কিন্তু শারীআহতে বিশেষভাবে এর কোন একটি পরিভাষার ব্যবহারকে ওয়াজিব করা হয়নি।

উল্লেখ্য, খিলাফাহ্ ও খলীফাহ্ শব্দ যেমন ছোট থেকে বড় বিভিন্ন কর্তৃত্ব বুঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে, তেমনি এর সমার্থক অন্যান্য শব্দ বা পরিভাষাসমূহও বহুবিধ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এ ব্যাপারে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো স্মরণ রাখা যেতে পারে:

- এই সকল শব্দ ও পরিভাষার যথাযথ প্রয়োগ ও ব্যবহার বৈধ।

- এসব শব্দের কোন একটা বা একাধিক (বিশেষভাবে) প্রয়োগ করা ওয়াজিব নয়।

- এগুলো প্রায় একই অর্থে ব্যবহৃত হওয়া সত্ত্বেও এগুলোর পারস্পরিক স্বাতন্ত্র্য ও কিছুটা ভিন্নতা আছে। 

- এর যে কোন শব্দের দাবি বা প্রয়োগের জন্য প্রয়োজন ঐ শব্দের বাস্তব রূপ 

- যদি কোন শব্দ বা পরিভাষার বাস্তব রূপ না থাকে তবে (তখন) তা দাবি করা যাবে না। আর বাস্তবে না থাকায় তার দাবি করলে তা হবে মিথ্যা ও প্রতারণা। 

- কেউ তা দাবি করলেও তা কেবল আভিধানিক অর্থে প্রযোজ্য হবে। কেননা, এগুলো নিছক শাব্দিক বা আভিধানিক ও রূপক অর্থেও ব্যবহৃত হয়ে থাকে বা হতে পারে; তখন একে পারিভাষিক অর্থের মত মনে করা যাবে না,অর্থাৎ প্রকৃত অর্থে গণ্য করা যাবে না। 

যেমন: প্রায় লোকই একটা বাড়ির মালিক কিংবা একখণ্ড জমির মালিক হতে পারে। এক্ষেত্রে উক্ত বাড়ি বা জমির মালিককে 'মালিক' বলা যায় এবং এই জমিকেও তো আরবিতে 'আরদ' বলা হয়; কিন্তু এমন অজ্ঞ কে আছে যে এই জমি/ভূমির মালিকানাকে জমিনের খিলাফাহ্ এবং নিজেকে খলীফাহ্ বলবে? 

আর সাধারণত প্রত্যেক ব্যক্তিই পৃথিবীতে কিছু না কিছুর মালিক এবং কোটি কোটি মানুষ পৃথিবীর কিছু কিছু জমির মালিক। আর পৃথিবীর কিছু জমি তো পৃথিবীই; অন্য কিছু নয়। সুতরাং এ কারণে তারা কি নিজেদেরকে পৃথিবীর/জমিনের মালিক বা খলীফাহ্ বলবে? এরূপ কিছু জমির মালিক নিজেকে খলীফাহ্ বলা তো দূরের কথা, এমনকি নিজেকে জমিদার বলেও দাবি করবে না। কারণ, জমিদার হওয়ার জন্যও অনেক জমি/ভূমির মালিক বা অধিকারী হতে হয়।

খলীফাহ্ অর্থ বাংলায় স্থলাভিষিক্ত, প্রতিনিধি বা পরিচালক... ইত্যাদি হয়ে থাকে; একারণে কোন প্রতিষ্ঠানের পরিচালক বা প্রতিনিধি কি নিজেকে খলীফাহ্ বলবেন? 

তেমনিভাবে, কোন জমিদার, যে অনেক জমির মালিক, কিংবা ছোট ছোট রাজ্য বা দেশের পরিচালক কি নিজেকে খলীফাহ্ মনে করবে?

আসলে, পূর্বোক্ত কোন কিছুর/জমির মালিক বা অধিকারী হলেই যেমন কেউ খলীফাহ্ হয়না, তেমনি খলীফাহ্ হওয়ার জন্য সারা পৃথিবীর সমস্ত ভূমির মালিকানা থাকতে হবে বা অর্জন করতে হবে এমন কোন শর্তও শারীয়াহ্ আরোপ করেনি। 

অর্থাৎ,পূর্বোক্ত কিছুর মালিকানা বা কর্তৃত্বকে যেমন খিলাফাহ্ বলা হয় না, তেমনি খিলাফাহ্ হওয়ার জন্য সারা পৃথিবীর কর্তৃত্ব লাগবে এমনও নয়। বরং শারঈ বিধানে যতটুকু কর্তৃত্ব অর্জন করা খিলাফাহর জন্য জরুরি ততটুকু অর্জন করতে হবে। এটা নিছক দাবি করার বিষয় নয় এবং এরূপ দাবি করার কোন প্রয়োজনও নেই। 

কারণ, যদি এজন্য যথাযথ কর্তৃত্ব অর্জিত হয়ে থাকে তখন/তাহলে তা বাস্তবেই দেখা যাবে, তা প্রয়োগ করার কারণে। আর যদি বাস্তবে এরূপ না হয় তবে তা দাবি করা হলে তা হবে শারঈ বিধান অনুযায়ী মিথ্যা, প্রতারণা, ধোঁকাবাজি, অন্যায়; নিঃসন্দেহে এটা শারীআহ্-বাস্তবতা-বিবেক-বুদ্ধি-যুক্তিবিরোধী। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে সকল অন্যায় থেকে হিফাজত করুন।

  

     খিলাফাহ্-এর স্বরূপ:

প্রকৃতপক্ষে খিলাফাহ্ কী?

খিলাফাহ্-এর প্রকৃত রূপ কী?

কী কী বৈশিষ্ট্য থাকলে কোন ইমারাহ্কে খিলাফাহ্ বলা যায়?

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা প্রদত্ত ওয়াদা খিলাফাহর কাঙ্ক্ষিত ও প্রকৃত স্বরূপ স্পষ্ট করতে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো সম্পর্কে আমরা আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ... 

- সূরাহ আন নূর-এর ৫৫ আয়াতের পূর্ববর্তী প্রেক্ষাপট  

- সূরাহ আন নূর-এর ৫৫ আয়াত নাযিলের সমকালীন, সংশ্লিষ্ট ও সামগ্রিক প্রেক্ষাপট 

- সূরাহ আন নূর-এর ৫৫ আয়াতে বর্ণিত কাঙ্ক্ষিত খিলাফাহর প্রাথমিক স্বরূপ এবং ক্রমবিকাশ ও বিস্তৃতি 

- পরবর্তিতে (শত শত বছর পর) উক্ত খিলাফাহর (ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব) ক্রমান্বয়ে হ্রাসপ্রাপ্তি এবং (অবশেষে) চূড়ান্ত বিলুপ্তির পর উম্মাহর বর্তমান অবস্থা এবং বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট

- সূরাহ আন নূর-এর ৫৫ আয়াত ও রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদীসে বর্ণিত (পুনরায় আগত) খিলাফাহর কাঙ্ক্ষিত রূপ 

- কিয়ামতের পূর্বে সারা পৃথিবীতে কেবল আল্লাহর দীনের সর্বশেষ ও চূড়ান্ত বিজয়ের স্বরূপ ... ইত্যাদি। 

নিবন্ধের শুরুতেই আমরা উল্লেখ করেছি যে, খিলাফাহর বাস্তব রূপ যখন ছিল তখন তা সবার সামনেই ছিল এবং এর উপলব্ধিও সবার ছিল; বিধায় এর বস্তুগত কাঠামোর বর্ণনা দেয়ার কোন প্রয়োজন তখন ছিল না।  তের/চৌদ্দশ বছর পর বা খিলাফাহ্ বিলুপ্ত হওয়ার পর এখন কতটুকু ভূমি ও কর্তৃত্ব পুনরায়/নতুনভাবে অর্জিত হলে তাকে খিলাফাহ্ বলা যায় - তা নির্ণয় করতে হবে। বর্তমান যুগের মানুষের উপলব্ধির জন্য এর কোন বিকল্প নেই; অন্যথায় অনেক অজ্ঞ ও অনভিজ্ঞ লোক কিছু দিন পর পর সামান্য কিছু ভূমি/কর্তৃত্ব পেয়ে খেই হারিয়ে ফেলে নানান দাবি করতে পারে! 

এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সচেতন হতে হবে। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে সকল বিষয়ে যথাযথ ইলম-বুঝ ও আমল করার তাওফীক দান করুন।   

খিলাফাহ্ ও খলীফাহ্ সম্পর্কে আমাদের আলোচ্য বিষয়ে সবচেয়ে বেশি প্রাসঙ্গিক যে আয়াতটি নিয়ে আমরা প্রথমেই আলোচনা করতে পারি তা হলো:

وَعَدَ اللّٰهُ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا مِنۡکُمۡ وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ لَیَسۡتَخۡلِفَنَّهُمۡ فِی الۡاَرۡضِ کَمَا اسۡتَخۡلَفَ الَّذِیۡنَ مِنۡ قَبۡلِهِمۡ ۪ وَ لَیُمَکِّنَنَّ لَهُمۡ دِیۡنَهُمُ الَّذِی ارۡتَضٰی لَهُمۡ وَ لَیُبَدِّلَنَّهُمۡ مِّنۡۢ بَعۡدِ خَوۡفِهِمۡ اَمۡنًا ؕ یَعۡبُدُوۡنَنِیۡ لَا یُشۡرِکُوۡنَ بِیۡ شَیۡئًا ؕ وَ مَنۡ کَفَرَ بَعۡدَ ذٰلِکَ فَاُولٰٓئِکَ هُمُ الۡفٰسِقُوۡنَ ٠

তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান আনে এবং সৎকর্ম করে আল্লাহ তাদেরকে এ মর্মে ওয়াদা দিয়েছেন যে, তিনি নিশ্চিতভাবে তাদেরকে জমিনের প্রতিনিধিত্ব প্রদান করবেন, যেমন তিনি প্রতিনিধিত্ব প্রদান করেছিলেন তাদের পূর্ববর্তীদেরকে এবং তিনি অবশ্যই তাদের জন্য শক্তিশালী ও সুপ্রতিষ্ঠিত করবেন তাদের দীনকে, যা তিনি তাদের জন্য পছন্দ করেছেন এবং তিনি তাদের ভয়-ভীতির পর একে শান্তি-নিরাপত্তায় পরিবর্তিত করে দেবেন। তারা কেবল আমারই ইবাদাত করবে, আমার সাথে কোন কিছুকে শরীক করবে না। আর এরপর যারা কুফরী করবে তারাই ফাসিক। [সূরাহ আন নূর:৫৫]

হাদীস,তাফসীর ও বিভিন্ন কিতাবে বর্ণিত এ আয়াত সংশ্লিষ্ট আলোচনা:

উবাই ইবনে কা'ব (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তার সাহাবীগণ (রাঃ) যখন মদীনায় আগমন করলেন এবং আনসারগণ তাদেরকে আশ্রয় দিলেন, তখন সমস্ত আরব এক বাক্যে তাদের শত্রুতে পরিণত হলো। সাহাবাগণ তখন রাতদিন অস্ত্ৰ নিয়ে থাকতেন। তখন তারা বললেন: আমরা কি কখনো এমনভাবে বাঁচতে পারবো যে, আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে ভয় না করে সন্তুষ্ট চিত্তে ঘুমাতে পারবো? তখন এ আয়াত নাযিল হয়। 

[দ্রঃ তাফসীর ইবনে কাসীর, তাফসীর কুরতুবী, তবারনী:আওসাত, হাকিম: আল মুসতাদরাক...ইত্যাদি।]

রসূলুল্লাহ (সঃ)-এর হিজরতের পর তাঁরই নেতৃত্বে মাদীনাহ্ ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে পরিচালিত হচ্ছিল। এরপর (একপর্যায়ে) আল্লাহ তায়ালা খিলাফাহর ওয়াদা সম্বলিত আয়াত (২৪:৫৫) অবতীর্ণ করলেন। একটু পূর্বেই এ আয়াত এবং এর অনুবাদ ও অবতীর্ণ হওয়ার প্রেক্ষাপট উল্লেখ করেছি। 

এ আয়াতের তাফসীরে ইমাম ইবনু কাসীর, ইমাম কুরতুবী, ইমাম ইবনু জারীর (রহঃ) সহ প্রায় সকল মুফাসসির বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। 

এ আয়াতের তাফসীরে ইমাম ইবনু কাসীর (রহঃ) যে আলোচনা করেছেন তা (সম্পূর্ণ আরবী ইবারত) উল্লেখ না করে শুধু অনুবাদ উল্লেখ করা হলো। তবে এর শুরুর কয়েক লাইন (আরবী ইবারত) উল্লেখ করছি:...

هذا وعد من الله لرسوله صلى الله عليه وسلم . بأنه سيجعل أمته خلفاء الأرض ، أي : أئمة الناس والولاة عليهم ، وبهم تصلح البلاد ، وتخضع لهم العباد ، وليبدلن بعد خوفهم من الناس أمنا وحكما فيهم ، وقد فعل تبارك وتعالى ذلك . وله الحمد والمنة ، فإنه لم يمت رسول الله صلى الله عليه وسلم حتى فتح الله عليه مكة وخيبر والبحرين ، وسائر جزيرة العرب وأرض اليمن بكمالها . وأخذ الجزية من مجوس هجر ، ومن بعض أطراف الشام ، وهاداه هرقل ملك الروم وصاحب مصر والإسكندرية - وهو المقوقس - وملوك عمان والنجاشي ملك الحبشة ، الذي تملك بعد أصحمة  رحمه الله وأكرمه

ثم لما مات رسول الله صلى الله عليه وسلم واختار الله له ما عنده من الكرامة ، قام بالأمر بعده خليفته أبو بكر الصديق

...শেষ পর্যন্ত। 

(আগ্রহী পাঠকগণ উল্লিখিত কিতাব সমূহে বর্ণিত সম্পূর্ণ আরবী ইবারত দেখে নিতে পারেন। তাই পূর্ণ ইবারত উল্লেখ না করে শুধু অনুবাদ পেশ করা হলো:) 

 

আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা'আলা স্বীয় রসূল (সঃ)-এর সাথে ওয়াদা করছেন যে, তিনি তাঁর উম্মতকে জমিন/পৃথিবীর মালিক/শাসক বানিয়ে দিবেন, তাদেরকে তিনি লোকদের নেতা করবেন এবং দেশ তাদের দ্বারা জনবসতিপূর্ণ হবে। আল্লাহর বান্দারা তাদের প্রতি সন্তুষ্ট থাকবে। আজ মুসলিমরা শত্রুদের  ব্যাপারে ভীত-সন্ত্রস্ত রয়েছে, কাল তারা পূর্ণ নিরাপত্তা লাভ করবে। হুকুমত তাদের হবে এবং তারাই হবে সাম্রাজ্যের পরিচালক। 

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর যে, হয়েছেও তাই। মক্কা, খায়বার, বাহরাইন, আরব উপদ্বীপ এবং ইয়ামন তো রসূলুল্লাহ (সঃ)-এর যুগেই বিজিত হয়েছিল। হিজরের মাজুসীরা জিযিয়া কর দিতে স্বীকৃত হয়ে মুসলমানদের অধীনতা স্বীকার করে নেয়। সিরিয়ার কোন কোন অংশেরও এই অবস্থাই হয়। রোমক সম্রাট কায়সার উপহার উপঢৌকন পাঠিয়ে দেন। মিসরের গভর্নরও রসূলুল্লাহ (সঃ)-এর খিদমতে উপঢৌকন পাঠায়। ইসকানদারিয়ার বাদশাহ মাকুকাস/মুকাওকিস এবং আম্মানের বাদশাহরাও এটাই করেন এবং এইভাবে নিজেদের আনুগত্য প্রমাণ করেন। হাবশের (ইথিওপিয়া) বাদশাহ নাজ্জাশী (রাঃ) তো মুসলমানই হয়ে যান, যিনি আসহামার পরে হাবশের বাদশাহ হয়েছিলেন। 

অতঃপর রসূলুল্লাহ (সঃ) যখন ইন্তেকাল করেন এবং হযরত আবু বকর (রাঃ) খিলাফতের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন তখন তিনি হযরত খালিদ ইবনে ওয়ালীদ (রাঃ)-এর নেতৃত্বে এক সেনাবাহিনী পারস্য অভিমুখে প্রেরণ করেন। সেখানে তিনি ক্রমান্বয়ে বিজয় লাভ করতে থাকেন এবং কুফরীর গাছগুলোকে কেটে ফেলে চতুর্দিকে ইসলামের চারা রোপণ করেন। তিনি আবু উবাইদাহ্ ইবনুল জাররাহ (রাঃ) এবং আরো কয়েকজন আমীর ও তাঁদের সেনাবাহিনীর অধীনে ইসলামের বীর সৈনিকদেরকে সিরিয়ার রাজ্যগুলোর দিকে প্রেরণ করেন এবং তাঁরা সেখানে মুহাম্মাদী (সঃ) পতাকা উত্তোলন করেন এবং ক্রুশ চিহ্নযুক্ত পতাকাগুলোকে উল্টোমুখে নিক্ষেপ করেন। (পরবর্তিতে) আমর ইবনুল আস (রাঃ)-এর নেতৃত্বে একদল সেনাবাহিনী মিসরের দিকে প্রেরিত হয়। 

বসরা, দামেস্ক, আম্মান প্রভৃতি রাজ্য বিজয়ের পর হযরত আবু বকর (রাঃ) মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর পূর্বে তিনি মহান আল্লাহর ইচ্ছায় হযরত উমার (রাঃ)-কে তাঁর স্থলাভিষিক্ত করে যান। 

এটা সত্য কথা যে, আকাশের নীচে কোন নবীর পরে হযরত উমার (রাঃ)-এর যুগের মত যুগ আর আসেনি। তাঁর স্বভাবগত শক্তি, তাঁর পুণ্য, তাঁর চরিত্র, তাঁর ন্যায়পরায়ণতা এবং তাঁর আল্লাহভীতির দৃষ্টান্ত দুনিয়ায় তার পরে অনুসন্ধান করা বৃথা কালক্ষেপণ ছাড়া কিছুই নয়। 

সমগ্র সিরিয়া ও মিসর এবং পারস্যের অধিকাংশ অঞ্চল তার খিলাফতের আমলে বিজিত হয়। পারস্য সম্রাট কিসরার সাম্রাজ্য ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। স্বয়ং সম্রাটের মাথা লুকাবার কোন জায়গা থাকে না। তাকে লাঞ্ছিত অবস্থায় পালিয়ে বেড়াতে হয়। রোমক সম্রাট কায়সারকেও সাম্রাজ্যচ্যুত করা হয়। সিরিয়া সাম্রাজ্য তার হাতছাড়া হয়ে যায় এবং কনস্টান্টিনোপলে পালিয়ে গিয়ে তাকে আত্মগোপন করতে হয়। এই সাম্রাজ্যগুলোর বহু বছরের সঞ্চিত ধন-সম্পদ মুসলিমদের হস্তগত হয়। আল্লাহর এই সৎ ও মধুর চরিত্রের অধিকারী বান্দাদের মধ্যে এগুলো বন্টন করা হয়। এইভাবে মহান আল্লাহ তাঁর ঐ ওয়াদা পূর্ণ করেন যা তিনি তার প্রিয় বন্ধু হযরত মুহাম্মাদ (সঃ)-এর সাথে করেছিলেন।

অতঃপর হযরত উসমান (রাঃ)-এর খিলাফতের যুগ আসে এবং পূর্ব হতে পশ্চিম প্রান্ত পর্যন্ত আল্লাহর দ্বীন ছড়িয়ে পড়ে। আল্লাহর সেনাবাহিনী একদিকে পূর্ব দিকের শেষ প্রান্ত এবং অপরদিকে পশ্চিম দিকের শেষ প্রান্তে পৌঁছে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন। ইসলামী মুজাহিদদের উন্মুক্ত তরবারী আল্লাহর তাওহীদকে দুনিয়ার প্রান্তে প্রান্তে পৌঁছিয়ে দেয়। স্পেন, সাইপ্রাস এমন কি সুদূর চীন পর্যন্ত বিজিত হয়। পারস্য সম্রাট কিসরা নিহত হয়। তার সাম্রাজ্যের নাম ও নিশানা নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়। অগ্নি উপাসকদের হাজার হাজার বছরের উপাসনালয় নির্বাপিত হয় এবং প্রত্যেকটি উঁচু টিলা হতে আল্লাহু আকবার ধ্বনি গুঞ্জরিত হয়। 

অপরদিকে মাদায়েন, ইরাক, খোরাসান, আহওয়ায ইত্যাদি সাম্রাজ্য জয় করা হয়। তুর্কীদের সাথে বিশাল যুদ্ধ সংঘটিত হয়। অবশেষে তাদের বড় বাদশাহ খাকান মাটির সাথে মিশে যায়। সে চরমভাবে লাঞ্ছিত ও পর্যুদস্ত হয় এবং জমিনের পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্ত হতে হযরত উসমান (রাঃ)-এর নিকট খাজনা পৌঁছতে থাকে। 

সত্য কথা তো এটাই যে, মুসলিম বীর পুরুষদের এই জীবন মরণ সংগ্রামের মূলে ছিল হযরত উসমান (রাঃ)-এর তিলাওয়াতে কুরআনের বারাকাহ্। আল কুরআনুল কারীমের প্রতি তাঁর যে আসক্তি ও অনুরাগ ছিল তা বর্ণনাতীত। কুরআনকে একত্রিতকরণ ও মুখস্থকরণ এবং প্রচার ও প্রসারকরণে তিনি যে খিদমত আঞ্জাম দেন তার তুলনা মিলে না। তাঁর যুগের প্রতি লক্ষ্য করলে রসূলুল্লাহ (সঃ)-এর ভবিষ্যদ্বাণীটি মানসপটে ভেসে ওঠে। তিনি বলেছিলেন:

“আমার জন্যে যমীনকে এক জায়গায় একত্রিত ও জড়ো করা হয়, এমনকি আমি এর পূর্ব দিক ও পশ্চিম দিক দেখে নিই। আমার উম্মতের সাম্রাজ্য সেই পর্যন্ত পৌঁছে যাবে যে স্থান পর্যন্ত আমাকে দেখানো হয়েছিল।" 

[আবু দাউদ:কিতাবুল ফিতান ওয়াল মালাহিম(সহীহ)]

এখন আমরা দেখতে পাই যে, আল্লাহ এবং তাঁর রসূল (সঃ) আমাদের সাথে যে ওয়াদা করেছিলেন তা সত্যে পরিণত হয়েছে। সুতরাং আমরা আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করছি, আমরা যেন তাঁর প্রতি এবং তাঁর রসূল (সঃ)-এর প্রতি দৃঢ় ঈমান রাখতে পারি। এবং যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশে তিনি সন্তুষ্ট হন সেই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার তাওফীকও আমরা তাঁর কাছেই কামনা করছি। 

জাবির ইবনে সামুরা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রসূলুল্লাহ (সঃ)-কে বলতে শুনেছি- “মুসলমানদের কাজ উত্তমরূপে চালু থাকবে, শেষ পর্যন্ত তাদের মধ্যে বারো জন খলীফা হবে।” অতঃপর তিনি একটি বাক্য আস্তে বলেন যা আমার কর্ণগোচর হয়নি। আমি ওটা আমার পিতাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন যে, রসূলুল্লাহ (সঃ) যে কথাটি আস্তে বলেছিলেন তাহলো: “এদের সবাই কুরায়েশী হবে।”

[এ হাদীসটি ইমাম মুসলিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন]

রসূলুল্লাহ (সঃ) এ কথাটি ঐ দিনের সন্ধ্যায় বলেছিলেন যেদিন হযরত মায়েয ইবনে মালিক (রাঃ)-কে রজম বা প্রস্তরাঘাতে (শারঈ হাদ্দ হিসেবে) হত্যা করা হয়েছিল। 

সুতরাং জানা গেল যে, এই বারোজন খলীফাহ্ অবশ্যই হবেন। কিন্তু এটা স্মরণ রাখার বিষয় যে, এই বারো জন খলীফা তারা নয় যাদেরকে শিয়া সম্প্রদায় ধারণা করছে। কেননা শিয়াদের ইমামদের মধ্যে এমন বহু ইমামও রয়েছে যারা খিলাফত ও সালতানাতের কোন অংশ সারা জীবনেও লাভ করেনি। এই বারো জন খলীফাহ্ সবাই হবেন কুরায়েশ বংশের। তাঁরা হবেন ন্যায়ের সাথে ফায়সালাকারী। তাঁদের সুসংবাদ পূর্ববর্তী কিতাবসমূহেও রয়েছে। এটা শর্ত নয় যে, এই বারো জন খলীফা পর্যায়ক্রমে ও ক্রমিকভাবে হবেন। বরং হতে পারে যে, তারা বিভিন্ন যুগে হবেন। চার জন খলীফা তো ক্রমিকভাবেই হয়েছেন। যেমন আবু বকর (রাঃ), উমার (রাঃ), উসমান (রাঃ) এবং আলী (রাঃ)। তাঁদের পর ক্রম কেটে গেছে। পরে এরূপ খলীফা গত হয়েছেন এবং পরবর্তিতেও কোন কোন খলীফার আগমন ঘটতে পারে। সঠিক যুগের অবগতি একমাত্র মহান আল্লাহরই রয়েছে। 

তবে এটা নিশ্চিত কথা যে, (ইমাম) মাহদীও এই বারো জনের একজন হবেন যার নাম ও উপনাম হবে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নাম ও উপনামের মতো। তিনি সমগ্র ভূ-পৃষ্ঠকে আদল ও ইনসাফ দ্বারা পূর্ণ করে দিবেন, যখন সারা দুনিয়া অন্যায় ও অত্যাচারে ছেয়ে যাবে।

রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর মুক্ত দাস হযরত সাফীনা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন:

 الخلافة بعدي ثلاثون سنة ، ثم يكون ملكا عضوضا٠

 “আমার (ইন্তেকালের) পরে ত্রিশ বছর পর্যন্ত খিলাফত থাকবে, তারপর তা হয়ে যাবে রাজত্ব/বাদশাহী/দন্তকর্তিত রাজ্য।” 

[এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ), ইমাম আবু দাউদ (রঃ), ইমাম তিরমিযী (রঃ) এবং ইমাম নাসাঈ (রঃ) প্রমুখ বর্ণনা করেছেন]

আবুল আলিয়া (রঃ) এ আয়াতের তাফসীরে বলেন যে, (ইসলামের আবির্ভাবের পর) রসূলুল্লাহ (সঃ) এবং তাঁর সহচরবর্গ দশ বছরের মত মক্কায় অবস্থান করেন। ঐ সময় তারা দুনিয়াবাসীকে আল্লাহর একত্ববাদ ও তাঁর ইবাদতের দিকে আহ্বান করতে থাকেন। কিন্তু ঐ যুগটি ছিল গোপনীয়তা, ভয় ও নিরাপত্তাহীনতার যুগ। তখন পর্যন্ত জিহাদের হুকুম নাযিল হয়নি। মুসলমানরা ছিলেন অত্যন্ত দুর্বল। এরপর হিজরতের হুকুম হয় এবং তাঁরা মদীনায় হিজরত করেন। অতঃপর জিহাদের হুকুম অবতীর্ণ হয়। চতুর্দিক শত্রু পরিবেষ্টিত ছিল। মুসলমানরা ছিলেন ভীত-সন্ত্রস্ত। কোন সময়ই বিপদশূন্য ছিল না। সকাল সন্ধ্যায় সাহাবীগণ (রাঃ) অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত থাকতেন। একজন সাহাবী একদা রসূলুল্লাহ (সঃ)-কে বলেন: “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমাদের জীবনের একটা মুহূর্তও কি শান্তিতে কাটবে না? হে আল্লাহর রসূল (সঃ)! ক্ষণিকের জন্যেও কি আমরা অস্ত্র-শস্ত্র রেখে দিয়ে তৃপ্তি ও স্বস্তির শ্বাস গ্রহণ করতে পারবো না?” 

রসূলুল্লাহ (সঃ) অত্যন্ত শান্তভাবে উত্তর দেন: “আরো কিছুদিন ধৈর্যধারণ করো। অতঃপর এমন শান্তি এবং নিরাপত্তা বিরাজ করবে যে, মানুষ ভরা মজলিসে আরামে ও নিশ্চিন্তে বসে থাকবে, একজনের কাছে কেন, কারো কাছেই কোন অস্ত্র থাকবে না।" ঐ সময় আল্লাহ তা'আলা এই আয়াত অবতীর্ণ করেন। 

অতঃপর আল্লাহর নবী (সঃ) আরব উপদ্বীপের উপর বিজয় লাভ করেন। আরবে (কেন্দ্রে) কোন কাফির থাকলো না। সুতরাং মুসলমানদের অন্তর ভয়শূন্য হয়ে গেল। আর সদা-সর্বদা অস্ত্রে-শস্ত্রে সজ্জিত থাকার কোন প্রয়োজন থাকলো না। ভারপর রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর ইন্তেকালের পরেও তিনজন খলীফার যুগ পর্যন্ত সর্বত্র ঐ শান্তি ও নিরাপত্তাই বিরাজ করে। অর্থাৎ আবু বকর (রাঃ), উমার (রাঃ) এবং উসমান (রাঃ)-এর যুগ পর্যন্ত। এরপর মুসলমানদের মধ্যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। কাজেই আবার তাদের মধ্যে ভয় এসে পড়ে এবং প্রহরী,চৌকিদার,দারোগা ইত্যাদি নিযুক্ত করতে হয়। মুসলমানরা যখন নিজেদের অবস্থা নিজেরাই পরিবর্তন করে তখন তাদের অবস্থা পবির্তিত হয়ে যায়। 

পূর্ব যুগের কোন কোন ইমাম হতে বর্ণিত আছে যে, তারা হযরত আবু বকর (রাঃ) ও হযরত উমার (রাঃ)-এর খিলাফতের সত্যতার ব্যাপারে এই আয়াতটিকে পেশ করেছেন। 

হযরত বারা ইবনে আযিব (রাঃ) বলেন: “যখন এই আয়াত অবতীর্ণ হয় তখন আমরা অত্যন্ত ভয় ও দুর্ভাবনার অবস্থায় ছিলাম। যেমন আল্লাহ তা'আলা বলেন:

 وَ اذۡکُرُوۡۤا اِذۡ اَنۡتُمۡ قَلِیۡلٌ مُّسۡتَضۡعَفُوۡنَ فِی الۡاَرۡضِ تَخَافُوۡنَ اَنۡ یَّتَخَطَّفَکُمُ النَّاسُ٠٠٠

অর্থাৎ “তোমরা স্মরণ কর, যখন তোমরা ছিলে খুবই অল্প এবং ভূ-পৃষ্ঠে তোমাদেরকে দুর্বল মনে করা হতো;তোমরা আশঙ্কা করতে যে, লোকেরা তোমাদেরকে ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে যাবে...।” [৮:২৬]

অর্থাৎ পদে পদে তোমরা ভীত ও শংকিত থাকতে। অতঃপর আল্লাহ তোমাদের সংখ্যা বাড়িয়ে দেন এবং তোমাদেরকে শক্তিশালী করেন। আর তিনি তোমাদেরকে নিরাপত্তা দান করেন। যেমন,মহান আল্লাহ বলেন:

كَمَا اسْتَخْلَفَ الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ٠٠٠ 

যেমন তিনি প্রতিনিধিত্ব দান করেছিলেন তাদের পূর্ববর্তীদেরকে...। [২৪:৫৫] 

যেমন মূসা (আঃ) তাঁর কওমকে বলেছিলেন:

قَالَ عَسٰی رَبُّکُمۡ اَنۡ یُّهۡلِکَ عَدُوَّکُمۡ وَ یَسۡتَخۡلِفَکُمۡ فِی الۡاَرۡضِ فَیَنۡظُرَ کَیۡفَ تَعۡمَلُوۡنَ ٠ 

অর্থাৎ “এটা খুবই নিকটে যে, তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের শত্রুদেরকে ধ্বংস করবেন এবং যমীনে তোমাদেরকে তাদের স্থলাভিষিক্ত করবেন, অতঃপর তিনি দেখবেন তোমরা কেমন আমল করো।” [৭:১২৯] 

অন্য আয়াতে বলেন:

 وَ نُرِیۡدُ اَنۡ نَّمُنَّ عَلَی الَّذِیۡنَ اسۡتُضۡعِفُوۡا فِی الۡاَرۡضِ وَ نَجۡعَلَهُمۡ اَئِمَّۃً وَّ نَجۡعَلَهُمُ الۡوٰرِثِیۡنَ٠

অর্থাৎ “আমি চাই যে, ভূ-পৃষ্ঠে যাদেরকে দুর্বল জ্ঞান করা হতো তাদের প্রতি আমি অনুগ্রহ করবো, তাদেরকে নেতা বানাবো, আর তাদেরকে উত্তরাধিকারী করবো।” [২৮:৫] 

এরপর মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেন:

 ۪ وَ لَیُمَکِّنَنَّ لَهُمۡ دِیۡنَهُمُ الَّذِی ارۡتَضٰی لَهُمۡ وَ لَیُبَدِّلَنَّهُمۡ مِّنۡۢ بَعۡدِ خَوۡفِهِمۡ اَمۡنًا٠٠٠ ؕ

...তিনি অবশ্যই তাদের জন্যে সুদৃঢ় করবেন তাদের দ্বীনকে যা তিনি তাদের জন্যে মনোনীত করেছেন এবং তাদের ভয়-ভীতির পরিবর্তে তাদেরকে অবশ্যই নিরাপত্তা দান করবেন...। 

হযরত আদী ইবনে হাতিম (রাঃ) যখন প্রতিনিধি হিসেবে রসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট আগমন করেন তখন রসূলুল্লাহ (সঃ) তাকে জিজ্ঞেস করেন:

“তুমি কি হীরা নামক দেশ দেখেছো?” উত্তরে হযরত আদী ইবনে হাতিম (রাঃ) বলেন: “জ্বী না, আমি হীরা দেখিনি, তবে নাম শুনেছি।” তখন রসূলুল্লাহ (সঃ) বলেন: “যার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে তাঁর শপথ! আল্লাহ তা'আলা আমার এই দ্বীনকে পূর্ণরূপে ছড়িয়ে দিবেন। তখন এমনভাবে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত হবে যে, হীরা থেকে একজন মহিলা উষ্ট্রীর উপর সওয়ার হয়ে একাই বেরিয়ে পড়বে এবং বায়তুল্লাহ শরীফে পৌঁছে তাওয়াফ কার্য সম্পন্ন করে ফিরে যাবে। সে না কাউকেও ভয় করবে এবং না কারো আশ্রয়ে থাকবে। জেনে রেখো যে, ইরানের বাদশাহ কিসরা ইবনে হরমুযের কোষাগার বিজিত হবে।” হযরত আদী (রাঃ) বিস্ময়ের সুরে বলেন: “ইরানের বাদশাহ কিসরা ইবনে হরমুযের কোষাগার মুসলিমগণ জয় করবেন!” উত্তরে রসূলুল্লাহ (সঃ) বলেন: “হ্যাঁ, কিসরা ইবনে হরমুযের কোষাগারই বটে। আর ধন-সম্পদ এতো বৃদ্ধি পাবে যে, তা গ্রহণকারী কেউ থাকবে না।” 

আদী (রাঃ) বলেন: “দেখ, বাস্তবিকই স্ত্রীলোকেরা হীরা হতে কারো আশ্রয় ছাড়াই যাতায়াত করছে। রসূলুল্লাহ (সঃ)-এর এ ভবিষ্যদ্বাণী পূর্ণ হতে আমি স্বচক্ষে দেখলাম। দ্বিতীয় ভবিষ্যদ্বাণীও আমার চোখের সামনে পুরো হয়েছে। কিসরার ধনভাণ্ডার জয়কারীদের মধ্যে স্বয়ং আমিও বিদ্যমান ছিলাম। তৃতীয় ভবিষ্যদ্বাণীটিও নিঃসন্দেহে পূর্ণ হবে। কেননা, এটাও রসূলুল্লাহ (সঃ)-এরই ভবিষ্যদ্বাণী।”[তাঁর এ হাদীস বর্ণনার সময় পর্যন্ত এ অবস্থা ছিল] 

হযরত উবাই ইবনে কা'ব (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন: “এই উম্মতকে ভূ-পৃষ্ঠে উন্নতি,উচ্চ মর্যাদা,দ্বীনের প্রসার ও সাহায্যের সুসংবাদ দিয়ে দাও। তবে যে ব্যক্তি দুনিয়া লাভের উদ্দেশ্যে আখিরাতের কাজ করবে তার জানা উচিত যে,পরকালে তার জন্যে কোনই অংশ নেই।” [এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রহঃ) বর্ণনা করেছেন]

মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেন:...তারা আমার ইবাদত করবে এবং আমার সাথে অন্য কাউকেও শরীক করবে না। হযরত মুআয ইবনে জাবাল (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা আমি উটের উপরে রসূলুল্লাহ (সঃ)-এর পিছনে বসেছিলাম। আমার ও তার মাঝে জিনের (উটের গদীর) শেষ কাষ্ঠখণ্ড ছাড়া কিছুই ছিল না (অর্থাৎ আমি নবী (সঃ)-এর খুবই সংলগ্ন ছিলাম)। তখন তিনি বললেন: “হে মুআয (রাঃ)!” আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! লাব্বায়েক ওয়া সাদায়েক! অতঃপর আল্লাহর রসূল (সঃ) সামনে কিছুক্ষণ অগ্রসর হলেন। আবার তিনি বললেন: “হে মুআয (রাঃ)!” আমি বললাম, হে আল্লাহর রসূল (সঃ)! লাব্বায়েক ওয়া সাদায়েক! আবার তিনি কিছুক্ষণ সামনে চললেন। পুনরায় তিনি বললেন: “হে মুআয (রাঃ)!" আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! লাব্বায়েক ওয়া সা'দায়েক! তিনি (এবার) বললেন: “বান্দার উপর আল্লাহর হক কি, তা কি তুমি জান?" আমি বললাম, আল্লাহ ও তার রসূল (সঃ) অধিকতর ভাল জানেন ও জ্ঞাত আছেন। তিনি বললেন: “বান্দার উপর আল্লাহর হক এই যে, তারা কেবল তাঁরই ইবাদত করবে এবং তাঁর সাথে কোন শরীক করবে না।” অতঃপর তিনি কিছুক্ষণ চললেন এবং আবার বললেন: “হে মুআয!” আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! লাব্বায়েক ওয়া সাদায়েক! তিনি বললেন: “আল্লাহর উপর বান্দার হক কি, তা তুমি জান কি?” আমি বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রসূল (সঃ) সবচেয়ে ভাল জ্ঞাত আছেন। তিনি বললেন: “আল্লাহর উপর বান্দার হক হচ্ছে এই যে,(বান্দা যদি পূর্বোক্ত কাজ করে) তিনি তাদেরকে শাস্তি প্রদান করবেন না।" 

[এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) ইমাম বুখারী (রঃ) ও ইমাম মুসলিম (রঃ) প্রমুখ বর্ণনা করেছেন]

অতঃপর আল্লাহ তাআলা বলেন:

...আর যারা অকৃতজ্ঞ হবে তারা তো সত্যত্যাগী। 

অর্থাৎ এর পরেও যারা আমার আনুগত্য পরিত্যাগ করবে সে আমার হুকুম অমান্য করলো এবং এটা খুবই কঠিন ও বড় পাপ।আল্লাহর মাহাত্ম্য এই যে, যেই যুগে ইসলামের শক্তি বেশি ছিল সেই যুগে তিনি সাহায্যও বেশি করেছেন। সাহাবীগণ (রাঃ) ঈমানে অগ্রগামী ছিলেন, কাজেই তাঁরা বিজয় লাভের ব্যাপারেও সকলের অগ্রগামী ছিলেন। আর যখন ঈমানে দুর্বলতা দেখা দেয় তখন পার্থিব অবস্থা, রাজত্ব এবং শান-শওকতও নিচে নেমে গেছে। 

সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে রয়েছে যে, রসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন: “আমার উম্মতের মধ্যে একটি দল সদা সত্যের উপর থাকবে এবং তারা থাকবে সদা জয়যুক্ত। তাদের বিরোধীরা তাদের কোনই ক্ষতি করতে পারবে না। কিয়ামত পর্যন্ত এই অবস্থাই থাকবে। আর এক বর্ণনায় আছে যে, শেষ পর্যন্ত আল্লাহর ওয়াদা এসে যাবে। 

একটি বর্ণনায় রয়েছে যে, শেষ পর্যন্ত এই দলটিই দাজ্জালের সাথে যুদ্ধ করবে। আর একটি হাদীসে আছে যে, হযরত ঈসা (আঃ)-এর অবতরণ পর্যন্ত এই লোকগুলো কাফিরদের উপর জয়যুক্ত থাকবে। এই সব রিওয়াইয়াত বিশুদ্ধ এবং সবগুলোরই ভাবার্থ একই।

[দ্রঃ তাফসীর ইবনে কাসীর। এ সম্পর্কে আরো দেখুন তাফসীর কুরতুবী, তাফসীর ইবনে জারীর আত তাবারী...ইত্যাদি।]

-এটা নিশ্চিত যে, যখন এই আয়াত নাযিল হয় তখন মদীনাহয় যে ইসলামী রাষ্ট্র (বা ইমারাহ্) ছিল, সেটা কিন্তু সেই খিলাফাহ্ ছিল না যে খিলাফাহর ওয়াদা উক্ত আয়াতে রয়েছে। বরং ওয়াদকৃত বিষয়টি বিদ্যমান ছিল না বিধায় তা দান করা হবে মর্মে আল্লাহর পক্ষ থেকে উক্ত আয়াতে এ ওয়াদা করা হয়েছে। [যদি তখন ঐ কাঙ্ক্ষিত খিলাফাহ্ থাকতো তাহলে আয়াতের ভাষা এরূপ হতো না। তবে রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মাদীনাহ্ ছিল কেন্দ্র, অর্থাৎ (ভবিষ্যতে আগত) বৈশ্বিক ইসলামী খিলাফাহর কেন্দ্র।] 

আরো স্পষ্ট করে বলছি : তখন মাদীনায় উক্ত আয়াতে বর্ণিত কাঙ্ক্ষিত বিষয়সমূহের তিনটি বিষয়ই ছিল, (যা তৎকালীন পৃথিবীর অন্য সকল দেশের তুলনায় বেশি ছিল, তবে তা কাঙ্ক্ষিত মানেও ছিল না, যথেষ্ট পরিমাণেও ছিল না) । অর্থাৎ, 

এক. তখন মাদীনায় ইসলামী শাসন কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত ছিল, যা অন্য এলাকায় ছিল না। 

দুই.তখন মাদীনায় আল্লাহর মনোনীত দীন প্রতিষ্ঠিত ছিল, যা মক্কা বা অন্য এলাকায় ছিল না।  

তিন. তখন মাদীনায় মক্কা বা অন্য এলাকার চেয়ে বেশি নিরাপত্তাও ছিল, আর এ কারণেই অন্য এলাকা থেকে হিজরত করে মানুষ মাদীনাহ্য় আসতেন।

অর্থাৎ, তখন মাদীনায় উক্ত তিনটি উপাদান বা বৈশিষ্ট্য অন্য সকল ভূমির তুলনায় বেশিই ছিল। তা সত্ত্বেও সাহাবীগণ (রাঃ) ঐ সকল কাঙ্ক্ষিত বিষয় কামনা করছিলেন, যা আমরা ঐ আয়াতের তাফসীর থেকে জানতে পারি। আর তখনই আল্লাহ তায়ালা ঐ তিনটি বিষয়ের ওয়াদা সম্বলিত আয়াত নাযিল করেছেন।

আর তখন মাদীনায় যে (উক্ত) তিনটি উপাদান বা বৈশিষ্ট্য ছিল সেটাই যদি খিলাফাহ্ হওয়ার জন্য যথেষ্ট হতো তবে সাহাবীগণ (রাঃ) তাফসীরে বর্ণিত এরূপ ভয়-ভীতি ও আশংকা নিয়ে নিরাপত্তার অভাববোধ কেন করে থাকবেন? আর আল্লাহ তায়ালাই বা কেন (এরূপ ভাষায়) এ আয়াত নাযিল করলেন? যে কোন বিবেকবান মানুষের উপলব্ধির জন্য এ প্রশ্নই যথেষ্ট ইনশাআল্লাহ। 

অর্থাৎ, আয়াতে বর্ণিত এসব কাঙ্ক্ষিত  বিষয় কিছুটা বা সামান্য থাকলেও তা উল্লেখযোগ্য ও কাঙ্ক্ষিত মানে ও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ছিল না, যাকে পৃথিবীতে প্রকৃত অর্থে খিলাফাহ্, দীনের বিজয়, নিরাপত্তা ইত্যাদি বলা যেতে পারে, যার ওয়াদা উক্ত (২৪:৫৫) আয়াতে বর্ণিত আছে। বিধায় তখন এই আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে খিলাফাহ্ এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়সমূহের ওয়াদা করা হয়েছে । এবং এরপর আল্লাহ তায়ালা তা দানও কর ছেন, আলহামদুলিল্লাহ। 

পূর্বোক্ত তাফসীরের আলোচনা থেকে আমরা স্পষ্ট হয়েছি:

- সূরাহ আন নূর-এর ৫৫ আয়াতের পূর্ববর্তী প্রেক্ষাপট  

- সূরাহ আন নূর-এর ৫৫ আয়াত নাযিলের সময় সংশ্লিষ্ট অবস্থা ও সামগ্রিক প্রেক্ষাপট 

- সূরাহ আন নূর-এর ৫৫ আয়াতে বর্ণিত কাঙ্ক্ষিত খিলাফাহ্ প্রাথমিক স্বরূপ এবং ক্রমবিকাশ,উন্নতি-অগ্রগতি। 

এই বিষয়ে আরো স্পষ্ট ধারণা পেতে এবার আমরা আলোচনা করছি - 

- খিলাফাহর জন্য  কী পরিমাণ ভূমি এবং কতটুকু কর্তৃত্ব-ক্ষমতা জরুরি? 

- কতটুকু (বা কী ধরণের/মানের) দীন প্রতিষ্ঠিত হওয়া জরুরি? 

- কতটুকু/কী রূপ নিরাপত্তা অর্জিত হওয়া জরুরি?  

যেহেতু সূরা আন নূরের ৫৫ আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা তাঁর মু'মিন ও সলিহীন (সৎকর্মশীল) বান্দাগণের সাথেفى الارض বা এই পৃথিবীতে/পৃথিবীর খিলাফাহ্ বা রাজত্ব-কর্তৃত্বের ওয়াদা করেছেন। তাহলে প্রথমেই আমাদের স্পষ্ট হতে হবে, আয়াতে উল্লিখিত فى الارض অর্থ কী?

আর فى الارض বা পৃথিবীতে খিলাফাহ্ বা রাজত্ব-কর্তৃত্ব বলতে কী বুঝায়?

 

সুতরাং,ইনশাআল্লাহ্, প্রথমে আমরা দেখব বিভিন্ন আয়াতে বিভিন্নরূপে فى الارض- এর প্রয়োগ:

 

১. সাধারণত পৃথিবী বুঝাতে অনেক আয়াতে 'আরদ' শব্দটি এসেছে। যেমন, আল্লাহর বাণী:

اِنَّ رَبَّکُمُ اللّٰهُ الَّذِیۡ خَلَقَ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضَ فِیۡ سِتَّۃِ اَیَّامٍ ثُمَّ اسۡتَوٰی عَلَی الۡعَرۡشِ ۟ یُغۡشِی الَّیۡلَ النَّهَارَ یَطۡلُبُهٗ حَثِیۡثًا ۙ وَّ الشَّمۡسَ وَ الۡقَمَرَ وَ النُّجُوۡمَ مُسَخَّرٰتٍۭ بِاَمۡرِهٖ ؕ اَلَا لَهُ الۡخَلۡقُ وَ الۡاَمۡرُ ؕ تَبٰرَکَ اللّٰهُ رَبُّ الۡعٰلَمِیۡنَ ٠

তোমাদের রব (প্রতিপালক) আল্লাহ, যিনি ছয় দিনে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর আরশে সমুন্নত হয়েছেন। দিনকে তিনি রাতের পর্দা দিয়ে ঢেকে দেন, তারা একে অন্যকে দ্রুতগতিতে অনুসরণ করে এবং সূর্য, চন্দ্র, তারকারাজি তাঁরই আজ্ঞাবহ। জেনে রেখ, সৃষ্টি তাঁরই আর হুকুমও (চলবে) তাঁর, বরকতময় আল্লাহ বিশ্বজগতের প্রতিপালক।

[সূরাহ আল আরাফ: ৫৪]

২.পৃথিবী বা ভূপৃষ্ঠের জমি/মাটি বুঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন:

وَ عِنۡدَهٗ مَفَاتِحُ الۡغَیۡبِ لَا یَعۡلَمُهَاۤ اِلَّا هُوَ ؕ وَ یَعۡلَمُ مَا فِی الۡبَرِّ وَ الۡبَحۡرِ ؕ وَ مَا تَسۡقُطُ مِنۡ وَّرَقَۃٍ اِلَّا یَعۡلَمُهَا وَ لَا حَبَّۃٍ فِیۡ ظُلُمٰتِ الۡاَرۡضِ وَ لَا رَطۡبٍ وَّ لَا یَابِسٍ اِلَّا فِیۡ کِتٰبٍ مُّبِیۡنٍ ٠

অদৃশ্য জগতের চাবিকাঠি তাঁরই নিকট রয়েছে; তিনি ছাড়া আর কেহই তা জ্ঞাত নয়। পৃথিবীতে ও সমুদ্রের সব কিছুই তিনি অবগত আছেন, তাঁর অবগতি ব্যতীত বৃক্ষ হতে একটি পাতাও ঝরে পড়েনা এবং ভূ-পৃষ্ঠের অন্ধকারের মধ্যে একটি দানাও পতিত হয়না, এমনিভাবে কোন সরস ও নিরস বস্তুও পতিত হয়না; সমস্ত কিছুই সুস্পষ্ট কিতাবে লিপিবদ্ধ রয়েছে। 

[সূরাহ আল আনআম: ৫৯]

৩.পৃথিবীর মানবগোষ্ঠীর সাথে সংশ্লিষ্ট ভূমি উদ্দেশ্য -

اِذۡ قَالَ رَبُّکَ لِلۡمَلٰٓئِکَۃِ اِنِّیۡ جَاعِلٌ فِی الۡاَرۡضِ خَلِیۡفَۃً٠٠٠ 

এবং যখন তোমার রাব্ব মালাইকা/ফেরেশতাদের বললেন, নিশ্চয়ই আমি পৃথিবীতে প্রতিনিধি সৃষ্টি করব...।

[সূরাহ আল বাকারাহ: ৩০]

৪. পৃথিবীর জনপদ ও মানুষের কর্মক্ষেত্র ইত্যাদি সম্পর্কে এসেছে:

فَاِذَا قُضِیَتِ الصَّلٰوۃُ فَانۡتَشِرُوۡا فِی الۡاَرۡضِ وَ ابۡتَغُوۡا مِنۡ فَضۡلِ اللّٰهِ وَ اذۡکُرُوا اللّٰهَ کَثِیۡرًا لَّعَلَّکُمۡ تُفۡلِحُوۡنَ ٠

অতঃপর যখন সালাত সমাপ্ত হবে তখন তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড় আর আল্লাহর অনুগ্রহ হতে অনুসন্ধান কর এবং আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ কর, যাতে তোমরা সফল হতে পার।

[সূরাহ আল জুমুআহ্:১০]

৫. পৃথিবীর বিভিন্ন প্রকার ভূমি বা জমি বুঝাতে 'আরদ' শব্দের ব্যবহার এসেছে। যেমন আল কুরআনে এসেছে:

یُخۡرِجُ الۡحَیَّ مِنَ الۡمَیِّتِ وَ یُخۡرِجُ الۡمَیِّتَ مِنَ الۡحَیِّ وَ یُحۡیِ الۡاَرۡضَ بَعۡدَ مَوۡتِهَا ؕ وَ کَذٰلِکَ تُخۡرَجُوۡنَ ٠

তিনি মৃত থেকে জীবিতকে বের করেন এবং জীবিত থেকে মৃতকে বের করেন। আর তিনি জমিনকেও জীবিত করেন তার মৃত্যুর পর। আর এভাবেই তোমরা উত্থিত হবে।

[সূরাহ আর রূম:১৯] 

اَوَ لَمۡ یَرَوۡا اَنَّا نَسُوۡقُ الۡمَآءَ اِلَی الۡاَرۡضِ الۡجُرُزِ فَنُخۡرِجُ بِهٖ زَرۡعًا تَاۡکُلُ مِنۡهُ اَنۡعَامُهُمۡ وَ اَنۡفُسُهُمۡ ؕ اَفَلَا یُبۡصِرُوۡنَ ٠

তারা কি লক্ষ্য করে না যে, আমি শুকনো ভূমিতে পানি প্রবাহিত করি, অতঃপর তা দিয়ে শস্য উৎপাদন করি, যা থেকে তাদের গবাদিপশু ও তারা নিজেরা খাদ্য গ্রহণ করে? তবুও কি তারা লক্ষ্য করবে না। 

[সূরাহ আস সাজদাহ্:২৭]

 وَ اللّٰهُ الَّذِیۡۤ اَرۡسَلَ الرِّیٰحَ فَتُثِیۡرُ سَحَابًا فَسُقۡنٰهُ اِلٰی بَلَدٍ مَّیِّتٍ فَاَحۡیَیۡنَا بِهِ الۡاَرۡضَ بَعۡدَ مَوۡتِهَا ؕ کَذٰلِکَ النُّشُوۡرُ ٠

আর তিনিই আল্লাহ, যিনি বায়ু প্রেরণ করেন অতঃপর তা মেঘমালা সঞ্চালিত করে, তারপর তাকে আমি মৃত ভূমির দিকে পরিচালিত করি, অতঃপর তা দিয়ে আমি জমিনকে তার মৃত্যুর পর জীবিত করি; এভাবেই পুনরুত্থান হবে।

[সূরাহ আল ফাতির:৯]

আর,হাদীসে এসেছে:

عَنْ أَبِي مُوسَى، عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم صلى الله عليه وسلم قَالَ ‏ "‏ مَثَلُ مَا بَعَثَنِي اللَّهُ بِهِ مِنَ الْهُدَى وَالْعِلْمِ كَمَثَلِ الْغَيْثِ الْكَثِيرِ أَصَابَ أَرْضًا، فَكَانَ مِنْهَا نَقِيَّةٌ قَبِلَتِ الْمَاءَ، فَأَنْبَتَتِ الْكَلأَ وَالْعُشْبَ الْكَثِيرَ، وَكَانَتْ مِنْهَا أَجَادِبُ أَمْسَكَتِ الْمَاءَ، فَنَفَعَ اللَّهُ بِهَا النَّاسَ، فَشَرِبُوا وَسَقَوْا وَزَرَعُوا، وَأَصَابَتْ مِنْهَا طَائِفَةً أُخْرَى، إِنَّمَا هِيَ قِيعَانٌ لاَ تُمْسِكُ مَاءً، وَلاَ تُنْبِتُ كَلأً، فَذَلِكَ مَثَلُ مَنْ فَقِهَ فِي دِينِ اللَّهِ وَنَفَعَهُ مَا بَعَثَنِي اللَّهُ بِهِ، فَعَلِمَ وَعَلَّمَ، وَمَثَلُ مَنْ لَمْ يَرْفَعْ بِذَلِكَ رَأْسًا، وَلَمْ يَقْبَلْ هُدَى اللَّهِ الَّذِي أُرْسِلْتُ بِهِ ‏"‏‏.‏ قَالَ أَبُو عَبْدِ اللَّهِ قَالَ إِسْحَاقُ وَكَانَ مِنْهَا طَائِفَةٌ قَيَّلَتِ الْمَاءَ‏.‏ قَاعٌ يَعْلُوهُ الْمَاءُ، وَالصَّفْصَفُ الْمُسْتَوِي مِنَ الأَرْضِ‏.‏

আবূ মূসা (রাযি.) হতে বর্ণিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: আল্লাহ্ তাআলা আমাকে যে হিদায়াত ও ইলম দিয়ে পাঠিয়েছেন তার দৃষ্টান্ত হল জমিনের উপর পতিত প্রবল বর্ষণের ন্যায়। কোন কোন ভূমি থাকে উর্বর যা ঐ পানি শুষে নিয়ে প্রচুর পরিমাণে ঘাসপাতা এবং সবুজ তরুলতা উৎপাদন করে। আর কোন কোন ভূমি থাকে কঠিন যা পানি আটকে রাখে। পরে আল্লাহ তা‘আলা তা দিয়ে মানুষের উপকার করেন; তারা নিজেরা পান করে ও (পশুপালকে) পান করায় এবং তা দ্বারা চাষাবাদ করে। আবার কোন কোন জমি রয়েছে যা একেবারে মসৃণ ও সমতল; তা না পানি আটকে রাখে, আর না কোন ঘাসপাতা উৎপাদন করে। এই হল সে ব্যক্তির দৃষ্টান্ত যে দ্বীনের জ্ঞান অর্জন করে এবং আল্লাহ্ তাআলা আমাকে যা দিয়ে প্রেরণ করেছেন তাতে সে উপকৃত হয়। ফলে সে নিজে শিক্ষা করে এবং অপরকে শিখায়। আর সে ব্যক্তিরও দৃষ্টান্ত - যে সে দিকে মাথা তুলে দেখে না এবং আল্লাহর যে হিদায়াত নিয়ে আমি প্রেরিত হয়েছি, তা গ্রহণও করে না।

আবূ ‘আবদুল্লাহ্ বুখারী (রহ.) বলেন: ইসহাক (রহ.) আবূ উসামাহ (রহ.) থেকে বর্ণনা করেছেন: তিনি قلت এর স্থলে قَيَّلَتْ  (আটকে রাখে) ব্যবহার করেছেন। قاع হল এমন ভূমি যার উপর পানি জমে থাকে। আর الصَّفْصَفُ হল সমতল ভূমি।

[সহীহ্ আল বুখারী,কিতাবুল ইলম]

৬. একই আয়াতে 'আরদ' শব্দটির বিভিন্নরূপ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে:

اِنَّ فِیۡ خَلۡقِ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ وَ اخۡتِلَافِ الَّیۡلِ وَ النَّهَارِ وَ الۡفُلۡکِ الَّتِیۡ تَجۡرِیۡ فِی الۡبَحۡرِ بِمَا یَنۡفَعُ النَّاسَ وَ مَاۤ اَنۡزَلَ اللّٰهُ مِنَ السَّمَآءِ مِنۡ مَّآءٍ فَاَحۡیَا بِهِ الۡاَرۡضَ بَعۡدَ مَوۡتِهَا وَ بَثَّ فِیۡهَا مِنۡ کُلِّ دَآبَّۃٍ ۪ وَّ تَصۡرِیۡفِ الرِّیٰحِ وَ السَّحَابِ الۡمُسَخَّرِ بَیۡنَ السَّمَآءِ وَ الۡاَرۡضِ لَاٰیٰتٍ لِّقَوۡمٍ یَّعۡقِلُوۡنَ ٠

নিশ্চয়ই আকাশসমূহ ও পৃথিবীর সৃষ্টির মধ্যে, রাত ও দিনের বিবর্তনের মধ্যে, লোকের উপকারী দ্রব্যাদিসহ সমুদ্রে চলাচলকারী নৌযানের মধ্যে এবং আকাশ হতে আল্লাহর বর্ষিত সেই পানির মধ্যে যা দ্বারা তিনি জমির মৃত্যুর পর আবার জীবিত করেন এবং তাতে সকল প্রকার জীব-জন্তুর বিস্তারণে এবং বাতাসের গতি পরিবর্তনের মধ্যে এবং আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যস্থলে নিয়ন্ত্রিত মেঘমালার মধ্যে বিবেকসম্পন্ন লোকদের জন্য নিদর্শনাবলী রয়েছে।

[সূরাহ আল বাকারাহ:১৬৪] 

তাছাড়া চাষাবাদ (এবং সংশ্লিষ্ট কাজে) ব্যবহৃত কিছু জমিকেও হাদীসে 'আরদ' বলা হয়েছে। যেমন তিরমিযীতে বর্ণিত আছে: 

 ‏ ‏ ‏عَنْ ‏ ‏جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ ‏ ‏عَنْ النَّبِيِّ ‏ ‏صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ‏ ‏قَالَ ‏ ‏مَنْ ‏ ‏أَحْيَى ‏ ‏أَرْضًا ‏ ‏مَيِّتَةً ‏ ‏فَهِيَ لَهُ ‏ ‏قَالَ ‏ ‏أَبُو عِيسَى ‏ ‏هَذَا ‏ ‏حَدِيثٌ حَسَنٌ صَحِيحٌ ٠ 

 الترمذي: كتاب الأحكام عن رسول اللهﷺ: باب مَا ذُكِرَ فِي إِحْيَاءِ أَرْضِ الْمَوَاتِ٠

জাবির ইবনু আবদুল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: যে ব্যক্তি পড়ে থাকা (মালিকানাহীন/অনাবাদী) জমিকে আবাদ করবে, সেই তার মালিক হবে।

[তিরমিযী:বিচার কার্য অধ্যায়,বাব: পড়ে থাকা (অনাবাদী) জমিকে চাষাবাদযোগ্য করা]

আরো বর্ণিত আছে:

عَنْ سَالِمٍ عَنْ أَبِيهِ قَالَ قَالَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم مَنْ أَخَذَ مِنْ الأَرْضِ شَيْئًا بِغَيْرِ حَقِّهِ خُسِفَ بِهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ إِلَى سَبْعِ أَرَضِينَ ٠

সালিম (রহ.)-এর পিতা হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে সামান্য পরিমাণ জমিও নিয়ে নিবে, কিয়ামতের দিন তাকে সাত তবক জমিনের নীচ পর্যন্ত ধসিয়ে দেয়া হবে।

[সহীহ্ আল বুখারী:كتاب المظالم]

৭. আল কুরআনে মাটিকে 'আরদ' বলা হয়েছে। যেমন: 

اَمِ اتَّخَذُوۡۤا اٰلِهَۃً مِّنَ الۡاَرۡضِ هُمۡ یُنۡشِرُوۡنَ ٠

তারা মাটি হতে তৈরি যে সব দেবতা গ্রহণ করেছে সেগুলি কি মৃতকে জীবিত করতে সক্ষম?

[সূরাহ আল আম্বিয়া:২১]

আল্লাহ তায়ালা বলেন:

قَالُوۡۤا ءَ اِذَا ضَلَلۡنَا فِی الۡاَرۡضِ ءَ اِنَّا لَفِیۡ خَلۡقٍ جَدِیۡدٍ ۬ؕ بَلۡ هُمۡ بِلِقَآیِٔ رَبِّهِمۡ کٰفِرُوۡنَ ٠

আর তারা বলে, আমরা যখন মাটিতে মিশে যাব তখন কি আবার নতুন করে সৃষ্টি হবো? বরং তারা তো তাদের রবের সাক্ষাৎকে অস্বীকারকারী!

[সূরাহ আস সাজদাহ্:১০]

৮. আল্লাহ তায়ালা ইউসুফ (আঃ)-কে মিসর দেশে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। এ দেশকে 'আরদ' হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন:

 وَ قَالَ الَّذِی اشۡتَرٰىهُ مِنۡ مِّصۡرَ لِامۡرَاَتِهٖۤ اَکۡرِمِیۡ مَثۡوٰىهُ عَسٰۤی اَنۡ یَّنۡفَعَنَاۤ اَوۡ نَتَّخِذَهٗ وَلَدًا ؕ وَ کَذٰلِکَ مَکَّنَّا لِیُوۡسُفَ فِی الۡاَرۡضِ ۫ وَ لِنُعَلِّمَهٗ مِنۡ تَاۡوِیۡلِ الۡاَحَادِیۡثِ ؕ وَ اللّٰهُ غَالِبٌ عَلٰۤی اَمۡرِهٖ وَ لٰکِنَّ اَکۡثَرَ النَّاسِ لَا یَعۡلَمُوۡنَ ٠

আর মিসরের যে ব্যক্তি তাকে ক্রয় করেছিল, সে তার স্ত্রীকে বলল, এর থাকার সুন্দর-সম্মানজনক ব্যবস্থা কর। আশা করা যায়, সে আমাদের উপকার করবে অথবা আমরা তাকে পুত্ররূপে গ্রহণ করব এবং এভাবেই আমি যমীনে ইউসুফকে প্রতিষ্ঠিত করলাম এবং যেন আমি তাকে স্বপ্নের ব্যাখ্যা শিক্ষা দেই। আল্লাহ নিজ কর্ম সম্পাদনে প্রবল; কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা জানে না। 

[সূরাহ ইউসুফ:২১]

আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন:

وَ کَذٰلِکَ مَکَّنَّا لِیُوۡسُفَ فِی الۡاَرۡضِ ۚ یَتَبَوَّاُ مِنۡهَا حَیۡثُ یَشَآءُ ؕ نُصِیۡبُ بِرَحۡمَتِنَا مَنۡ نَّشَآءُ وَ لَا نُضِیۡعُ اَجۡرَ الۡمُحۡسِنِیۡنَ 

এভাবে আমি ইউসুফকে পৃথিবীতে (সেই দেশে) প্রতিষ্ঠিত করলাম। সে সেই দেশে যথা ইচ্ছা অবস্থান করতে পারত। আমি যাকে ইচ্ছা তার প্রতি দয়া করি, আর আমি সৎ কর্মপরায়ণদের শ্রমফল বিনষ্ট করিনা। 

[সূরাহ ইউসুফ:৫৬]

قَالَ اجۡعَلۡنِیۡ عَلٰی خَزَآئِنِ الۡاَرۡضِ ۚ اِنِّیۡ حَفِیۡظٌ عَلِیۡمٌ ٠

সে বলল, আমাকে জমিনের তথা রাষ্ট্রীয় কোষাগারের দায়িত্ব দিন, নিশ্চয় আমি যথাযথ হেফাযতকারী, সুবিজ্ঞ।

[সূরাহ ইউসুফ:৫৫]

قَالُوۡا تَاللّٰهِ لَقَدۡ عَلِمۡتُمۡ مَّا جِئۡنَا لِنُفۡسِدَ فِی الۡاَرۡضِ وَ مَا کُنَّا سٰرِقِیۡنَ

ইউসুফের ভাইয়েরা বলল, আল্লাহর শপথ! তোমরা তো জান আমরা এ দেশে অশান্তি সৃষ্টি করতে আসিনি, আর আমরা চোরও নই।

[সূরাহ ইউসুফ:৭৩] 

এসব আয়াতে আলোচ্য দেশ মিসরকে 'আরদ' বলা হয়েছে 

৯. কোন বিশেষ জাতি-গোষ্ঠীর এলাকার  ক্ষেত্রেও 'আরদ' শব্দের ব্যবহার এসেছে:

 وَ اِلٰی ثَمُوۡدَ اَخَاهُمۡ صٰلِحًا ۘ قَالَ یٰقَوۡمِ اعۡبُدُوا اللّٰهَ مَا لَکُمۡ مِّنۡ اِلٰهٍ غَیۡرُهٗ ؕ قَدۡ جَآءَتۡکُمۡ بَیِّنَۃٌ مِّنۡ رَّبِّکُمۡ ؕ هٰذِهٖ نَاقَۃُ اللّٰهِ لَکُمۡ اٰیَۃً فَذَرُوۡهَا تَاۡکُلۡ فِیۡۤ اَرۡضِ اللّٰهِ وَ لَا تَمَسُّوۡهَا بِسُوۡٓءٍ فَیَاۡخُذَکُمۡ عَذَابٌ اَلِیۡمٌ ٠

আর আমি সামূদ জাতির নিকট (প্রেরণ করেছি) তাদের ভাই সালিহকে। সে বলল, হে আমার কওম, তোমরা আল্লাহর ইবাদাত কর। তিনি ছাড়া তোমাদের কোন (সত্য) ইলাহ নেই। নিশ্চয় তোমাদের নিকট তোমাদের রবের পক্ষ থেকে স্পষ্ট প্রমাণ এসেছে। এটি আল্লাহর উষ্ট্রী,তোমাদের জন্য নিদর্শনস্বরূপ। সুতরাং তোমরা তাকে ছেড়ে দাও, সে আল্লাহর যমীনে আহার করুক। আর তোমরা তাকে মন্দ দ্বারা স্পর্শ করো না। তাহলে তোমাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক আযাব পাকড়াও করবে।

[সূরাহ হূদ:৬১]

১০. আল্লাহ তায়ালা যুলকরনাইন (আঃ)-কে সারা পৃথিবীর (তথা পৃথিবীর উল্লেখযোগ্য অঞ্চলের) কর্তৃত্ব দান করেছিলেন। তার অধীনস্থ দেশসমূহের বিষয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেন:

اِنَّا مَکَّنَّا لَهٗ فِی الۡاَرۡضِ وَ اٰتَیۡنٰهُ مِنۡ کُلِّ شَیۡءٍ سَبَبًا ٠

আমি তাকে পৃথিবীতে কর্তৃত্ব দিয়েছিলাম এবং প্রত্যেক বিষয়ের উপায় প্রদান করেছিলাম। 

[সূরাহ আল কাহাফ:৮৪]

১১. আল্লাহ তায়ালা যুলকরনাইন (আঃ)-এর ঘটনাবলীতে ইয়াজুজ-মাজুজের বিষয়ে উল্লেখ করেছেন। তারা পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করতো,তবে তা দ্বারা পৃথিবীর সব এলাকার কথা বলা হয়নি। বরং(তৎকালীন) কোন বিশেষ অঞ্চলের কথাই তাতে বলা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন:

قَالُوۡا یٰذَاالۡقَرۡنَیۡنِ اِنَّ یَاۡجُوۡجَ وَ مَاۡجُوۡجَ مُفۡسِدُوۡنَ فِی الۡاَرۡضِ فَهَلۡ نَجۡعَلُ لَکَ خَرۡجًا عَلٰۤی اَنۡ تَجۡعَلَ بَیۡنَنَا وَ بَیۡنَهُمۡ سَدًّا ٠

তারা বলল, ‘হে যুলকারনাইন! নিশ্চয় ইয়া’জূজ ও মা’জূজ পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করছে, তাই আমরা কি আপনাকে এ জন্য কিছু খরচ দেব যে, আপনি আমাদের ও তাদের মধ্যে একটা প্রাচীর নির্মাণ করে দিবেন’? 

[সূরাহ আল কাহাফ:৯৪]

১২.পৃথিবীর কোন বিশেষ বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন দেশ বা ভূমি বুঝাতেও 'আরদ' শব্দের ব্যবহার এসেছে। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন:

اِنَّ الَّذِیۡنَ تَوَفّٰهُمُ الۡمَلٰٓئِکَۃُ ظَالِمِیۡۤ اَنۡفُسِهِمۡ قَالُوۡا فِیۡمَ کُنۡتُمۡ ؕ قَالُوۡا کُنَّا مُسۡتَضۡعَفِیۡنَ فِی الۡاَرۡضِ ؕ قَالُوۡۤا اَلَمۡ تَکُنۡ اَرۡضُ اللّٰهِ وَاسِعَۃً فَتُهَاجِرُوۡا فِیۡهَا ؕ 

 فَاُولٰٓئِکَ مَاۡوٰىهُمۡ جَهَنَّمُ ؕ وَ سَآءَتۡ مَصِیۡرًا ٠

নিশ্চয় যারা নিজদের প্রতি যুলমকারী, ফেরেশতারা তাদের জান কবজ করার সময় বলে, তোমরা কী অবস্থায় ছিলে? তারা বলে, আমরা জমিনে দুর্বল-নির্যাতিত ছিলাম। ফেরেশতারা বলে, আল্লাহর যমীন কি এমন প্রশস্ত ছিল না যেথায় তোমরা হিজরত করতে? সুতরাং তাদেরই আশ্রয়স্থল জাহান্নাম। আর তা মন্দ প্রত্যাবর্তনস্থল। 

[সূরাহ আন নিসা:৯৭]

এ আয়াতে কাফিরদের অধীনস্থ ভূমিকে 'আরদ' বলা হয়েছে, যেখানে কাফিরদের দ্বারা মুমিনগণ নির্যাতিত হতো; এবং (একই আয়াতে) তুলনামূলক নিরাপদ কিংবা ইসলামী রাষ্ট্রকেও 'আরদ' হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। 

এ আয়াতে দুবার দুটি 'আরদ'-এর কথা এসেছে। প্রথমটি "আমরা পৃথিবীতে অসহায়-নির্যাতিত ছিলাম" দ্বারা মক্কা (এবং এর অনুরূপ সমস্যায় আক্রান্ত ভূমি বা দেশ) উদ্দেশ্য। 

আর দ্বিতীয়টি "আল্লাহর জমিন কি এমন প্রশস্ত ছিল না, যেথায় তোমরা হিজরত করতে?" দ্বারা (তৎকালে) মাদীনাহ্, হাবশা ইত্যাদি (এবং অনুরূপ অন্যান্য) নিরাপদ ভূমি, দেশ, রাষ্ট্র উদ্দেশ্য।  

[বিস্তারিত বিভিন্ন তাফসীর গ্রন্থ দ্রঃ]

১৩. মূসা (আঃ)-এর সম্প্রদায় ফিরআওনের কবল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর তাদেরকে যে পবিত্র ভূমিতে প্রবেশ করতে বলা হয়েছিল তাকেও আরদ বলা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন:

یٰقَوۡمِ ادۡخُلُوا الۡاَرۡضَ الۡمُقَدَّسَۃَ الَّتِیۡ کَتَبَ اللّٰهُ لَکُمۡ وَ لَا تَرۡتَدُّوۡا عَلٰۤی اَدۡبَارِکُمۡ فَتَنۡقَلِبُوۡا خٰسِرِیۡنَ٠

হে আমার কওম! তোমরা পবিত্র ভূমিতে প্রবেশ কর, যা আল্লাহ তোমাদের জন্য লিখে দিয়েছেন এবং তোমরা তোমাদের পেছনে ফিরে যেয়ো না, তাহলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে প্রত্যাবর্তন করবে।

[সূরাহ আল মায়িদাহ্:২১]

এরপর তারা তাতে প্রবেশ করতে অস্বীকার করে, তখন তারা যে তীহ্ নামক প্রান্তরে অবস্থান করছিল সে প্রান্তরকেও আল্লাহ তায়ালা 'আরদ' নামে অভিহিত করেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন:

قَالَ فَاِنَّهَا مُحَرَّمَۃٌ عَلَیۡهِمۡ اَرۡبَعِیۡنَ سَنَۃً ۚ یَتِیۡهُوۡنَ فِی الۡاَرۡضِ ؕ فَلَا تَاۡسَ عَلَی الۡقَوۡمِ الۡفٰسِقِیۡنَ٠

তিনি বললেন, তাহলে তা তাদের জন্য চল্লিশ বছর নিষিদ্ধ রইল; তারা জমিনে উদ্ভ্রান্ত হয়ে ঘুরতে থাকবে। সুতরাং তুমি ফাসিক কওমের জন্য দুঃখ করো না। 

[সূরা আল মায়িদাহ্:২৬]

১৪. জান্নাত বা জান্নাতের ভূমি বুঝাতেও الارض শব্দের ব্যবহার এসেছে। যেমন, আল্লাহ তায়ালা বলেন:

وقَالُوا الۡحَمۡدُ لِلّٰهِ الَّذِیۡ صَدَقَنَا وَعۡدَهٗ وَ اَوۡرَثَنَا الۡاَرۡضَ نَتَبَوَّاُ مِنَ الۡجَنَّۃِ حَیۡثُ نَشَآءُ ۚ فَنِعۡمَ اَجۡرُ الۡعٰمِلِیۡنَ ٠ 

(জান্নাতে প্রবেশ করে) তারা বলবে- সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর যিনি তাঁর ওয়াদাকে সত্যে পরিণত করেছেন, আর আমাদেরকে এই (জান্নাতের) ভূমির অধিকারী বানিয়েছেন। আমরা জান্নাতের যেথায় ইচ্ছে বসবাসের জায়গা করে নিতে পারি। সৎকর্মশীলদের প্রতিফল কতই না উত্তম! 

[সূরা আয যুমার:৭৪]

আর,নিম্নোক্ত আয়াতে উল্লিখিত 'আরদ' শব্দ দ্বারা জান্নাতের ভূমি, কিংবা পৃথিবী ও জান্নাত উভয়টিই উদ্দেশ্য, যেরূপ অধিকাংশ  তাফসীরগ্রন্থে এসেছে। যেমন,আল্লাহ তায়ালা বলেন:

 وَ لَقَدۡ کَتَبۡنَا فِی الزَّبُوۡرِ مِنۡۢ بَعۡدِ الذِّکۡرِ اَنَّ الۡاَرۡضَ یَرِثُهَا عِبَادِیَ الصّٰلِحُوۡنَ ٠

আমি উপদেশের পর কিতাবে লিখে দিয়েছি যে, আমার সৎকর্মপরায়ণ (যোগ্যতাসম্পন্ন) বান্দাগণ পৃথিবীর অধিকারী হবে।

[সূরাহ আল আম্বিয়া:১০৫] 

আরো দ্রঃ ৯:২৫,৩৯...

আলহামদুলিল্লাহ, আমরা দেখলাম- الارض শব্দ দ্বারা বুঝায় -

১. জান্নাত বা জান্নাতের ভূমি

২. পৃথিবী গ্রহ

৩. সমগ্র ভূ-পৃষ্ঠ

৪. ভূপৃষ্ঠের মানব অধ্যুষিত অঞ্চল বা দেশ সমূহ

৫. কোন বিশেষ দেশ বা রাষ্ট্রকে (সরাসরি বা ইঙ্গিতে) আরদ বলা হয়েছে ; যেমন: মিসর, মক্কা, মাদীনাহ্, হাবশা ইত্যাদি। 

৬. কোন বিশেষ বা বিশাল প্রান্তর, ময়দান

৭. বিভিন্ন ধরণের জমি/ভূমি

৮. একখণ্ড বা কিছু জমি  

৯. মাটি... ইত্যাদি   

সুতরাং الارض (আরদ) শব্দের অর্থ হিসেবে আমরা জান্নাত/পৃথিবী/ভূ-পৃষ্ঠ/ভূমি/জমি/জমিন/মাটি ইত্যাদি যে শব্দই ব্যবহার করি তাতে সমস্যা নেই। তবে এসব শব্দকে আমরা কোথায় কোন ক্ষেত্রে বা কতটুকু সীমাবদ্ধ বা বিস্তৃত অর্থে গ্রহণ ও ব্যবহার করছি সে ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে। 

কেননা, 'আরদ' একখণ্ড জমিকেও বলা হয়, একটা দেশকেও বলা যায়,আবার সারা পৃথিবীকেও বলা হয়...আবার জান্নাত বা জান্নাতের ভূমিকেও 'আরদ' বলা হয়। 

প্রকৃতপক্ষে, এ নিবন্ধে আমরা সেটাই স্পষ্ট করছি, উক্ত (২৪:৫৫) আয়াতে উল্লিখিত 'আরদ' দ্বারা কোন ধরণের/কতটুকু ভূমি বুঝানো হয়েছে...?

ইতোমধ্যেই আমরা এসব শব্দের বহুবিধ ব্যবহার ও বিভিন্ন অর্থ দেখেছি, আলহামদুলিল্লাহ।

পূর্বোক্ত আয়াত (২৪:৫৫) এবং এর তাফসীর অনুযায়ী - রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দুনিয়ার জীবনের শেষদিকে (তাবুক যুদ্ধাভিযান এবং এর পর) পৃথিবীতে ইসলাম ও ইসলামী ভূমির কর্তৃত্ব-ক্ষমতা উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি লাভ করেছিল, সেটিই ঐ প্রতিশ্রুত খিলাফাহর প্রথম বাস্তব রূপ। [রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পর প্রথম খলীফাহ্  আবু বাকর (রাঃ)-এর সময় এবং পরবর্তিতে এটা আরো বিস্তৃত হয়।]

তৎকালীন পৃথিবীর দুই বৃহৎ শক্তি রোম ও পারস্য সাম্রাজ্যের তুলনায় মাদীনাহ্ কেন্দ্রিক নতুন ইসলামী রাষ্ট্র ছিল যথেষ্ট শক্তিশালী। এই নতুন বিশ্বশক্তি রোম ও পারস্য সাম্রাজ্যের সাথে পাল্লা দেয়ার মতো শক্তিতে পরিণত হয়েছিল। 

তৎকালীন পৃথিবীর দুই বৃহৎ শক্তি রোম ও পারস্য সাম্রাজ্যের সাথে রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহুআলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মাদীনাহ্ কেন্দ্রিক এই নতুন ইসলামী কর্তৃত্ব তথা খিলাফাহর তুলনামূলক চিত্র চোখের সামনে রাখলে (খিলাফাহ্ বিলুপ্তির পর বর্তমান বা অদূর ভবিষ্যতে) কাঙ্ক্ষিত খিলাফাহর স্বরূপ আমাদের নিকট স্পষ্ট হবে, ইনশাআল্লাহ। 

শক্তি-ক্ষমতার এই তুলনামূলক চিত্রটা কেন জরুরি? এটাই বলছি:

যেহেতু আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা মুমিনগণকে পৃথিবীতে খিলাফাহ্ বা রাজত্ব ও কর্তৃত্ব দানের ওয়াদা করেছেন, সেহেতু তা অবশ্যই পৃথিবীর রাজত্ব-কর্তৃত্বের সাথে সম্পৃক্ত এবং অন্যান্য কর্তৃত্বের তুলনায় উল্লেখযোগ্য (মানের) হবে, যেরূপ রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ক্ষেত্রে হয়েছিল। এই খিলাফাহ্ তথা শাসন-কর্তৃত্বের সাথে আরো সংশ্লিষ্ট দুটি বিষয়ও (আল্লাহর মনোনীত দীন প্রতিষ্ঠা এবং নিরাপত্তা) উক্ত আয়াতে এসেছে। 

এটাও মনে রাখতে হবে যে, শক্তি-শাসন-ক্ষমতা-কর্তৃত্ব, দীন প্রতিষ্ঠার পূর্ণতা এবং নিরাপত্তা ইত্যাদি বিষয়গুলো আপেক্ষিক, বিধায় তা অন্যান্য শক্তি, ক্ষমতা,  কর্তৃত্ব এবং দীন প্রতিষ্ঠা ও নিরাপত্তার সাথে তুলনামূলক আলোচনা করেই প্রকাশিত হয়।   

তৎকালীন পৃথিবীতে এশিয়া ইউরোপ ও আফ্রিকা এ তিন মহাদেশেই প্রায় সকল মানুষের বসবাস ছিল। আর এর মধ্যে বৃহৎ রাষ্ট্র বা পরাশক্তি তথা উল্লেখযোগ্য শাসন-কর্তৃত্ব ছিল দুটি, তা হলো- রোম ও পারস্য। (এছাড়াও আরো অনেক দেশ ও রাষ্ট্র ছিল, তবে সেগুলো এই দুটির মত শক্তিশালী ছিল না।) 

পর্যায়ক্রমে মাদীনাহ্ কেন্দ্রিক শাসন-কর্তৃত্ব বিস্তৃত হতে থাকে। অবশেষে রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর (দুনিয়ার) জীবনের শেষদিকে বা প্রথম খলীফাহ্ আবু বাকর (রাঃ)-এর সময় মাদীনাহ্ শাসন-কর্তৃত্বে ও ক্ষমতায়, নিরাপত্তা ইত্যাদি বিষয়ে রোমান ও পারস্য সাম্রাজ্যের সাথে পাল্লা দেয়ার অবস্থায় উপনীত হয়।

একটু আগে আমরা ঐ আয়াতের তাফসীরে দেখেছি - রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মৃত্যুর পূর্বে আরব উপদ্বীপ ও এর পার্শ্ববর্তী অনেক অঞ্চল, এমনকি রোম ও পারস্য সাম্রাজ্যের পার্শ্ববর্তী কিছু (সীমান্ত) এলাকা ইসলামী শাসন-কর্তৃত্বের অধীনস্থ হয়। শুধু তা-ই নয়, রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর তাবুক অভিযানকালে মুসলিমরা রোমানদের সীমান্তে গিয়ে তাদেরকে ভীত-সন্ত্রস্ত করেন। রোমানরা নিজেরাই সীমান্ত ছেড়ে ভিতরে পালিয়ে যায়। তখন তারা ইসলামী বাহিনীর সামনে আসতে সাহস করে নি। রোম-পারস্য এত শক্তিশালী সাম্রাজ্য হওয়া সত্ত্বেও ইসলামী ভূমিতে এসে যুদ্ধ করা তো দূরের কথা, নিজেদের সীমান্তেও কোন প্রতিরোধ করতে পারে নাই। এ সময় রোমান ও পারস্য সাম্রাজ্যের শাসন-কর্তৃত্বের তুলনায় ইসলামী শাসন-কর্তৃত্বের (তুলনামূলক) চিত্র চোখের সামনে রাখলেই এটা স্পষ্ট হয় যে, এ (২৪:৫৫) আয়াতে আল্লাহ তায়ালা যে ওয়াদা করেছেন তার কাঙ্ক্ষিত স্বরূপ তখন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। 

উল্লেখ্য, রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ওফাতের পূর্বে আরব উপদ্বীপসহ বিশাল বিস্তীর্ণ ভূমির উপর ইসলামী শাসন-কর্তৃত্ব ও সংশ্লিষ্ট বিষয় এবং সুফলসমূহ বিদ্যমান থাকাবস্থায়ই আরবের কিছু গোত্র ও এলাকায় কিছু লোক মুরতাদ হয়ে যায়। এরপর আবু বাকর (রাঃ)-এর খিলাফাহর শুরুতে এটা আরো বৃদ্ধি পায়। তবে খিলাফাহর এ বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডের মধ্যে কয়েকটি এলাকায় মুরতাদরা সংগঠিত থাকলেও অধিকাংশ এলাকার মুরতাদরা ছিল বিক্ষিপ্ত এবং তাদের উল্লেখযোগ্য কোন ভূমির কর্তৃত্বও ছিল না। বিধায় আবু বাকর (রাঃ)-এর খিলাফাহর ভৌগোলিক কর্তৃত্ব দুর্বল হয় নি। ফলে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লার দয়ায় সকল মুসলিমকে সাথে নিয়ে এক বছরের কম (আট-দশ মাস) সময়ের মধ্যেই তিনি মুরতাদদের দমন করেন এবং দুই পরাশক্তি রোম ও পারস্য সাম্রাজ্যের সাথে পাল্লা দিয়ে যুদ্ধ করতে ও তাদের বিভিন্ন অঞ্চল দখল করতে থাকেন। আর এর পরের ইতিহাস তো সবার জানা। আলহামদুলিল্লাহ। 

ইতোপূর্বে আমরা দেখেছি- 

খিলাফাহ্ অর্থ ইমারাহ্ বা ইসলামী শাসন-কর্তৃত্ব ও প্রতিনিধিত্ব ; 

খিলাফাহ্ অর্থ মুলক বা রাজত্ব; 

খিলাফাহ্ অর্থ ইমামত বা ইসলামী নেতৃত্ব;  

আর তা হল শক্তি ও ক্ষমতাবান শাসন-কর্তৃত্ব বা রাষ্ট্র, যাকে আমরা বলতে পারি- হুকুমাতে ইলাহী বা পৃথিবীতে আল্লাহর আইন ও বিধানের শাসন-কর্তৃত্ব।  

শক্তি,ক্ষমতা,শাসন,কর্তৃত্ব ইত্যাদি আপেক্ষিক বিষয়, এগুলো আনুপাতিক বা তুলনামূলকভাবে ব্যবহৃত হয়। কেননা, প্রত্যেক ব্যক্তিরই কিছু না কিছু শক্তি ক্ষমতা আছে। আবার,পরিবারের মধ্যেও শাসন আছে, সমাজে এবং রাষ্ট্রের মধ্যেও শাসন ব্যবস্থা আছে। আবার বৈশ্বিক শাসন ব্যবস্থাও আছে। আর সব কিছুর উপরে আল্লাহ তায়ালার কর্তৃত্ব তো আছেই। তাহলে আমাদের আলোচ্য খিলাফাহর শাসন-কর্তৃত্ব কোনটা? আমাদের এটাই নির্ণয় করতে হবে।

      

বর্তমানে যদি আপনাকে বলা হয়, পৃথিবীতে শক্তিশালী একটি দেশের নাম বলুন...। আপনি নিশ্চয়ই বাংলাদেশের নাম বলবেন না। এমনকি যেগুলো বাংলাদেশের চেয়ে শক্তিশালী সেসব দেশের নামও বলবেন না। যদিও আপনাকে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী দেশের নাম বলতে বলা হয়নি, তারপরও আপনি ঐসব দেশের নামই বলবেন যেগুলো শক্তির বিচারে তুলনামূলক উল্লেখযোগ্য। কারণ, শক্তি ও কর্তৃত্ব শব্দগুলো আপেক্ষিকভাবে প্রয়োগ করা হয়, এবং শব্দের মধ্যে সাধারণভাবে যে মর্ম নিহিত আছে সেটা আপনি বুঝতে পারেন; তাই আপনি স্বাভাবিক বিবেচনা থেকেই পৃথিবীর তুলনামূলক শক্তিশালী দেশের নামই বলবেন।  কম শক্তিশালী বা দুর্বল দেশের নাম বলবেন না। বরং আপনি পৃথিবীর মধ্যে শক্তিশালী ও উল্লেখযোগ্য কিছু দেশের নামই বলবেন...। 

আরেকটি বিষয় স্মরণ রাখা যেতে পারে, তা হলো:

অনেক শারঈ আমল বাস্তবায়নে উল্লেখযোগ্য বস্তুগত উপায়-উপকরণ প্রয়োজন হয় না। যেমন: ঈমানের বিষয়সমূহে আন্তরিক বিশ্বাস স্থাপন, দুআ, যিকর... ইত্যাদি।    

আবার, শারীআহতে নির্ধারিত ও কাঙ্ক্ষিত অনেক আমল বাস্তবায়নে উল্লেখযোগ্য বস্তুগত উপায়-উপকরণ প্রয়োজন হয়। যেমন: তহারাত, সলাত, হাজ্জ, জিহাদ ইত্যাদি। 

সুতরাং, যেসব আমল বাস্তবায়ন করতে কোন উপকরণ বা বস্তুগত বিষয়ের প্রয়োজন হয়, অর্থাৎ যেসব শারঈ বিধান কোন উপায়-উপকরণ বা বস্তুগত বিষয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট, তা বাস্তবায়ন করতে যথাযথ পরিমাণ বস্তুগত বিষয়/উপকরণ অর্জন করতে হবে। কিন্তু তা অর্জন না করলে কিংবা সামান্য বা নামমাত্র উপকরণ অর্জন করে দাবি করলেও তাতে কাঙ্ক্ষিত আমল বাস্তবায়িত হবে না। 

যেমন, গোসল করার জন্য প্রয়োজনীয় পানি সংগ্রহ বা অর্জন করতে হবে। কিন্তু কেউ যদি গোসলের জন্য উপযোগী ও প্রয়োজনীয় পানি সংগ্রহ না করে শুধু গোসলের শাব্দিক অর্থ ধৌত করার বিষয়টি মাথায় রেখে সামান্য পানি দিয়ে শরীরের দু'একটা অঙ্গ ধৌত করে গোসলের দাবি করে তবে তা গৃহীত হবে না। তেমনি এ পানি রাখা ও ব্যবহারের জন্যও যথাযথ পাত্র/স্থান ইত্যাদি জরুরি। 

একইভাবে, হাদীসে (সমগ্র) জমিনকে মাসজিদ বলা হয়েছে; আবার শারীআহতে পৃথকভাবে বা বিশেষভাবে কোন স্থান নির্ধারণ করে মাসজিদ তৈরি করতে উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। 

এখন কেউ যদি মাসজিদের জন্য যে স্থান প্রয়োজন তা ছাড়াই 'সমগ্র জমিন মাসজিদ' এই দাবি করে যে কোন স্থানকে ঐ পারিভাষিক মাসজিদের মত দাবি করে ও মাসজিদের হুকুম প্রয়োগ করে তবে তা সঠিক হবে না।

এজন্য সংশ্লিষ্ট যুগ, স্থান, কাল, অবস্থা, শক্তি ও ক্ষমতার তুলনামূলক চিত্র, বৈশ্বিক শক্তির ভারসাম্য ইত্যাদি বিবেচনায় নিতে হবে। তবে এটা যেহেতু দাবি করার বিষয় নয়, তাই এরূপ দাবি করাও যাবে না। তবে আমাদের কতটুকু শক্তি-ক্ষমতা, শাসন-কর্তৃত্ব অর্জিত হলে বা থাকলে আমরা তাকে খিলাফাহ্ মনে করতে পারব, তা নির্ণয় করতে হলে পূর্বে বর্ণিত মানের সক্ষমতা থাকা আবশ্যক। আর এ জন্য সংশ্লিষ্ট যুগের সংশ্লিষ্ট আমলে সবচেয়ে অভিজ্ঞ, যোগ্য ও প্রবীণ ভাইগণই (সমন্বিতভাবে) এ বিষয়ে ইজতিহাদী সিদ্ধান্ত প্রদানের অধিক যোগ্য বিবেচিত হবেন, যা সমন্বিতভাবে সকল শারঈ দলীল, ঐতিহাসিক ও বর্তমান বাস্তবতা, সুস্থ বিবেক-বুদ্ধি ও অখণ্ডনীয় যুক্তির সাথে পরিপূর্ণ সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে এবং হবে, ইনশাআল্লাহ। 

কিন্তু হঠাৎ করে সামান্য কিছু ভূমির কর্তৃত্ব পেয়েই ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে কেউ কেউ আবেগ তাড়িত হয়ে অথবা অন্য কোন ক্ষুদ্র স্বার্থেও খিলাফাহ্/খলীফাহ্ দাবি করে ফেলতে পারেন (!) এরূপ দৃষ্টান্তও আছে। এরূপ অবাস্তব ও প্রতারণামূলক দাবির কারণে উম্মাহর মাঝে বিবাদ বৃদ্ধি পায়, উম্মাহর অগ্রগতি ব্যাহত হয় এবং উম্মাহ্ নানাবিধ ক্ষতির সম্মুখীন হয়। সুতরাং এ ব্যাপারে সবাইকে সচেতন ও সতর্ক থাকতে হবে। আল্লাহ তায়ালা আমাদের দীনী ও সামগ্রিক সচেতনতা ও যোগ্যতা দান করুন।

মোটকথা, খিলাফাহ্ ঘোষণা বা দাবি করার বিষয় নয় বরং এটা অর্জন ও প্রতিষ্ঠা করার বিষয়।  

[একটি স্মৃতিচারণ ও অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয়: ২০০৬ এর পর থেকে একটি আন্তর্জাতিক ইসলামী সংগঠনের কিছু নবীন সমর্থক বাংলাদেশেও তাদের পক্ষে কিছু প্রচারণা চালাতেন। ২০১০-২০১১ সনের দিকে তাদের সাথে আমার নিয়মিত আলোচনাও হতো। তাদের মধ্যে এমন কিছু অতি আবেগী বা অতি উৎসাহী ছিলেন যারা প্রায়ই খিলাফাহ্ সম্পর্কে বলতে গিয়ে কিছু আজব ও অবাস্তব কথা বলতেন! যেমন ...ঘুম থেকে উঠেই শুনবো খিলাফাহর ঘোষণা হয়ে গেছে...!! ইত্যাদি। 

আর, ২০১৪ সালে আমরা দেখলাম ইরাকের মুজাহিদ ভাইদের কাল্পনিক খিলাফাহর ঘোষণা!!!]   

এ সম্পর্কে ভাষাগত একটা মজার বিষয় আছে, তা হলো: 

خلافة শব্দের শেষাক্ষর (ة) বাদ দিলে শব্দটি হয়- خلاف, এর অর্থ হলো: মতভেদ, বিরোধ, বিবাদ, বিতর্ক, অমিল ইত্যাদি।

আর, خليفة শব্দের শেষাক্ষর (ة) বাদ দিলে শব্দটি হয়- خليف, এর অর্থ হলো: ওয়াদা ভঙ্গকারী, পিছনে পড়ে আছে এমন ...ইত্যাদি। 

আমরা ইতোপূর্বে খিলাফাহর স্বরূপ নিয়ে যে দালীলিক আলোচনা করেছি,তা অর্জন না করেই যদি কেউ তা দাবি করে তবুও তা খিলাফাহ্ হবে না। বরং তখন তা হবে - 

خلاف, অর্থাৎ: মতভেদ, বিরোধ, বিবাদ, বিতর্ক, অমিল ইত্যাদির কেন্দ্রবিন্দু।

আর যখন প্রকৃত অর্থেই উক্ত খিলাফাহ্ অর্জিত হবে (এবং প্রতিষ্ঠিত থাকবে) কেবল তখনই খলীফাহ্ মনোনীত করতে হবে, তার আগে নয়। যদি ঐ (প্রকৃত) খিলাফাহ্ ছাড়াই খলীফাহ্ ঘোষণা করা হয় তবে (শারীআহ্ ও বাস্তবতা অনুযায়ী) তার কোন মূল্য ও কার্যকারিতা নেই। বরং তার অবস্থা মিলে যায়- خليف শব্দের সাথে, এর অর্থ হলো: ওয়াদা ভঙ্গকারী...ইত্যাদি। 

আসলে এরূপ (খিলাফাহ্ বিহীন) অবস্থায় কোন ওয়াদা ভঙ্গকারীর পক্ষেই কেবল (নামসর্বস্ব) খলীফাহ্ দাবি করা সম্ভব।  

বাস্তবে এরূপই দেখবেন, যদি প্রকৃত খিলাফাহ্ ও খলীফাহ্ না হয় তবে তাদের অবস্থা উক্ত শব্দদ্বয়ের অর্থসমূহের সাথে মিলে যাবে। 

উল্লেখ্য, শিয়াদের দ্বাদশ ইমামের অনেকেই কখনো খিলাফাহর অধিকারী হন নাই, তা সত্ত্বেও শিয়া সম্প্রদায় তাদেরকে ইমাম/খলীফাহ্ হিসেবে মানে! অথচ (শিয়াদের বিরোধী হয়েও) এখন অনেকে শিয়াদের অনুসরণ করতে চাচ্ছেন! আশ্চর্যের বিষয় বৈকি!  

আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে সকল অন্যায় থেকে হিফাজত করুন। 

[একটি যদির কথা:

যদি কিছু ভূমির শাসন-কর্তৃত্ব পেলেই তা খিলাফাহ্ হয় তবে আফগানিস্তান এবং অন্য যেসব ভূমি মুজাহিদগণের দখলে ছিল বা বর্তমানে আছে, সেগুলোকে কেউ খিলাফাহ্  দাবি না করলেও নিশ্চিতভাবেই সেগুলো খিলাফাহ্। কেননা তাদের অনেক ভূমি আছে, কিছু কিছু এলাকায় বা ভূমিতে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা এবং তুলনামূলক নিরাপত্তাও আছে! সুতরাং তারা উক্ত ভূমিকে খিলাফাহ্ দাবি না করলেও তা খিলাফাহ্!!] 

আসলে শারঈ নীতি ও বিধান অনুযায়ী খিলাফাহ্ দাবি করার কেন প্রয়োজন নেই। আর কখনো 'খিলাফাহ্' প্রতিষ্ঠিত হলেও 'খিলাফাহ্' শব্দই দাবি করতে হবে এরূপ কোন কথাও নেই।   

অবশ্য পূর্বোক্ত আলোচনায় স্পষ্ট হয়েছে যে, খিলাফাহ্ বা এর সমার্থক অন্যান্য শব্দের ব্যবহার করা শারীআহতে কোন জরুরি বিষয় নয়। আর খিলাফাহ্ দাবি করলেও তা হয়ে যায় না। বরং দাবি করার আগে তা অর্জন করতে হবে। যদি খিলাফাহ্ অর্জিত হয়ে যায় তবে তার দাবি না করলেও প্রকৃতপক্ষে তা খিলাফাহ্। 

সুতরাং, কোন ভূমিতে ইমারাহ্ বা ইসলামী হুকুমত থাকলেই যদি তা খিলাফাহ্ হয়, তবে আফগানসহ যেসব ভূমিতে ইসলামী ইমারাহ্ ছিল এবং এখনও বিদ্যমান আছে, এ খিলাফাহ্ (শব্দ) কেউ দাবি করুন আর না-ই করুন, তা অবশ্যই খিলাফাহ্ (হতো)। (যদিও এটা পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে, এটা দাবি করার বিষয় নয়।) বিধায়, তা বিদ্যমান থাকাবস্থায় নতুন করে কেউ কোন খিলাফাহর দাবিও করতে পারবে না। যদি কেউ দাবি করে তবে তা-ও বাতিল, কেননা তা-তো আগে থেকেই আছে, নতুন করে দাবি করার অর্থই হলো এ নিয়ে অতিরঞ্জন ও অপরাজনীতি করা, যা স্পষ্ট অন্যায় কর্মকাণ্ড হিসেবে বিবেচ্য। 

উল্লেখ্য, ছোট হলেও মাদীনাহ্ ছিল তৎকালীন আরবের একটি পূর্ণ বা স্বাধীন রাষ্ট্র, ভৌগোলিক ও ভূ-রাজনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় মাদীনাহর সাথে বর্তমানের যে কোন পূর্ণ বা স্বাধীন দেশের তুলনা করা যায়, যেমন, আফগানিস্তান; (যদিও তৎকালীন মাদীনাহর চেয়ে এর আয়তন অনেক বেশি)। অথচ এখনও এটি একটি ইমারাহ্ মাত্র। খিলাফাহর বৈশিষ্ট্য ও স্বরূপ অর্জন না করা পর্যন্ত একে খিলাফাহ্ মনে করার কোন অর্থ বা সুযোগ নেই, তা মনেও করা যাবে না ,  এরূপ মনে করলেও কোন লাভ নেই। 

খিলাফাহ্ ঘোষণা করলেই যদি তা হয়ে যেত তাহলে যারা এত কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করে আফগান ইমারাহ্ প্রতিষ্ঠা করেছেন বা অন্য যে সব এলাকার ভাইগণ কিছু ভূমি এত কষ্ট করে অর্জন করেছেন তারা এক মিনিটে মুখে ঘোষণার মত এতো সহজ কাজটি করতে পারবেন না!? অথচ খিলাফাহ্ প্রতিষ্ঠার জন্য অন্য সব কাজ বা পদক্ষেপে অনেক বাধা ও অক্ষমতা থাকলেও মুখে ঘোষণা দিতে কারো পক্ষ থেকেই কোন বাধা নেই, কেবল শারঈ বাধা ছাড়া। কারণ, যারা শারীআহ অনুসরণ করেন তাদের কথা ও কাজে মিল এবং সততা থাকে, বিধায় তারা উম্মাহর সাধারণ মানুষকে কাল্পনিক খিলাফাহ্ ও নামমাত্র খলীফাহর মৌখিক ঘোষণা দিয়ে প্রতারণা করতে পারেন না।  

অপরপক্ষে, কয়েক বছর আগে ইরাকের যে ভাইগণ অতি উৎসাহী হয়ে খিলাফাহ্ দাবি করেছিলেন, তারা তো মাদীনাহর মতোও (বা বর্তমান আফগানিস্তানের মত বা তার চেয়ে ছোট) কোন পূর্ণ বা স্বাধীন দেশ/রাষ্ট্র দখল করতে পারেন নি। বরং ইরাকের কিছু এলাকা দখল করতে পেরেছিলেন মাত্র! এমনকি ইরাকের রাজধানীও দখল করতে পারেন নি। অর্থাৎ তাদের সক্ষমতা ছিল আরও কম। সুতরাং দুই/তিন বছরের মধ্যে ইরাকের তগুত সরকার তা পুনর্দখল করে নেয়। ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা কতটা থাকলে এরূপ পরিণতি হতে পারে। তা সত্ত্বেও তারা নিজেদের আমীর, ইমাম, উস্তাদ, দীনে অগ্রগামী এবং পৃথিবীব্যাপী দীনী ভাইদের সাথে দূরত্ব, যুদ্ধ, সংঘাত সৃষ্টি করেছেন! আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে সকল অন্যায় থেকে হিফাজত করুন এবং আমাদেরকে সঠিক বুঝ দান করুন।  

 

প্রকৃতপক্ষে, এগুলো খিলাফাহ্ নয়। তবে এ সকল ভূমিকে আভিধানিক বা শাব্দিক অর্থে কেউ কেউ খিলাফাহ্ও বলতে পারে! কিন্তু আভিধানিক বা শাব্দিক অর্থে খিলাফাহ্ ও খলীফাহর নাম বা দাবির সাথে দীন ও শারীআহর কী সম্পর্ক? আর এ নাম ও দাবি দিয়ে দুনিয়া বা আখিরতে আমাদেরই বা কী লাভ হবে?       

মোটকথা, খিলাফাহ্ ঘোষণা বা দাবি করার বিষয় নয় বরং এটা অর্জন ও প্রতিষ্ঠা করার বিষয়।

আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে দীনের প্রকৃত জ্ঞান ও উপলব্ধি এবং যথাযথ আমল করার তাওফীক দানকরুন । 

         :খলীফাহ্:

:খলীফাহ্ তথা বৈধ খলীফাহ্ এবং অবৈধ খলীফাহ:

ইনশাআল্লাহ এবার আমরা আলোচনা করব খলীফাহ্ সম্পর্কে:

ইতোপূর্বে আমরা খিলাফাহ্ শব্দের নানাবিধ ব্যবহার ও বিভিন্নরূপ অর্থ উল্লেখ করেছি।

এখন আমাদের আলোচ্য বিষয়:

খলীফাহ্ কাকে বলে? 

খলীফাহ্ আগে না খিলাফাহ্?

কখন খলীফাহ্ বিষয়টি প্রাসঙ্গিক অর্থাৎ 

কখন খলীফাহ্ নির্ধারণ করতে হবে? 

খলীফাহ্ মনোনীত হওয়ার জন্য (ব্যক্তির) যোগ্যতা কী? 

কারো মধ্যে এসব যোগ্যতা থাকলেই কি তিনি খলীফাহ্?

খলীফাহ্ মনোনীত হবে কোথায় এবং কে/কারা খলীফাহ্ নির্ধারণ করবেন? 

খলীফাহ্ মনোনীত হওয়ার প্রক্রিয়া অর্থাৎ কাউকে খলীফাহ্ হিসেবে নির্ধারণ করার যথাযথ উপায় ও প্রক্রিয়া কী?

এসব বিষয়ে কিছুটা আলোচনা করছি:

 

প্রথমত:

খলীফাহ্ কাকে বলে? 

আগে কোনটি, খলীফাহ্ না খিলাফাহ্? 

কখন খলীফাহ্ বিষয়টি প্রাসঙ্গিক অর্থাৎ 

কখন খলীফাহ্ নির্ধারণ করতে হবে? 

খলীফাহ্ শব্দের বিভিন্ন অর্থ ও প্রয়োগ ইতোপূর্বে আমরা উল্লেখ করেছি। তন্মধ্যে  আমাদের আলোচ্য খলীফাহ্ হলেন - -(বৈশ্বিক) খিলাফাহর পরিচালক, 

-(পৃথিবীর) উম্মাহর/মুসলিমদের প্রতিনিধি বা শাসক,আমীরুল মু'মিনীন...।

এ থেকেও স্পষ্ট যে, আগে খিলাফাহ্; তারপর খলীফাহ্ অর্থাৎ উক্ত খিলাফাহর পরিচালক।  

সুতরাং,আগে খিলাফাহ্ অর্জন করতে হবে। তারপর কে খলীফাহ্ হবেন তা নিয়ে আলোচনা হবে, ইনশাআল্লাহ। 

এ বিষয়ে বিবেচ্য বিষয় সমূহ হলো:

প্রথমত: 

স্বাভাবিকভাবে যার নেতৃত্বে খিলাফাহ্ অর্জিত  হবে অর্থাৎ যখন খিলাফাহ্ প্রতিষ্ঠিত হবে তখন যিনি মুজাহিদীনের আমীর থাকবেন তিনিই স্বাভাবিক বা অনিবার্যভাবে উক্ত (খলীফাহর) দায়িত্ব পালনের জন্য অধিকতর যোগ্য। 

এরপরও যদি তিনি নতুন কাউকে খলীফাহ্ মনোনীত করতে চান নিয়ম অনুযায়ী করতে পারেন।... তখন কিংবা তার মৃত্যুর পরই কেবল নতুন খলীফাহ্ মনোনীত করার প্রসঙ্গ আসবে। 

যেমন: রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জীবনের শেষদিকে যে খিলাফাহ্ অর্জিত হয়েছে তার পরিচালনা রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামই করেছেন। 

তারপর, এই উম্মাহর মাঝে খলীফাহ্ হিসেবে প্রথম মনোনীত হয়েছেন খোলাফায়ি রশিদীনের প্রথম খলীফাহ্ আবু বাকর (রাঃ)। 

দ্বিতীয়ত:

খলীফাহ্ মনোনীত হওয়ার জন্য (ব্যক্তির) যোগ্যতা কী? 

খলীফাহ্ মনোনীত করার জন্য শারীআহতে নির্ধারিত যোগ্যতা/অযোগ্যতা বিবেচনা করা অতি জরুরি। যোগ্যতা/অযোগ্যতার ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো বিবেচনা করতে হবে:

এক.মুকাল্লাফ বা শারঈ বিধান পালনে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তির জন্য নির্ধারিত সকল যোগ্যতা বা গুণাবলী আছে এমন ব্যক্তিকে এ জন্য বাছাই করতে হবে। যেমন: (খলীফাহ্ হওয়ার জন্য) তাকে অবশ্যই মুসলিম, পুরুষ, বালিগ বা প্রাপ্তবয়স্ক, বিবেকবান, স্বাধীন...ইত্যাদি যোগ্যতা বা বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন হতে হবে।

উল্লেখ্য, কোন কোন আমলের ক্ষেত্রে মুকাল্লাফ বা শারঈ বিধান পালনে দায়িত্বপ্রাপ্ত হওয়ার জন্য যোগ্যতা বা গুণাবলীর কমবেশি আছে। যেমন: দিনে পাঁচবার সলাত পুরুষ ও নারী সবার জন্য প্রযোজ্য। তেমনি দিনে পাঁচবার সালাতের জন্য স্বাধীন হওয়ারও প্রয়োজন নেই, বরং দাস-দাসী মুসলিম হলেই তাদের উপর সলাতের হুকুম প্রযোজ্য হবে...ইত্যাদি। 

           

দুই.খলীফাহ্ হিসেবে কিংবা মুসলিমদের দায়িত্ব পালনে অন্যান্য বিশেষ যোগ্যতাও থাকতে হবে। যেমন, আদিল বা ন্যায়নিষ্ঠ, আলিম/মুজতাহিদ, সংশ্লিষ্ট দায়িত্ব তথা রাষ্ট্র ও যুদ্ধ পরিচালনা করতে সক্ষম বা দক্ষ, 

দীনে অগ্রগামী এবং অভিজ্ঞ, কুরাইশী... ইত্যাদি। 

পূর্বোক্ত বৈশিষ্ট্য ও যোগ্যতায় অনেকে সমান হলে (উক্ত সকল যোগ্যতাসহ) কুরাইশী ব্যক্তিকে অগ্রাধিকার দেয়া হবে। 

কিন্তু পূর্বোক্ত সৎ গুণাবলী না থাকলে সে কুরাইশী বা অন্য কিছু হলেও অগ্রাধিকার দেয়া হবে না, এমনকি তাকে খলীফাহ্ মনোনীত করার জন্য বিবেচনাও করা হবে না, ইনশাআল্লাহ ।

কেননা, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআলা নিকট তাকওয়াই প্রকৃত বিবেচ্য বিষয়। যেমন তিনি বলেন:

یٰۤاَیُّهَا النَّاسُ اِنَّا خَلَقۡنٰکُمۡ مِّنۡ ذَکَرٍ وَّ اُنۡثٰی وَ جَعَلۡنٰکُمۡ شُعُوۡبًا وَّ قَبَآئِلَ لِتَعَارَفُوۡا ؕ اِنَّ اَکۡرَمَکُمۡ عِنۡدَ اللّٰهِ اَتۡقٰکُمۡ ؕ اِنَّ اللّٰهَ عَلِیۡمٌ خَبِیۡرٌ ٠

হে মানুষ, আমি তোমাদেরকে এক পুরুষ ও  নারী ও থেকে সৃষ্টি করেছি আর তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা পরস্পর পরিচিত হতে পার। তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সেই অধিক মর্যাদাসম্পন্ন যে তোমাদের মধ্যে অধিক তাকওয়াবান । নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সম্যক অবহিত।

[সূরাহ আল হুজুরাত : ১৩]

উল্লেখ্য, অনেক হাদীসে স্পষ্ট বলা হয়েছে যে, খলীফাহ্ কুরাইশদের মধ্য থেকে মনোনীত হবে। যেমন: রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহুআলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :

إِنَّ هَذَا الأَمْرَ فِيْ قُرَيْشٍ لَا يُعَادِيْهِمْ أَحَدٌ إِلَّا كَبَّهُ اللهُ عَلَى وَجْهِهِ مَا أَقَامُوْا الدِّينَ٠

খিলাফত ও শাসন ক্ষমতা কুরাইশদের হাতেই থাকবে তত দিন পর্যন্ত, যতদিন তারা দীন কায়েমে নিয়োজিত থাকবে। এ বিষয়ে যে-ই তাদের সাথে শত্রুতা করবে আল্লাহ্ তাকে অধঃমুখে নিক্ষেপ করবেন। 

[সহীহ্ আল বুখারী:কিতাবুল মানাকিব, কিতাবুল আহকাম]

হাদীসে আরো বর্ণিত আছে :

عَنْ جَابِرِ، بْنِ سَمُرَةَ قَالَ قَالَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم  لاَ يَزَالُ هَذَا الأَمْرُ عَزِيزًا إِلَى اثْنَىْ عَشَرَ خَلِيفَةً  قَالَ ثُمَّ تَكَلَّمَ بِشَىْءٍ لَمْ أَفْهَمْهُ فَقُلْتُ لأَبِي مَا قَالَ فَقَالَ  كُلُّهُمْ مِنْ قُرَيْشٍ ٠

জাবির ইবনু সামুরাহ (রাযিঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, শাসন কর্তৃত্ব অতি শক্তিশালী থাকবে বারজন খলীফা পর্যন্ত। রাবী বলেন, তারপর তিনি কিছু বললেন, যা আমি বুঝতে পারিনি। তাই আমি আমার পিতাকে জিজ্ঞেস করলাম, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কী বললেন? তিনি বললেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: তাদের সকলেই হবে কুরায়শ বংশের।

[সহীহ্ মুসলিম : কিতাবুল ইমারাহ্;

আর হাদীসটি সহীহ আল বুখারীতেও (কিছুটা শাব্দিক পার্থক্যসহ) বর্ণিত আছে]

এরূপ আরো অনেক হাদীসে কুরাইশ সম্পর্কে বহু প্রশংসামূলক বর্ণনা আছে, এটা স্মরণ রাখতে হবে। তেমনি যেসব হাদীসে অনেক কুরাইশী সম্পর্কে নিন্দা বা সতর্কবাণী বর্ণিত আছে তা-ও স্মরণ রেখে যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে। এর কোনটাকেই উপেক্ষা করার সুযোগ নেই, কোনটাকে অবমূল্যায়নেরও সুযোগ নেই। যেমন সহীহ্ আল বুখারীতে বর্ণিত আছে :

بَاب قَوْلِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ هَلاَكُ أُمَّتِي عَلَى يَدَيْ أُغَيْلِمَةٍ سُفَهَاءَ

مُوسَى بْنُ إِسْمَاعِيلَ حَدَّثَنَا عَمْرُو بْنُ يَحْيَى بْنِ سَعِيدِ بْنِ عَمْرِو بْنِ سَعِيدٍ قَالَ أَخْبَرَنِي جَدِّي قَالَ كُنْتُ جَالِسًا مَعَ أَبِي هُرَيْرَةَ فِي مَسْجِدِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم بِالْمَدِينَةِ وَمَعَنَا مَرْوَانُ قَالَ أَبُو هُرَيْرَةَ سَمِعْتُ الصَّادِقَ الْمَصْدُوقَ يَقُولُ هَلَكَةُ أُمَّتِي عَلَى يَدَيْ غِلْمَةٍ مِنْ قُرَيْشٍ فَقَالَ مَرْوَانُ لَعْنَةُ اللهِ عَلَيْهِمْ غِلْمَةً فَقَالَ أَبُو هُرَيْرَةَ لَوْ شِئْتُ أَنْ أَقُولَ بَنِي فُلاَنٍ وَبَنِي فُلاَنٍ لَفَعَلْتُ ٠٠٠

পরিচ্ছেদ: নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর বাণী: কতগুলো বুদ্ধিহীন বালকের হাতে আমার উম্মাত ধ্বংস হবে।

আমর ইবনু ইয়াহ্ইয়া ইবনু সা’ঈদ ইবনু আমর ইবনু সাঈদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমার দাদা আমাকে জানিয়েছেন যে, আমি আবূ হুরাইরাহ (রাঃ)-এর সঙ্গে মাদীনাহ্য় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মসজিদে উপবিষ্ট ছিলাম। আমাদের সঙ্গে মারওয়ানও ছিল। এ সময় আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) বললেন, আমি ’আস্-সাদিকুল মাসদুক’ (সত্যবাদী ও সত্যবাদী হিসাবে স্বীকৃত)-কে বলতে শুনেছি আমার উম্মাতের ধ্বংস কুরাইশের কতক বালকের হাতে হবে। তখন মারওয়ান বলল, এ সব বালকের প্রতি আল্লাহর লানত বর্ষিত হোক। আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) বললেন, আমি যদি বলার ইচ্ছা করি যে তারা অমুক অমুক গোত্রের লোক তাহলে বলতে সক্ষম। 

[সহীহ্ আল বুখারী: কিতাবুল ফিতান, কিতাবুল মানাকিব]

সহীহ্ আল বুখারীতে আরো বর্ণিত আছে :

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ ـ رضى الله عنه ـ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم  يُهْلِكُ النَّاسَ هَذَا الْحَىُّ مِنْ قُرَيْشٍ قَالُوا فَمَا تَأْمُرُنَا قَالَ لَوْ أَنَّ النَّاسَ اعْتَزَلُوهُمْ ٠ 

আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কুরাইশ গোত্রের এ লোকগুলো (যুবকরা) জনগণকে ধ্বংস করে দিবে। সাহাবা কেরাম আরয করলেন, তখন আমাদেরকে আপনি কি করতে বলেন? তিনি বললেন, জনগণ যদি এদেরকে ত্যাগ করতো তবে ভালই হতো।

[সহীহ্ আল বুখারী: কিতাবু আহাদীসিল আম্বিয়া]

এ হাদীসটি সহীহ মুসলিমেও (নিম্নোক্ত শব্দে) বর্ণিত আছে : 

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ يُهْلِكُ أُمَّتِي هَذَا الْحَىُّ مِنْ قُرَيْشٍ قَالُوا فَمَا تَأْمُرُنَا قَالَ لَوْ أَنَّ النَّاسَ اعْتَزَلُوهُمْ ٠

আবু হুরাইরাহ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: কুরায়শের এ সম্প্রদায়টি আমার উম্মাতকে ধ্বংস করবে। এ কথা শুনে সাহাবাগণ (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, আপনি আমাদেরকে কি আদেশ করেন? উত্তরে তিনি বললেন, লোকেরা যদি তাদের থেকে পৃথক হয়ে যেত!

[সহীহ্ মুসলিম : কিতাবুল ফিতান ওয়া আশরতুস সাআহ্]

এরূপ আরো অনেক হাদীস বিভিন্ন কিতাবে বিভিন্ন ভাষায় বর্ণিত আছে। 

কুরাইশী ছাড়া অন্য কেউ খলীফাহ্ মনোনীত হতে পারেন কি না?

এ সংশ্লিষ্ট অন্য সকল হাদীস এবং উম্মাহর ইতিহাস থেকে এ প্রশ্নের উত্তর এবং এ বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। যেমন :

১. রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

إِنَّ هَذَا الأَمْرَ فِيْ قُرَيْشٍ لَا يُعَادِيْهِمْ أَحَدٌ إِلَّا كَبَّهُ اللهُ عَلَى وَجْهِهِ مَا أَقَامُوْا الدِّينَ٠

খিলাফত ও শাসন ক্ষমতা কুরাইশদের হাতেই থাকবে তত দিন পর্যন্ত, যতদিন তারা দীন কায়েমে নিয়োজিত থাকবে। এ বিষয়ে যে-ই তাদের সাথে শত্রুতা করবে আল্লাহ্ তাকে অধঃমুখে নিক্ষেপ করবেন। 

[সহীহ্ আল বুখারী:কিতাবুল মানাকিব, কিতাবুল আহকাম]

এ হাদীস থেকেই ব্যতিক্রম সম্ভাবনার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। কেননা, যদি কোন যুগে কোন কুরাইশী দীন কায়িমে সঠিক ভূমিকা রাখতে না পারে তখন অন্যরা করবে, এটাই স্বাভাবিক এবং ঐতিহাসিক ও বর্তমান বাস্তবতা। 

২. ইমাম বুখারী (রহঃ) বর্ণনা করেছেন :

بَاب السَّمْعِ وَالطَّاعَةِ لِلْإِمَامِ مَا لَمْ تَكُنْ مَعْصِيَةً

مُسَدَّدٌ حَدَّثَنَا يَحْيَى بْنُ سَعِيدٍ عَنْ شُعْبَةَ عَنْ أَبِي التَّيَّاحِ عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم اسْمَعُوا وَأَطِيعُوا وَإِنْ اسْتُعْمِلَ عَلَيْكُمْ عَبْدٌ حَبَشِيٌّ كَأَنَّ رَأْسَهُ زَبِيبَةٌ ٠

পরিচ্ছেদ: ইমামের কথা শ্রবণ ও আনুগত্য যতক্ষণ তা নাফরমানীর কাজ না হয়।

আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যদি তোমাদের উপর এমন কোন হাবশী দাসকেও শাসক নিযুক্ত করা হয়, যার মাথাটি কিশমিশের মত তবুও তার কথা শোন ও তার আনুগত্য কর।

[সহীহ্ আল বুখারী : কিতাবুল আহ্কাম]

এ হাদীসেও কুরাইশী ছাড়াও অন্য ইমামের ইঙ্গিত রয়েছে। 

৩. উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে :

لَمَّا بَلَغَ عُمَرُ بْنُ الْخَطَّابِ سَرْغَ حُدِّثَ أَنَّ بِالشَّامِ وَبَاءً شَدِيدًا، قَالَ: بَلَغَنِي أَنَّ شِدَّةَ الْوَبَاءِ فِي الشَّامِ، فَقُلْتُ: إِنْ أَدْرَكَنِي أَجَلِي، وَأَبُو عُبَيْدَةَ بْنُ الْجَرَّاحِ حَيٌّ، اسْتَخْلَفْتُهُ، فَإِنْ سَأَلَنِي اللهُ: لِمَ اسْتَخْلَفْتَهُ عَلَى أُمَّةِ مُحَمَّدٍ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ؟ قُلْتُ: إِنِّي سَمِعْتُ رَسُولَكَ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: " إِنَّ لِكُلِّ نَبِيٍّ أَمِينًا، وَأَمِينِي أَبُو عُبَيْدَةَ بْنُ الْجَرَّاحِ " فَأَنْكَرَ الْقَوْمُ ذَلِكَ، وَقَالُوا: مَا بَالُ عُلْيَى قُرَيْشٍ؟! يَعْنُونَ بَنِي فِهْرٍ - ثُمَّ قَالَ: فَإِنْ أَدْرَكَنِي أَجَلِي، وَقَدْ تُوُفِّيَ أَبُو عُبَيْدَةَ، اسْتَخْلَفْتُ مُعَاذَ بْنَ جَبَلٍ، فَإِنْ سَأَلَنِي رَبِّي عَزَّ وَجَلَّ: لِمَ اسْتَخْلَفْتَهُ؟ قُلْتُ: سَمِعْتُ رَسُولَكَ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: " إِنَّهُ يُحْشَرُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ بَيْنَ يَدَيِ الْعُلَمَاءِ نَبْذَةً٠

উমার (রাঃ) যখন সারগ (নামক একটা এলাকায়) পৌছলেন, তখন তাকে জানানো হলো যে, সিরিয়ায় মহামারী দেখা দিয়েছে। উমার (রাঃ) বললেন, আমি জানতে পেরেছি যে, সিরিয়ায় ভয়াবহ মহামারীর প্রাদুর্ভাব হয়েছে। আমি যদি মারা যাই এবং তখন আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ বেঁচে থাকেন, তবে আমি তাঁকে আমার পরবর্তী খালীফা মনোনীত করবো। এরপর আল্লাহ যদি আমাকে জিজ্ঞেস করেন, তাকে কেন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উম্মাতের জন্য খালীফা মনোনীত করলে? আমি বলবো, আমি আপনার রাসূলকে বলতে শুনেছি যে, প্রত্যেক উম্মাতের একজন পরম বিশ্বস্ত ব্যক্তি থাকে, আর আমার উম্মাতের পরম বিশ্বস্ত ব্যক্তি হলো আবু উবাইদা।

কিন্তু জনগণ তার এ প্রস্তাব অগ্রাহ্য করলো এবং বললো, উর্ধ্বতন কুরাইশ ব্যক্তিবর্গের কী হয়েছে। তারা বনু ফিহরের ব্যক্তিবর্গের দিকে ইঙ্গিত করছিল। (অর্থাৎ তারা কী দোষ করেছে যে, তাদেরকে বাদ দিয়ে আবু উবাইদাকে মনোনীত করা হবে?) এরপর উমার (রাঃ) পুনরায় বললেন: যদি আমার মৃত্যু আসে এবং তখন আবু উবাইদা মারা গিয়ে থাকে, তাহলে আমি মুয়ায বিন জাবালকে খালীফা মনোনীত করবো। এরপর যদি আল্লাহ আমাকে জিজ্ঞেস করেন, তাকে কেন খলীফাহ মনোনীত করলে? আমি বলবো, আমি আপনার রাসূলকে বলতে শুনেছি যে, কিয়ামতের দিন আলিমদের সম্মুখে কতিপয় বাছাইকৃত ব্যক্তিকে জমায়েত করা হবে। (অর্থাৎ আমার বিবেচনায় সেই সব বাছাইকৃত ব্যক্তিবর্গেরই অন্যতম মুয়ায বিন জাবাল)

(হাদিসটির বিভিন্ন সনদ বিচারে এটি হাসান পর্যায়ের হাদীস) 

[মুসনাদে আহমাদ : মুসনাদে উমার ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) (উমার রা. বর্ণিত হাদীস), এছাড়াও হাদীসটি আরো অনেক কিতাবে বর্ণিত আছে।]

এরূপ কিছু হাদীস থেকেও প্রমাণিত হয় যে, কুরাইশীর বাইরেও যোগ্য কেউ খলীফাহ হতে পারেন। অন্যথায় উমার (রাঃ) এরূপ ইচ্ছে প্রকাশ করতেন না।  

৪. অনেক হাদীসে এ উম্মাহর যে খলীফাহদের কথা বলা হয়েছে তাতে কুরাইশীদের কথা বলা হয়েছে ; আবার অনেক হাদীসে এ উম্মাহর খলীফাহদের কথা বলা হলেও তাতে কুরাইশীদের উল্লেখ করা হয় নি বা একে কুরাইশের মধ্যে সীমাবদ্ধ করা হয় নি। 

যেমন : সহীহ্ আল বুখারীতে বর্ণিত আছে:

بَابُ مَا ذُكِرَ عَنْ بَنِيْ إِسْرَائِيْلَ

حَدَّثَنِيْ مُحَمَّدُ بْنُ بَشَّارٍ حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ جَعْفَرٍ حَدَّثَنَا شُعْبَةُ عَنْ فُرَاتٍ الْقَزَّازِ قَالَ سَمِعْتُ أَبَا حَازِمٍ قَالَ قَاعَدْتُ أَبَا هُرَيْرَةَ خَمْسَ سِنِيْنَ فَسَمِعْتُهُ يُحَدِّثُ عَنْ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ كَانَتْ بَنُوْ إِسْرَائِيْلَ تَسُوْسُهُمْ الأَنْبِيَاءُ كُلَّمَا هَلَكَ نَبِيٌّ خَلَفَهُ نَبِيٌّ وَإِنَّهُ لَا نَبِيَّ بَعْدِيْ وَسَيَكُوْنُ خُلَفَاءُ فَيَكْثُرُوْنَ قَالُوْا فَمَا تَأْمُرُنَا قَالَ فُوْا بِبَيْعَةِ الأَوَّلِ فَالأَوَّلِ أَعْطُوْهُمْ حَقَّهُمْ فَإِنَّ اللهَ سَائِلُهُمْ عَمَّا اسْتَرْعَاهُمْ ٠

পরিচ্ছেদ: বনী ইসরাঈল সম্পর্কে যা বর্ণিত হয়েছে।

আবূ হাযিম (রহ.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন: আমি পাঁচ বছর যাবৎ আবূ হুরাইরাহ্ (রাঃ)-এর সাহচর্যে ছিলাম। তখন আমি তাঁকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে হাদীস বর্ণনা করতে শুনেছি যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, বনী ইসরাঈলের নবীগণ তাঁদের উম্মাতকে শাসন করতেন। যখন কোন একজন নবী মারা যেতেন, তখন অন্য একজন নবী তাঁর স্থলাভিষিক্ত হতেন। আর আমার পরে কোন নবী নেই। তবে অনেক খলীফাহ্ হবে। সহাবীগণ আরয করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি আমাদেরকে কী  নির্দেশ করছেন? তিনি বললেন, তোমরা একের পর এক করে তাদের প্রথম জনের বাইআত পূর্ণ করবে। তোমাদের উপর তাদের যে হক রয়েছে তা আদায় করবে। আর নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তাঁদেরকে জিজ্ঞেস করবেন ঐ সকল বিষয়ে যে দায়িত্ব তাদের উপর অর্পণ করা হয়েছিল।

[সহীহ্ আল বুখারী : কিতাবু আহাদীসিল আম্বিয়া; এছাড়াও হাদীসটি (কিছুটা শাব্দিক পার্থক্যসহ) সহীহ্ মুসলিম ও অন্য কিতাবে বর্ণিত আছে]

এ হাদীসে অনেক/অসংখ্য খলীফাহর কথা বলা হয়েছে, তারা সবাই কুরাইশী হবে এরূপ নির্দিষ্ট বা সীমাবদ্ধ করা হয় নি।

[এছাড়াও সহীহ্ আল বুখারী ও অন্যান্য কিতাবে এ সম্পর্কিত আরো হাদীস বর্ণিত আছে, যাতে প্রমাণিত হয় কুরাইশীর বাইরেও বিভিন্ন সময় খলীফাহ্ হতে পারে, তা খলীফাহ্/আমীর/ইমাম/বাদশাহ ইত্যাদি যে নামেই হোক।] 

তবে, যে হাদীসে ১২ জন বিশিষ্ট খলীফাহর কথা বলা হয়েছে সেখানে তাঁদের সকলেই কুরাইশী হবেন, এটা নির্দিষ্ট ও সীমাবদ্ধ করা হয়েছে। এ ১২ জন হলেন বিশেষ খলীফাহ্, যাদের কেউ কুরাইশের বাইরে হবে না। 

অবশ্য এ ১২ জন বিশিষ্ট খলীফাহ্ ছাড়াও কুরাইশ থেকে আরো অনেক খলীফাহ্ হবেন/হয়েছেন ।  

যেহেতু রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সকল হাদীসই যথাযথ অনুসরণ করতে হবে এবং এর কোনটাকেই বাদ দেয়ার সুযোগ নেই, বিধায় সংশ্লিষ্ট সকল হাদীস এবং হাদীসের বর্ণনা সমন্বিতরূপেই মানতে ও প্রয়োগ করলে এটা স্পষ্ট হয় যে,

- ১২ জন বিশিষ্ট খলীফাহর সকলেই কুরাইশী হবেন, এর বাইরে হবে না। 

- এছাড়াও কুরাইশ থেকে বিভিন্ন সময় অনেক বা অধিকাংশ খলীফাহ হবেন। 

- আবার কখনো কুরাইশের বাইরে থেকেও যোগ্য কেউ খলীফাহ্ হতে পারেন (তা যে নামেই হোক), বিশেষতঃ যখন (হাদীসের বক্তব্য অনুযায়ী) কুরাইশ থেকে দীন কায়িমে নিয়োজিত বা যোগ্য কাউকে পাওয়া না যাবে। 

- তবে কুরাইশের মধ্যে অনেক খলীফাহ্ হলেও স্বয়ং রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরিবার থেকে (হাসান রাঃ-এর পর এবং শেষযুগে মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল্লাহ আল মাহদী রহঃ ব্যতীত) আর কারো খলীফাহ্ হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। (এ সম্পর্কিত দালীল সামনে আসছে, ইনশাআল্লাহ)।    

হাদীসে বর্ণিত এ সকল সংবাদ বাস্তব ইতিহাসের সাথেও পরিপূর্ণ সামঞ্জস্যপূর্ণ। যেমন, খোলাফায়ে রশিদীন এবং এর পর উমাইয়্যা খলীফাগণ সকলেই কুরাইশী। এরপর আব্বাসী খলীফাগণ কুরাইশী ছিলেন। তবে এ দীর্ঘ সময়ের মাঝে কেউ কেউ এবং পরবর্তী (বহুকালব্যাপী) উসমানী খলীফাগণ কুরাইশী ছিলেন না। সুতরাং রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রদত্ত সংবাদ (সকল হাদীস) এবং বাস্তব ইতিহাস পাশাপাশি রাখলে এটাই স্পষ্ট হয় যে, অনেক/অধিকাংশ খলীফাহ্ কুরাইশ থেকে হবেন আবার কুরাইশের বাইরেও খলীফাহ্ হতে পারেন। আর এটাও নিশ্চিত যে, রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রদত্ত কোন সংবাদ ভুলও হবে না এবং বাস্তবতার বিপরীতও হবে না। 

সুতরাং কোন একটি/দুটি হাদীস নয় বরং সকল শারঈ দালীল সমন্বিতভাবে অনুসরণ করতে হবে। সুতরাং পূর্বোক্ত (৪৯:১৩) আয়াত, হাদীস ও সংশ্লিষ্ট শারঈ নীতি অনুযায়ী খলীফাহ্ মনোনীত করার ক্ষেত্রে শুধু বংশ নয় বরং বংশধারা বিবেচনার আগে অবশ্যই তাকওয়া, দীনী যোগ্যতা-অভিজ্ঞতা, এবং দীনী কাজে অবদান ও দীনে অগ্রগামিতা ইত্যাদি (সামগ্রিক) বিষয় বিবেচনা করতে হবে। কেননা পূর্বোক্ত (একটি) হাদীসেই স্পষ্ট বলা হয়েছে - ততদিন পর্যন্ত খিলাফাহ্ ও শাসন ক্ষমতা কুরাইশদের হাতেই থাকবে , যতদিন তারা দীন কায়েমে নিয়োজিত থাকবে। সুতরাং কুরাইশগণ যদি দীনী দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেন তবে তাদেরকে সর্বোচ্চ মূল্যায়ন করা হবে, যেরূপ পূর্বে করা হয়েছে এবং পরবর্তী সময়ে (হাদীসে বর্ণিত) মাহদীকে সর্বোচ্চ মূল্যায়ন করা হবে । আর যদি (মাহদীর আগমনের পূর্বে) কুরাইশগণ তাদের দায়িত্ব যথাযথ পালন না করে তবে তারা সর্বোচ্চ মূল্যায়ন কিভাবে পাবেন? অবশ্য সকল যুগে কুরাইশদের মধ্যে দীনে অগ্রগামী না-ও পাওয়া যেতে পারে, যেমন এ শতাব্দীতে বা গত ৪০/৫০ বছর যাবৎ পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে বিশেষত (এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য জিহাদের বৈশ্বিক কেন্দ্র) আফগানিস্তানে জিহাদ চলছে এবং এখান থেকেই সারা পৃথিবীতে জিহাদের ধারা বিস্তৃত হয়েছে, আলহামদুলিল্লাহ। অর্থাৎ কোন যুগে কুরাইশরা বিশ্ব-জিহাদ পরিচালনা করতে না পারলে এজন্য তো দীনী আমল বন্ধ থাকবে না। বরং প্রত্যেক যুগে যারা দীনী আমলে অগ্রগামী তাদের সাথে আমল করতে হবে এবং তাদেরকে যথাযথ অনুসরণ করতে হবে। 

কেননা, রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :

لَا يَزَالُ مِنْ أُمَّتِيْ أُمَّةٌ قَائِمَةٌ بِأَمْرِ اللهِ لَا يَضُرُّهُمْ مَنْ خَذَلَهُمْ وَلَا مَنْ خَالَفَهُمْ حَتَّى يَأْتِيَهُمْ أَمْرُ اللهِ وَهُمْ عَلَى ذَلِكَ ٠

আমার উম্মাতের একটি দল সর্বদা আল্লাহর দ্বীনের উপর অটল থাকবে। তাদেরকে যারা অপমান করতে চাইবে অথবা তাদের বিরোধিতা করবে, তারা তাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না। এমনকি কিয়ামত আসা পর্যন্ত তাঁরা এই অবস্থার উপর থাকবে।

[সহীহ্ আল বুখারী: কিতাবুল মানাকিব]

সহীহ্ মুসলিমে হাদীসটির ভাষা এরূপ:

عَنْ ثَوْبَانَ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ‏"‏ لاَ تَزَالُ طَائِفَةٌ مِنْ أُمَّتِي ظَاهِرِينَ عَلَى الْحَقِّ لاَ يَضُرُّهُمْ مَنْ خَذَلَهُمْ حَتَّى يَأْتِيَ أَمْرُ اللَّهِ وَهُمْ كَذَلِكَ ‏"‏ ‏.‏ وَلَيْسَ فِي حَدِيثِ قُتَيْبَةَ ‏"‏ وَهُمْ كَذَلِكَ ‏"‏ ‏.‏

সাওবান (রাযিঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: আমার উম্মাতের একটি দল সর্বদাই হকের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে। তাদেরকে যারা পরিত্যাগ করবে তারা তাদের কোন ক্ষতি সাধন করতে পারবে না। এমনকি এভাবে আল্লাহর আদেশ অর্থাৎ, কিয়ামত এসে পড়বে আর তারা যেমন ছিল তেমনই থাকবে। কুতাইবাহ বর্ণিত হাদীসে "আর তারা তেমনি থাকবে" অংশটুকু নেই।

[সহীহ্ মুসলিম: কিতাবুল ইমারাহ্] 

এ বিষয়ে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো: শুধু কুরাইশী হলেই কেউ যে কোন উপায়ে খলীফাহ্ পদ দখল করলে বা খলীফাহ্ দাবি করলেই কিংবা কিছু লোক বা কোন গোষ্ঠী কাউকে খলীফাহ হিসেবে মেনে নিলে বা ঘোষণা করলেই কেউ (শারঈ/বৈধ) খলীফাহ্ হয়ে যায় না। বরং বৈধ খলীফাহ্ হওয়ার জন্য সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তিকেও উম্মাহর যথাযথ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক শারঈ নিয়ম অনুযায়ী মনোনীত হতে হবে। তবেই কেবল তিনি বৈধ খলীফাহ্ হিসেবে মনোনীত/গণ্য হবেন এবং উম্মাহর (তার শাসন-কর্তৃত্বের অন্তর্ভুক্ত বা অধীনস্থদের) উপর তার বাইয়াহ্ ও আনুগত্য ওয়াজিব হবে। 

আর যদি কেউ শারঈ নীতি ও প্রক্রিয়া বা সুন্নাহ্ অনুযায়ী মনোনীত না হয় তাহলে সে 'খলীফাহ্' নয়, অর্থাৎ 'বৈধ খলীফাহ্' নয়, বরং 'অবৈধ খলীফাহ্' হিসেবে গণ্য হবে। তার অনুসরণ করা যাবে না। যেমনটি উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদীসে এসেছে:

٠٠٠فَمَنْ بَايَعَ رَجُلاً عَلَى غَيْرِ مَشُورَةٍ مِنْ الْمُسْلِمِينَ فَلاَ يُتَابَعُ هُوَ وَلاَ الَّذِي بَايَعَهُ تَغِرَّةً أَنْ يُقْتَلاَ ٠

...অতএব যে ব্যক্তি মুসলিমদের মাশওয়ারাহ (তথা কার্যকর পরামর্শ ও ঐকমত্য) ছাড়া কোন ব্যক্তির হাতে বাইআত করবে তার অনুসরণ করা যাবে না আর ঐ লোকেরও না যে তার অনুসরণ করবে। কেননা, উভয়েরই নিহত হওয়ার আশংকা আছে।

[সহীহ্ আল বুখারী:কিতাবুল হুদূদ]

এরূপ ব্যক্তি (অবৈধ খলীফাহ্) কুরাইশী হোক বা অন্য কেউ হোক সকলের উপরই সংশ্লিষ্ট সকল শারঈ নীতি প্রযোজ্য হবে। আর কারো দ্বারা এরূপ অন্যায় সংঘটিত হলে শারঈ নিয়ম অনুযায়ী বৈধ খলীফাহ্ মনোনীত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন শারঈ দালীল সমন্বিত রূপে অনুসরণ পূর্বক স্থান-কাল-পাত্র ও অবস্থাভেদে এবং দীনী উপকার, অপকার, সম্ভাবনা ও আশংকা ইত্যাদি বিবেচনায় উক্ত অবৈধ খলীফাহকে অপসারণ করা কখনো কর্তব্য, কখনো উত্তম, কখনো বৈধ; আবার কখনো বাধ্য হয়ে তাকে খলীফাহ্ হিসেবে মেনে নেয়াও বৈধ। 

অনেক সাহাবী (ব্যাপক রক্তপাতের আশংকায় এবং উম্মাহর বৃহৎ স্বার্থে) পরবর্তী উমাইয়া খলীফাহদেরকে মেনে নিয়েছেন; আবার কোন কোন সাহাবী (যেমন  হুসাইন রা.) কোন উমাইয়া খলীফাহকে না মেনে বিদ্রোহও করেছেন। এরূপ ক্ষেত্রে উভয়টিই বৈধ।

[এ বিষয়ে আরো বিস্তারিত দ্রঃ

الجهاد والقتال في السياسة الشرعية

قتال مغتصب السلطة] 

আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে সঠিকভাবে দীনী আমল করার তাওফীক দান করুন। 

:আহলি বাইত থেকে কোন খলীফাহ্ হবে কি?

খুলাফাউ রশিদীন-এর পর কুরাইশ বংশ থেকে এ উম্মাহর মাঝে অনেক খলীফা ও বাদশাহ ইত্যাদি হবে মর্মে অনেক হাদীস এসেছে। কিন্তু [খুলাফাউ রশিদীনের অন্তর্ভুক্ত আলী (রাঃ), হাসান (রাঃ)-এর সামান্য সময় এবং শেষ যুগে মুহাম্মাদ ইবনু আবদুল্লাহ আল মাহদী ব্যতীত] রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পরিবার থেকে আর কেউ খলীফাহ্ বা বাদশাহ হবে না মর্মেও দালীল আছে। অনেক ইমাম এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন। যেমন, ইমাম ইবনু কাসীর (রহ) আল বিদায়াহ্ ওয়ান নিহায়াহ্ কিতাবে হুসাইন (রাঃ)-এর জীবনী বর্ণনা করতে গিয়ে এ সম্পর্কিত দালীলসমূহ উপস্থাপন করেছেন। তিনি উল্লেখ করেন:   

وَقَالَ غَيْرُ وَاحِدٍ عَنْ شَبَابَةَ بْنِ سَوَّار قَالَ: حَدَّثَنَا يَحْيَى بْنُ إِسْمَاعِيلَ بْنِ سَالِمٍ الْأَسَدِيُّ قَالَ سَمِعْتُ الشَّعْبِيَّ يُحَدِّثُ عَنِ ابْنِ عُمَرَ أَنَّهُ كَانَ بمكة فَبَلَغَهُ أَنَّ الْحُسَيْنَ بْنَ عَلِيٍّ قَدْ تَوَجَّهَ إِلَى الْعِرَاقِ فَلَحِقَهُ عَلَى مَسِيرَةِ ثَلَاثِ لَيَالٍ، فقال: أين تريد؟ قال: الْعِرَاقَ، وَإِذَا مَعَهُ طَوَامِيرُ وَكُتُبٌ، فَقَالَ: هَذِهِ كُتُبُهُمْ وَبَيْعَتُهُمْ، فَقَالَ: لَا تَأْتِهِمْ، فَأَبَى. فَقَالَ ابْنُ عُمَرَ: إِنِّي مُحَدِّثُكَ حَدِيثًا، إِنَّ جِبْرِيلَ أَتَى النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَخَيَّرَهُ بَيْنَ الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ فَاخْتَارَ الْآخِرَةَ وَلَمْ يُرِدِ الدنيا، وإنك بضعة من رسول الله، والله ما يَلِيهَا أَحَدٌ مِنْكُمْ أَبَدًا، وَمَا صَرَفَهَا اللَّهُ عَنْكُمْ إِلَّا لِلَّذِي هُوَ خَيْرٌ لَكُمْ، فَأَبَى أن يرجع. قال فاعتنقه ابن عمرو بكى وَقَالَ: أَسْتَوْدِعُكَ اللَّهَ مِنْ قَتِيلٍ. وَقَالَ يَحْيَى بْنُ مَعِينٍ: حَدَّثَنَا أَبُو عُبَيْدَةَ ثَنَا سُلَيْمُ بن حيان عن سعيد ابن مِينَا. قَالَ: سَمِعْتُ عَبْدَ اللَّهِ بْنَ عَمْرٍو يقول: عَجَّلَ حُسَيْنٌ قَدَرَهُ، وَاللَّهِ لَوْ أَدْرَكْتُهُ مَا تركته يخرج إلا أن يغلبني، ببني هاشم فتح هذا الأمر، وببني هاشم يختم، فَإِذَا رَأَيْتَ الْهَاشِمِيَّ قَدْ مَلَكَ فَقَدْ ذَهَبَ الزَّمَانُ. قُلْتُ: وَهَذَا مَعَ حَدِيثِ ابْنِ عُمَرَ يدل على أن الفاطميين أدعياء كذبة، لم يكونوا من سلالة فاطمة كما نص عليه غَيْرُ وَاحِدٍ مِنَ الْأَئِمَّةِ عَلَى مَا سَنَذْكُرُهُ فِي مَوْضِعِهِ إِنْ شَاءَ اللَّهُ ٠

........

البداية والنهاية

سَنَةُ سِتِّينَ مِنَ الْهِجْرَةِ النَّبَوِيَّةِ

صفة مخرج الحسين إلى العراق وَمَا جَرَى لَهُ بَعْدَ ذَلِكَ

........

একাধিক বর্ণনাকারী শাবাবাহ্ ইবন সাওয়ার থেকে বলেন, আমাদেরকে ইয়াহ্ইয়া ইবনু ইসমাঈল ইবনু সালীম আল আসাদী বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন: আমি শা'বী (রহ)-কে ইবনু উমার (রাঃ)-এর বরাত দিয়ে বর্ণনা করতে শুনেছি, তিনি মাক্কায় অবস্থানকালে জানতে পারলেন, হুসাইন ইবনু আলী (রাঃ) ইরাক অভিমুখে রওনা করেছেন। তখন তিনি তিনদিনের পথ অতিক্রম করে তাঁর সাথে মিলিত হলেন, অতঃপর তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, হুসাইন! তুমি কোথায় যাচ্ছ? তিনি বললেন, ইরাকে। আর এ সময়ে তিনি তাঁর কাছে রক্ষিত বেশকিছু চিঠিপত্র দেখিয়ে তাঁকে বললেন, এই দেখুন তাদের (কুফাবাসীদের) পত্র ও বাইআতনামা সমূহ। তিনি বললেন, তুমি তাদের কাছে যেও না। কিন্তু হুসাইন (রাঃ) অস্বীকার করলেন। তখন ইবনু উমার (রাঃ) বললেন: তাহলে শোন! আমি তোমাকে একটি হাদীস বর্ণনা করছি। একবার জিররীল (আঃ) নাবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আগমন করলেন এবং তাঁকে দুনিয়া ও আখিরতের যে কোন একটিকে বেছে নিতে বললেন, তখন তিনি আখিরতকে বেছে নিলেন। দুনিয়া চাইলেন না। আর তুমি রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অংশ। আল্লাহর কসম! তোমাদের কেউ কখনো এই কর্তৃত্ব লাভ করবে না। আল্লাহ তোমাদের থেকে তা ফিরিয়ে রেখেছেন এর চেয়ে উত্তম বিষয় তোমাদের জন্য সঞ্চিত ও সংরক্ষিত রাখার কারণে। কিন্তু হুসাইন (রাঃ) তার মত পরিবর্তন করতে অস্বীকার করলেন। রাবী বলেন, তখন ইবনু উমার (রাঃ) তাঁকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, শহীদ রূপে আমি তোমাকে আল্লাহর কাছে অর্পণ করছি। 

ইয়াহ্ইয়াহ্ ইবনু মাঈন বলেন, আমাদেরকে আবু উবাইদাহ্ বর্ণনা করেছেন সুআইদ ইবনু মীনা থেকে, তিনি বলেন, আমি আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ)-কে বলতে শুনেছি: হুসাইন (রাঃ) তার ভাগ্যবিধানকে ত্বরান্বিত করেছেন (অর্থাৎ ভাগ্য বাস্তবায়নে দ্রুত এগিয়ে গেলেন)। আল্লাহর শপথ! যদি আমি তাঁর নাগাল পেতাম তাহলে আমাকে পরাজিত না করা পর্যন্ত তাঁকে বের হতে দিতাম না। বানু হাশিম দ্বারা এই শাসন-কর্তৃত্বের সূচনা হয়েছে এবং বানু হাশিম দ্বারাই এর ইতি ঘটবে। সুতরাং যদি দেখ কোন হাশিমী (আহলে বাইতের কেউ) এ শাসন-কর্তৃত্বের অধিকারী হয়েছে, তাহলে বুঝবে সময় শেষ হয়ে গিয়েছে। 

আমি (ইবনু কাসীর) বলছি: এ হাদীসটি আব্দুল্লাহ ইবনু উমার (রাঃ)-এর হাদীসের সমর্থকরূপে একথা প্রমাণ করে যে, মিশরীয় ফাতিমীগণ মিথ্যা দাবিদার। কেননা তারা ফাতিমাহ্ (রাঃ)-এর বংশধর নয়। যেমনটি অনেক ইমাম ও ইতিহাসবিদ উল্লেখ করেছেন। ইনশাআল্লাহ যথাস্থানে তার বর্ণনা আসবে।

[আল বিদায়াহ্ ওয়ান নিহায়াহ্ : ৬০ হিজরীর আলোচনা : হুসাইন (রাঃ)-এর ইরাক গমনের প্রেক্ষাপট...] 

উল্লেখ্য, আব্বাসীরা বানু হাশিমের অংশ হলেও তারা আহলে বাইত নয়।                      

এছাড়াও ইমাম ইবনু কাসীর (রহঃ) তাঁর আল বিদায়াহ্ ওয়ান নিহায়াহ্ কিতাবের ৪০২ হিজরীর আলোচনাতেও উল্লেখ করেছেন। ইবনু কাসীর (রহঃ) বলেন: 

قُلْتُ: وَمِمَّا يَدُلُّ عَلَى أن هؤلاء أدعياء كذبة، كَمَا ذَكَرَ هَؤُلَاءِ السَّادَةُ الْعُلَمَاءُ وَالْأَئِمَّةُ الْفُضَلَاءُ، وأنهم لا نسب لهم إلى على بن أبى طالب، ولا إلى فاطمة كما يزعمون، قول ابن عمر للحسين بن على حين أراد الذهاب إلى العراق، وذلك حين كتب عوام أهل الكوفة بالبيعة إليه فَقَالَ لَهُ ابْنُ عُمَرَ:

لَا تَذْهَبُ إِلَيْهِمْ فَإِنِّي أَخَافُ عَلَيْكَ أَنْ تُقْتَلَ، وَإِنَّ جَدَّكَ قَدْ خُيِّرَ بَيْنَ الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ فَاخْتَارَ الْآخِرَةَ عَلَى الدُّنْيَا، وَأَنْتَ بُضْعَةٌ مِنْهُ، وَإِنَّهُ وَاللَّهِ لَا تَنَالُهَا لَا أَنْتَ وَلَا أَحَدٌ مِنْ خلفك ولا مِنْ أَهْلِ بَيْتِكَ٠

فَهَذَا الْكَلَامُ الْحَسَنُ الصَّحِيحُ الْمُتَوَجِّهُ الْمَعْقُولُ، مِنْ هَذَا الصَّحَابِيِّ الْجَلِيلِ، يَقْتَضِي أَنَّهُ لَا يَلِي الْخِلَافَةَ أَحَدٌ مِنْ أَهْلِ الْبَيْتِ إِلَّا مُحَمَّدَ بْنَ عَبْدِ اللَّهِ الْمَهْدِيَّ الّذي يكون في آخر الزمان عند نزول عيسى بن مريم، رغبة بهم عن الدنيا، وأن لا يدنسوا بها ٠     

আমি (ইবনু কাসীর) বলছি: মিসরের ঐ রাজন্যবর্গ যারা নিজেদের প্রকৃত বংশীয় সম্পর্ক গোপন রেখে ভিন্ন বংশের পরিচয় দেয়, তাদের এ পরিচয় যে মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর তা উপরে বর্ণিত সম্মানিত শীর্ষস্থানীয় আলিম ও ইমামগণের বক্তব্য থেকে যেমন জানা গেল যে, তাদের বংশের সম্পর্ক না আলী ইবনে আবী তালিব (রাঃ)-এর সাথে আছে, আর না ফাতিমা (রাঃ)-এর সাথে আছে। 

তেমনি এ বিষয়টি আব্দুল্লাহ ইবনু উমার (রাঃ)-এর বক্তব্য থেকেও বুঝা যায়। হুসাইন ইবনু আলী (রাঃ) যখন ইরাকে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন তখন ইবনু উমার (রাঃ) তাকে এ কথা বলেছিলেন। যখন কুফাবাসীরা রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দৌহিত্র হুসাইন (রাঃ) এর বাইয়াত গ্রহণ করার কথা জানিয়ে তাঁর কাছে পত্র প্রেরণ করেছিল এবং হুসাইন (রাঃ) তাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে কুফায় যেতে মনস্থ করেন, তখন আবদুল্লাহ ইবনু উমার (রাঃ) হুসাইন (রাঃ)-কে বলেছিলেন: 

তুমি তাদের কাছে যেও না; কেননা আমার আশংকা হয় যে, সেখানে গেলে তোমাকে হত্যা করা হবে। আর এ বিষয়টিও তোমার উপলব্ধি করা আবশ্যক যে, তোমার নানা রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আল্লাহর পক্ষ থেকে দুনিয়া ও আখিরতের যে কোনটি বেছে নেয়ার ইখতিয়ার দেয়া হয়েছিল। রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুনিয়ার উপর আখিরতকেই অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। তুমি তো তাঁরই আদরের নাতি। আল্লাহর কসম! এ কারণেই এ দুনিয়ার কর্তৃত্ব না তোমার হাতে আসবে, না তোমার সন্তানের হাতে, না তোমার পরিবার বা বংশের কারো হাতে আসবে। 

(ইমাম ইবনু কাসীর রহঃ বলেন:) শীর্ষ পর্যায়ের ও মর্যাদাবান এ সাহাবীর যুক্তিপূর্ণ, সঠিক ও মূল্যবান উক্তির দাবি এটাই যে, আহলে বাইতের কারো হাতেই খিলাফাহর দায়িত্ব আসবে না, আহলে বাইত থেকে  কেবল একজন মুহাম্মাদ ইবনু আবদুল্লাহ আল মাহদী খলীফাহ্ হবেন, তা-ও হবে শেষ যুগে কিয়ামাতের আগে, ঈসা ইবনু মারইয়াম (আঃ)-এর আসমান থেকে অবতরণের যুগে (যা অন্য সুনির্দিষ্ট দালীল দ্বারা প্রমাণিত)। আর, খিলাফাহ্কে আহলে বাইত থেকে দূরে রাখা হয়েছে তাদেরকে দুনিয়া থেকে আকর্ষণমুক্ত করার জন্য এবং এর মলিনতা থেকে আহলে বাইতকে পবিত্র রাখার জন্য...।

[আল বিদায়াহ্ ওয়ান নিহায়াহ্:৪০২ হিজরী (এর বিবরণ); এছাড়াও উল্লিখিত বক্তব্যের বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন হাদীস ও সীরাতের কিতাবেও বর্ণিত আছে।] 

উপরের আলোচনা এবং ঐতিহাসিক বাস্তবতা থেকে স্পষ্ট যে, খুলাফায়ে রশিদীনের অন্তর্ভুক্ত আলী (রাঃ) [এবং হাসান (রাঃ)-এর সামান্য সময় বাদে] রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পরিবার বা তাঁর আদরের নাতী হাসান ও হুসাইন (রাঃ) উভয়ের পরিবার বা বংশ থেকে আর কেউ খলীফাহ্ হন নি। 

ইতিহাস থেকে আরো জানা যায়, হুসাইন (রাঃ)-এর হৃদয় বিদারক ঘটনার পর থেকে উমাইয়া ও আব্বাসী যুগে এবং পরবর্তী যুগেও কখনো কখনো রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বংশের অন্তর্ভুক্ত কেউ কেউ খলীফাহ্ হওয়ার চেষ্টা বা খলীফাহ্ দাবি করেছেন, কিন্তু খলীফাহ্ হন নি। আবার, কোন কোন অঞ্চলের অনেক মানুষ অনেক সময় আহলে বাইতের কাউকে এরূপ বাইআহ্ দিয়ে তাকে সামনে এনেছে, আবার যখন রাষ্ট্রীয় বাহিনী বিদ্রোহ হিসেবে এটাকে দমন করতে এসেছে তখন তাদের অধিকাংশ তাকে ত্যাগ করে চলেও গিয়েছে! তখন আহলে বাইতের অনেককে বন্দি-নির্যাতন করা হয়েছে এবং অনেককে হত্যা করা হয়েছে! এরূপ হৃদয়বিদারক ঘটনা ইতিহাসে বহুবার সংঘটিত হয়েছে; তবে তাদের হাতে খিলাফাহ্ ও এর কর্তৃত্ব আসে নাই; যদিও তখন খিলাফাহ্ প্রতিষ্ঠিত ছিল। 

আর বর্তমানে তো খিলাফাহ্ই নেই বা এখনো খিলাফাহ্ প্রতিষ্ঠিতই হয় নি, বিধায় এখন কেউ খলীফাহ্ দাবি করলেও তা হবে আরো অগ্রহণযোগ্য। 

সুতরাং, বর্তমানে (তথা মুহাম্মাদ ইবনু আবদুল্লাহ আল মাহদীর আগে) যদি কেউ রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরিবার বা বংশের অন্তর্ভুক্ত হয়ে খলীফাহ্ দাবি করে তবে তা একেবারেই সঠিক নয় এবং তার পক্ষে দালীল নেই বরং দালীল এর বিপক্ষেই পাওয়া যায়। 

আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে দীনের সঠিক উপলব্ধি ও যথাযথ আমল করার তাওফীক দান করুন। 

তৃতীয়ত:

খলীফাহ্ মনোনীত হবে কোথায় এবং কে/কারা খলীফাহ্ নির্ধারণ করবেন? 

খলীফাহ্ মনোনীত হওয়ার প্রক্রিয়া অর্থাৎ কাউকে খলীফাহ্ হিসেবে নির্ধারণ করার যথাযথ উপায় ও প্রক্রিয়া কী?

খলীফাহ্ মনোনীত করার জন্য শারীআহতে নির্ধারিত যোগ্যতা/অযোগ্যতা বিবেচনা করা যেমন জরুরি, তেমনি জরুরি বিষয় হলো খলীফাহ্ মনোনীত করার যথাযথ উপায় ও প্রক্রিয়া অবলম্বন করা।

অর্থাৎ, শুধু এরূপ যোগ্যতা থাকলেই হবে না। বরং সংশ্লিষ্ট সকল যোগ্যতায় উত্তীর্ণ ব্যক্তিকে যথাযথ নিয়ম ও প্রক্রিয়া অবলম্বন করে মনোনীত করতে হবে। 

এর সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয় সমূহ:

এক. খলীফাহ্ মনোনীত হতে হবে খিলাফাহর কেন্দ্র থেকে, অর্থাৎ সংশ্লিষ্ট সময়ে খিলাফাহর কেন্দ্র থেকেই খলীফাহ্ মনোনীত করতে হবে। যেমন, রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মৃত্যুর পর মক্কা বা অন্য কোন স্থান থেকে কিছু লোক খলীফাহ্ মনোনীত/ঘোষণা করার দাবি করলেও তা হতো না। কারণ, মাদীনাহ্ ছিল উক্ত খিলাফাহর কেন্দ্র। এ কেন্দ্র থেকেই আবু বাকর (রাঃ)-কে খলীফাহ্ মনোনীত করা হয়েছে। এ পয়েন্টটি পরবর্তী পয়েন্ট দ্বারা আরো স্পষ্ট হয়।

দুই. কেন্দ্র থেকে যে কেউ খলীফাহ্ নির্ধারণ বা ঘোষণা করলেই হবে না বরং খিলাফাহ্ বা কেন্দ্রের কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ কর্তৃক খলীফাহ্ মনোনীত হতে হবে। আর এই কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষকে 'আহলুল হাল্লি ওয়াল আকদ' বলা হয়। আর তাদেরকে বা তাদের সিদ্ধান্তকে পুরো উম্মাহ্ মেনে চলে। কেননা, তারাই উম্মাহর প্রবীণ, অভিজ্ঞ ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ এবং উম্মাহর প্রকৃত প্রতিনিধি। 

যেমন: মাদীনাহ্য় আনসারগণ (রাঃ) ছিলেন, তবে তাঁরা কেন্দ্রে থাকলেও কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ ছিলেন না। বরং কেন্দ্রের সহযোগী ছিলেন। সুতরাং তাঁরা কাউকে খলীফাহ্ হিসেবে নির্ধারণ করলেও তা গৃহীত হতো না। কেননা, তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ এরূপ দাবি করেছিলেন তবে তা গৃহীত হয়নি।

বরং মুহাজিরগণই ছিলেন খিলাফাহর কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ। এ কারণে আনসারদের কেউ তাদের মধ্য থেকে খলীফাহ্ মনোনীত করার দাবি করলে তখন আবূ বকর (রাঃ) অত্যন্ত জোরালো ও যুক্তিপূর্ণ ভাষণ রাখলেন। তিনি তাঁর বক্তব্যে বললেন, আমীর আমাদের মধ্য হতে একজন হবেন এবং তোমাদের মধ্য হতে হবেন উযীর।

 ثُمَّ تَكَلَّمَ أَبُوْ بَكْرٍ فَتَكَلَّمَ أَبْلَغَ النَّاسِ فَقَالَ فِيْ كَلَامِهِ نَحْنُ الْأُمَرَاءُ وَأَنْتُمْ الْوُزَرَاءُ ٠٠٠ 

[এ বিষয়ক দীর্ঘ হাদীসটি সহীহ আল বুখারীতে সাহাবী (রাঃ) গণের মর্যাদা অধ্যায়ে বর্ণিত আছে]

তাই এ ব্যাপারে মূল ভূমিকা ও অধিকার ছিল কুরাঈশী মুহাজিরগণের। তবে আনসারগণ (রাঃ) যেহেতু কেন্দ্রের অন্যতম (প্রধান) অংশ তাই তাদের সাথে মাশওয়ারাহ করেই খলীফাহ্ মনোনীত করা হয়েছে। মুহাজিরগণ আনসারদের আয়োজিত মাশওয়ারায় গিয়ে এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন, যা সহীহ্ বুখারী ও অন্যান্য কিতাবে বর্ণিত হাদীস থেকে জানা যায়। 

আবু বাকর (রাঃ)-কে খলীফাহ্ মনোনীত করার ক্ষেত্রে এ নীতির যথাযথ প্রয়োগ দেখা যায়। তাঁর ব্যাপারে রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহুআলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পক্ষ থেকে ইঙ্গিত ছিল, তবে শুধু ঐ ইঙ্গিত তাঁর খলীফাহ্ হওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল না, বরং আল্লাহ তায়ালার বাণী এবং রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশনা অনুযায়ী উম্মাহর মাশওয়ারাহ এজন্য জরুরি ছিল। তাই ঐ ইঙ্গিতের সাথে সাথে মুহাজির ও আনসারগণ মাশওয়ারাহ (কার্যকর আলোচনা-পরামর্শ) করেন এবং একমত হয়ে আবু বাকর (রাঃ)-কে খলীফাহ্ মনোনীত করেছেন।

তেমনি দেখা যায় পরবর্তী খলীফাহ্ মনোনীত করার ক্ষেত্রেও। উমার (রাঃ)-কে খলীফাহ্ মনোনীত করতে আবু বাকর (রাঃ) অন্যান্য প্রবীণ সাহাবীগণ (রাঃ)-এর সাথে মাশওয়ারাহ (কার্যকর আলোচনা-পরামর্শ) করেন এবং তাঁকে খলীফাহ্ মনোনীত করার বিষয়ে একমত হন। 

তারপর উমার (রাঃ) পরবর্তী খলীফাহ্ মনোনীত করার লক্ষ্যে ছয় জন বিশিষ্ট সাহাবী (রাঃ)-কে মনোনীত করেছেন, যারা দীর্ঘ মাশওয়ারাহ (কার্যকর আলোচনা-পরামর্শ) করেন এবং একমত হয়ে উসমান (রাঃ)-কে খলীফাহ্ মনোনীত করেন।

তিন. মুসলিমদের সাথে তথা মুসলিমদের পক্ষ থেকে আহলুল হাল্লি ওয়াল আকদ-এর কার্যকর মাশওয়ারা হতে হবে এবং (খলীফাহ্ হিসেবে) একজনের বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হতে হবে।

এ বিষয়ে সহীহ্ আল বুখারীতে উমার (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত দীর্ঘ হাদীসটিতে এসেছে:

٠٠٠فَمَنْ بَايَعَ رَجُلاً عَلَى غَيْرِ مَشُورَةٍ مِنْ الْمُسْلِمِينَ فَلاَ يُتَابَعُ هُوَ وَلاَ الَّذِي بَايَعَهُ تَغِرَّةً أَنْ يُقْتَلاَ ٠

...অতএব যে ব্যক্তি মুসলিমদের মাশওয়ারাহ (তথা কার্যকর পরামর্শ ও ঐকমত্য) ছাড়া কোন ব্যক্তির হাতে বাইআত করবে তার অনুসরণ করা যাবে না আর ঐ লোকেরও না যে তার অনুসরণ করবে। কেননা, উভয়েরই নিহত হওয়ার আশংকা আছে।

[সহীহ্ আল বুখারী:কিতাবুল হুদূদ]

মাশওয়ারাহ বা শূরা প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তিকে খলীফাহ্ মনোনীত করার লক্ষ্যে একমত হওয়ার জন্য উপযোগী আলোচনা ও মতামত পেশ করা উচিত, যেমনটি সাহাবীগণ (রাঃ) করেছেন আবু বাকর (রাঃ)-এর ক্ষেত্রে। যেমন (মুসনাদে আহমাদের) হাদীসে বর্ণিত আছে : 

عَنْ عَبْدِ اللهِ، قَالَ: لَمَّا قُبِضَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَتِ الْأَنْصَارُ: مِنَّا أَمِيرٌ، وَمِنْكُمْ أَمِيرٌ. فَأَتَاهُمْ عُمَرُ، فَقَالَ: يَا مَعْشَرَ الْأَنْصَارِ، أَلَسْتُمْ تَعْلَمُونَ أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَدْ أَمَرَ أَبَا بَكْرٍ أَنْ يَؤُمَّ النَّاسَ؟ فَأَيُّكُمْ تَطِيبُ نَفْسُهُ أَنْ يَتَقَدَّمَ أَبَا بَكْرٍ؟ فَقَالَتِ الْأَنْصَارُ: نَعُوذُ بِاللهِ أَنْ نَتَقَدَّمَ أَبَا بَكْرٍ ٠

إسناده حسن ٠

আবদুল্লাহ (রাঃ) বলেন, যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইন্তিকাল করলেন, আনসারগণ বললেন, আমাদের মধ্য হতে একজন আমীর আর তোমাদের (মুহাজিরদের) মধ্য হতে একজন আমীর হোক। এই সময় তাদের কাছে উমার (রাঃ) এলেন। তিনি বললেন, হে আনসারগণ, তোমরা কি জাননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু বাকরকে নামাজে ইমামতি করতে আদেশ দিয়েছিলেন? তাহলে তোমাদের মধ্যে এমন কে আছে, যে আবু বাকরের আগে যেতে রাজি? (অর্থাৎ আবু বাকর থাকতে ইমাম হতে রাজি) আনসারগণ বললো, আবু বাকরের আগে যাওয়া থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাই।

[হাদীসটির সনদ হাসান। 

দ্রঃ মুসনাদে আহমাদ:مسند عمر ابن الخطاب] 

এ হাদীসে উপস্থাপন করা হয়েছে আবু বাকর (রাঃ) ছিলেন সাহাবীগণের মধ্যে সর্বাধিক যোগ্য। 

আর, উমার (রাঃ) থেকে সহীহ্ আল বুখারীর দীর্ঘ হাদীসটিতে সংশ্লিষ্ট অনেক বিষয় বর্ণিত আছে। উক্ত হাদীসটির কিছু কিছু অংশ উল্লেখ করছি:

ثُمَّ إِنَّهُ بَلَغَنِي أَنَّ قَائِلاً مِنْكُمْ يَقُولُ وَاللهِ لَوْ قَدْ مَاتَ عُمَرُ بَايَعْتُ فُلاَنًا فَلاَ يَغْتَرَّنَّ امْرُؤٌ أَنْ يَقُولَ إِنَّمَا كَانَتْ بَيْعَةُ أَبِي بَكْرٍ فَلْتَةً وَتَمَّتْ أَلاَ وَإِنَّهَا قَدْ كَانَتْ كَذَلِكَ وَلَكِنَّ اللهَ وَقَى شَرَّهَا وَلَيْسَ مِنْكُمْ مَنْ تُقْطَعُ الأَعْنَاقُ إِلَيْهِ مِثْلُ أَبِي بَكْرٍ مَنْ بَايَعَ رَجُلاً عَنْ غَيْرِ مَشُورَةٍ مِنْ الْمُسْلِمِينَ فَلاَ يُبَايَعُ هُوَ وَلاَ الَّذِي بَايَعَهُ تَغِرَّةً أَنْ يُقْتَلاَ وَإِنَّهُ قَدْ كَانَ مِنْ خَبَرِنَا حِينَ تَوَفَّى اللهُ نَبِيَّهُ صلى الله عليه وسلم٠٠٠

অতঃপর আমার কাছে এ কথা পৌঁছেছে যে, তোমাদের কেউ এ কথা বলছে যে, আল্লাহর কসম! যদি উমার মারা যায় তাহলে আমি অমুকের হাতে বাইআত করব। কেউ যেন এ কথা বলে ধোঁকায় না পড়ে যে আবূ বকর-এর বাইআত ছিল আকস্মিক ঘটনা। ফলে তা সংঘটিত হয়ে যায়।

জেনে রেখো! তা অবশ্যই এমন ছিল। তবে আল্লাহ আকস্মিক বাইআতের ক্ষতি প্রতিহত করেছেন। সফর করে সওয়ারীগুলোর ঘাড় ভেঙ্গে যায় - এমন স্থান পর্যন্ত মানুষের মাঝে আবূ বকরের মত (শ্রেষ্ঠ) কে আছে? যে কেউ মুসলিমদের পরামর্শ ছাড়া কোন লোকের হাতে বাইআত করবে, তার অনুসরণ করা যাবে না এবং ঐ লোকেরও না, যে তার অনুসরণ করবে। কেননা, উভয়েরই হত্যার শিকার হবার আশংকা রয়েছে। যখন আল্লাহ্ তাঁর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে ওফাত দিলেন, তখন আবূ বকর (রাঃ) ছিলেন আমাদের মধ্যে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি...। 

[সহীহ্ আল বুখারীর:কিতাবুল হুদূদ]

উল্লেখ্য, বৈধ খলীফাহ্ মনোনীত করার জন্য শুধু যোগ্য হলেই হবে না, বরং শারঈ নিয়ম অনুযায়ী মাশওয়ারাহ হতে হবে। আর মূলত মাশওয়ারাহর মাধ্যমেই খলীফাহ্ হওয়ার জন্য সর্বাধিক যোগ্য কে তা প্রমাণিত হবে। যদি মাশওয়ারাহ (বা কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের মাঝে কার্যকর আলোচনা পরামর্শ ও ঐকমত্য) ছাড়া কারো বৈধ খলীফাহ্ হওয়ার সুযোগ থাকতো, তবে আবু বাকর (রাঃ) এজন্য সর্বাধিক যোগ্য ছিলেন। কেননা তাঁর যোগ্যতা ছিল প্রশ্নাতীত আর তাঁর ব্যাপারে রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষ থেকে ইঙ্গিতও ছিল। 

তাসত্ত্বেও রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাতের পর আবু বাকর (রাঃ) এবং উমার (রাঃ) মাশওয়ারাহ করার লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের অন্যতম সহযোগী আনসারগণের নিকট যাচ্ছিলেন, তখন দুজন আনসারী সাহাবী (রাঃ) মুহাজিরগণকে তাদের (মধ্য থেকে কাউকে খলীফাহ্ মনোনীত করে ফেলার) কাজ সমাধা করতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু আবু বাকর (রাঃ) ও উমার (রাঃ) এবং মুহাজিরগণ এ প্রস্তাব গ্রহণ করেন নি। এ বিষয়টিও বুখারীতে বর্ণিত উমার (রাঃ)-এর ঐ দীর্ঘ হাদীসেই উল্লেখ আছে। হাদীসের এ অংশটুকু হলো:

٠٠٠

وَاجْتَمَعَ الْمُهَاجِرُونَ إِلَى أَبِي بَكْرٍ فَقُلْتُ لِأَبِي بَكْرٍ يَا أَبَا بَكْرٍ انْطَلِقْ بِنَا إِلَى إِخْوَانِنَا هَؤُلاَءِ مِنْ الأَنْصَارِ فَانْطَلَقْنَا نُرِيدُهُمْ فَلَمَّا دَنَوْنَا مِنْهُمْ لَقِيَنَا مِنْهُمْ رَجُلاَنِ صَالِحَانِ فَذَكَرَا مَا تَمَالاَ عَلَيْهِ الْقَوْمُ فَقَالاَ أَيْنَ تُرِيدُونَ يَا مَعْشَرَ الْمُهَاجِرِينَ فَقُلْنَا نُرِيدُ إِخْوَانَنَا هَؤُلاَءِ مِنْ الأَنْصَارِ فَقَالاَ لاَ عَلَيْكُمْ أَنْ لاَ تَقْرَبُوهُمْ اقْضُوا أَمْرَكُمْ فَقُلْتُ وَاللهِ لَنَأْتِيَنَّهُمْ فَانْطَلَقْنَا حَتَّى أَتَيْنَاهُمْ فِي سَقِيفَةِ بَنِي سَاعِدَةَ فَإِذَا رَجُلٌ مُزَمَّلٌ بَيْنَ ظَهْرَانَيْهِمْ فَقُلْتُ مَنْ هَذَا فَقَالُوا هَذَا سَعْدُ بْنُ عُبَادَةَ فَقُلْتُ مَا لَهُ قَالُوا يُوعَكُ فَلَمَّا جَلَسْنَا قَلِيلاً تَشَهَّدَ خَطِيبُهُمْ فَأَثْنَى عَلَى اللهِ بِمَا هُوَ أَهْلُهُ ثُمَّ قَالَ أَمَّا بَعْدُ فَنَحْنُ أَنْصَارُ اللهِ وَكَتِيبَةُ الإِسْلاَمِ وَأَنْتُمْ مَعْشَرَ الْمُهَاجِرِينَ رَهْطٌ وَقَدْ دَفَّتْ دَافَّةٌ مِنْ قَوْمِكُمْ فَإِذَا هُمْ يُرِيدُونَ أَنْ يَخْتَزِلُونَا مِنْ أَصْلِنَا وَأَنْ يَحْضُنُونَا مِنْ الأَمْرِ فَلَمَّا سَكَتَ أَرَدْتُ أَنْ أَتَكَلَّمَ وَكُنْتُ قَدْ زَوَّرْتُ مَقَالَةً أَعْجَبَتْنِي أُرِيدُ أَنْ أُقَدِّمَهَا بَيْنَ يَدَيْ أَبِي بَكْرٍ وَكُنْتُ أُدَارِي مِنْهُ بَعْضَ الْحَدِّ فَلَمَّا أَرَدْتُ أَنْ أَتَكَلَّمَ قَالَ أَبُو بَكْرٍ عَلَى رِسْلِكَ فَكَرِهْتُ أَنْ أُغْضِبَهُ فَتَكَلَّمَ أَبُو بَكْرٍ فَكَانَ هُوَ أَحْلَمَ مِنِّي وَأَوْقَرَ وَاللهِ مَا تَرَكَ مِنْ كَلِمَةٍ أَعْجَبَتْنِي فِي تَزْوِيرِي إِلاَّ قَالَ فِي بَدِيهَتِهِ مِثْلَهَا أَوْ أَفْضَلَ مِنْهَا ٠٠٠

    

...অপরদিকে মুহাজিরগণ আবূ বকরের কাছে সমবেত হলেন। তখন আমি আবূ বকরকে বললাম, হে আবূ বকর! আমাদেরকে নিয়ে আমাদের ঐ আনসার ভাইদের কাছে চলুন। এরপর আমরা তাদের উদ্দেশে রওনা হলাম। যখন আমরা তাদের নিকটবর্তী হলাম তখন আমাদের সঙ্গে তাদের দু’জন পুণ্যবান ব্যক্তির সাক্ষাৎ হল। তারা উভয়েই এ বিষয়ে আলোচনা করলেন, যে বিষয়ে লোকেরা আলোচনা করছিল। এরপর তারা বললেন, হে মুহাজির দল! আপনারা কোথায় যাচ্ছেন? তখন আমরা বললাম, আমরা আমাদের ঐ আনসার ভাইদের উদ্দেশে রওনা হয়েছি। তারা বললেন: না, আপনাদের তাদের নিকট যাওয়ার প্রয়োজন নেই। বরং আপনারা আপনাদের বিষয় সমাপ্ত করে নিন। তখন আমি বললাম, আল্লাহর কসম! আমরা অবশ্যই তাদের কাছে যাব। আমরা চললাম। অবশেষে বানী সাঈদার চত্বরে তাদের কাছে এলাম। আমরা দেখতে পেলাম তাদের মাঝখানে এক লোক বস্ত্রাবৃত অবস্থায় রয়েছেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ঐ লোক কে? তারা জবাব দিল ইনি সা’দ ইবনু উবাদাহ। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তার কী হয়েছে? তারা বলল, তিনি জ্বরে আক্রান্ত।

আমরা কিছুক্ষণ বসার পরই তাদের খতীব উঠে দাঁড়িয়ে কালিমায়ে শাহাদাত পড়লেন এবং আল্লাহর যথোপযুক্ত প্রশংসা করলেন। তারপর বললেন, আম্মাবাদ, আমরা আল্লাহর (দ্বীনের) সাহায্যকারী ও ইসলামের সেনাদল এবং তোমরা হে মুহাজির দল! একটি ছোট দল মাত্র, যে দলটি তোমাদের গোত্র থেকে আলাদা হয়ে আমাদের কাছে পৌঁছেছে। অথচ এরা এখন আমাদেরকে মূল থেকে সরিয়ে দিতে এবং খিলাফত থেকে বঞ্চিত করে দিতে চাচ্ছে। যখন তিনি নিশ্চুপ হলেন তখন আমি কিছু বলার ইচ্ছে করলাম। আর আমি আগে থেকেই কিছু কথা সাজিয়ে রেখেছিলাম, যা আমার কাছে ভাল লাগছিল। আমি ইচ্ছে করলাম যে, আবূ বকর (রাঃ)-এর সামনে কথাটি পেশ করব। আমি তার ভাষণ থেকে সৃষ্ট রাগকে কিছুটা ঠান্ডা করতে চাইলাম। আমি যখন কথা বলতে চাইলাম তখন আবূ বকর (রাঃ) বললেন, তুমি থাম। আমি তাঁকে রাগান্বিত করাটা পছন্দ করলাম না। তাই আবূ বকর (রাঃ) কথা বললেন, আর তিনি ছিলেন আমার চেয়ে সহনশীল ও গম্ভীর। আল্লাহর কসম! তিনি এমন কোন কথা বাদ দেননি যা আমি সাজিয়ে রেখেছিলাম। অথচ তিনি তাৎক্ষণিকভাবে ঐরকম বরং তার থেকেও উত্তম কথা বললেন...।

[সহীহ্ আল বুখারী: কিতাবুল হুদূদ]

মোটকথা, এ জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের মধ্যে মাশওয়ারাহ (তথা কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের মাঝে কার্যকর আলোচনা-পরামর্শ ও ঐকমত্য)  ব্যতীত খলীফাহ্ মনোনীত হওয়ার কোন সুযোগ নেই।  

সুতরাং, আল কুরআন, রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ্ এবং  খুলাফায়ে রশিদীনের সুন্নাহ অনুযায়ী (নতুন) খলীফাহ্ মনোনীত করার উক্ত পরস্পর সম্পর্কযুক্ত নিয়ম-নীতি-পন্থাই আমাদের জন্য অনুসরণীয়; তাহলো:

১. সরাসরি বা ইঙ্গিতমূলক নুসূস বা শারঈ দালীল। বর্তমানে কারো জন্য নুসূস নেই। এ উম্মাহর শেষদিকে মুহাম্মাদ ইবনু আবদুল্লাহ আল মাহদী এবং ঈসা (আঃ) সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট দালীল আছে (আবু দাউদ ও অন্যান্য হাদীসের কিতাবে)। 

[তবে আবু বাকর (রাঃ) এবং তারপর উমার (রাঃ)-এর ব্যাপারে রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষ থেকে ইঙ্গিতমূলক দালীল আছে এবং পাশাপাশি আলোচনা/মাশওয়ারাহর মাধ্যমে উম্মাহর ঐকমত্যে তিনি খলীফাহ্ মনোনীত হয়েছেন।]    

২. আল কুরআন ও হাদীসে বর্ণিত শূরা বা মাশওয়ারাহ, যা আহলুশ শূরা বা আহলুল হাল্লি ওয়াল আকদ তথা উম্মাহর অভিজ্ঞ ও অনুসরণীয় ব্যক্তিবর্গ ও প্রতিনিধিগণ কর্তৃক বাস্তবায়িত হয়েছে। এটা আবু বাকর (রাঃ)-এর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়েছে; যদিও তাঁর ব্যাপারে ইঙ্গিতমূলক দালীল ছিল/আছে। 

৩. পূর্ববর্তী খলীফাহ কর্তৃক উম্মাহর (যোগ্য ও অনুসরণীয় ব্যক্তিবর্গের) সাথে  মাশওয়ারাহ্ ভিত্তিক অসিয়াত। এটা করেছিলেন আবু বাকর (রাঃ) পরবর্তী খলীফাহ্ উমার (রাঃ)-এর জন্য। এভাবে উমার (রাঃ) খলীফাহ্ মনোনীত হয়েছেন। 

৪. পূর্ববর্তী খলীফাহ কর্তৃক একজনকে মনোনীত না করে সর্বাধিক যোগ্য কিছু ব্যাক্তিকে মনোনীত করা, যারা নিজেদের মধ্য থেকে একজনের বিষয়ে একমত হয়ে তাঁকে খলীফাহ্ মনোনীত করবেন।  

স্থান-কাল-পাত্র, অবস্থা ও প্রয়োজনীয়তা বিবেচনায় এই শেষোক্ত তিনটি পদ্ধতি বা প্রক্রিয়া একক/সমন্বিতভাবে অনুসরণ করা যায় বা করতে হবে। এর প্রতিটিতেই যে বিষয়টি নিশ্চিতভাবে উপস্থিত তা হলো মুমিনগণের শূরা বা মাশওয়ারাহ্। 

তাহলে এখন আমাদের জন্য মূলত দুটি পদ্ধতি আছে; 

এক. উম্মাহর অনুসরণীয় ব্যক্তিবর্গের সম্মিলিত শূরা ও ঐকমত্য, 

দুই. পূর্বের খলীফাহ্ কর্তৃক উম্মাহর অনুসরণীয় ব্যক্তিবর্গের সাথে মাশওয়ারাহ করে কোন একজনের জন্য (বা কয়েকজনের ব্যাপারে) ওসীয়াত।   

উল্লেখ্য, উম্মাহর নেতৃস্থানীয় প্রতিনিধি বা আহলুশ্ শুরার প্রায় সবাই বা অধিকাংশ কারো ব্যাপারে একমত হওয়ার পর (ব্যতিক্রম) এক/দুজন দ্বিমত পোষণ করলেও (প্রায় সকলের/অধিকাংশের ঐকমত্য অনুযায়ী যার বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে) তার খলীফাহ্ হতে বাধা নেই। 

আহলুল হাল্লি ওয়াল আকদ/আহলুশ শুরার মূল কর্তৃপক্ষ যথাযথ প্রক্রিয়ায় খলীফাহ্ মনোনীত করবেন এবং তারাই প্রথম উক্ত খলীফাহর নিকট বাইয়াহ প্রদান করবেন বা কিতাবুল্লাহ্ ও সুন্নাহ্ অনুযায়ী খলীফাহর আনুগত্যের জন্য অঙ্গীকারাবদ্ধ হবেন। 

এভাবেই আবু বাকর (রাঃ), উমার (রাঃ),  উসমান (রাঃ) প্রমুখ খলীফাহ্ মনোনীত হয়েছিলেন। তাঁদেরকে খলীফাহ্ মনোনীত করার ক্ষেত্রে যে নিয়ম ও প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়েছে তা সমন্বিতভাবে অনুসরণীয়। 

[এ বিষয়ে আরো বর্ধিত ও বিস্তারিত আলোচনার জন্য দেখুন -  

আল ইমামাতুল উজমা ইনদা আহলিস সুন্নাতি ওয়াল জামাআহ, 

মাসাইলু ফী ফিকহিল খিলাফাহ্... ইত্যাদি কিতাব।]  

যদি প্রকৃত খিলাফাহ্ প্রতিষ্ঠিত থাকে এবং তখন এসব শারঈ নিয়ম-প্রক্রিয়া অনুযায়ী কেউ খলীফাহ্ মনোনীত হন তবেই কেবল তিনি খলীফাহ্ বা বৈধ খলীফাহ্ হিসেবে গণ্য হবেন; এমতাবস্থায় তার বাইয়াহ ও আনুগত্য ওয়াজিব হবে। এমতাবস্থায় কেউ এরূপ বৈধ খলীফাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলে তখন তাদের বিরুদ্ধে قتال اهل البغى বা বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে কিতাল প্রযোজ্য হবে। [এ বিষয়ে বিস্তারিত দ্রঃ قتال اهل البغى]  

আর যদি প্রকৃত খিলাফাহ্ প্রতিষ্ঠিত না হয় এবং উক্ত শারঈ নিয়ম-প্রক্রিয়া অনুযায়ী কেউ খলীফাহ্ মনোনীত না হন তবে তিনি বৈধ খলীফাহ্ নন; এমতাবস্থায় (পূর্বোক্ত বৈধ খলীফাহর মতো) তার বাইয়াহ্ ও আনুগত্য প্রযোজ্য/ওয়াজিব নয়।

এমতাবস্থায় কেউ বৈধ খলীফাহ্ মনোনীত করার লক্ষ্যে এরূপ অবৈধ খলীফাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে পারেন। 

তখন যারা তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে তাদের বিরুদ্ধে قتال اهل البغى বা বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে কিতাল-এর হুকুম প্রয়োগ করার নৈতিক অধিকার এই অবৈধ খলীফাহর  নেই। 

এরূপ ব্যক্তি (অবৈধ খলীফাহ্) কুরাইশী হোক বা অন্য কেউ হোক সকলের উপরই সংশ্লিষ্ট সকল শারঈ নীতি প্রযোজ্য হবে। আর কারো দ্বারা এরূপ অন্যায় সংঘটিত হলে শারঈ নিয়ম অনুযায়ী বৈধ খলীফাহ্ মনোনীত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন শারঈ দালীল সমন্বিত রূপে অনুসরণ পূর্বক স্থান-কাল-পাত্র ও অবস্থাভেদে এবং দীনী উপকার, অপকার, সম্ভাবনা ও আশংকা ইত্যাদি বিবেচনায় উক্ত অবৈধ খলীফাহকে অপসারণ করা কখনো কর্তব্য, কখনো উত্তম, কখনো বৈধ; আবার কখনো বাধ্য হয়ে তাকে খলীফাহ্ হিসেবে মেনে নেয়াও বৈধ। 

অনেক সাহাবী (ব্যাপক রক্তপাতের আশংকায় এবং উম্মাহর বৃহৎ স্বার্থে) পরবর্তী উমাইয়া খলীফাহদেরকে মেনে নিয়েছেন; আবার কোন কোন সাহাবী (যেমন- হুসাইন রা.) কোন উমাইয়া খলীফাহকে না মেনে বিদ্রোহও করেছেন। এরূপ ক্ষেত্রে উভয়টিই বৈধ।

[এ বিষয়ে আরো বিস্তারিত দ্রঃ

الجهاد والقتال في السياسة الشرعية

قتال مغتصب السلطة] 

   

আলহামদুলিল্লাহ, এ বিষয়ে সংক্ষেপে কিছু আলোচনা করলাম, এখানে এটাই যথেষ্ট হবে, ইনশাআল্লাহ। 

:খিলাফাহ্ ও খলীফাহর কর্তৃত্বসীমা:

এ বিষয়ে আমাদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয় হলো : শারঈ খিলাফাহ্ ও খলীফাহর শাসন কর্তৃত্বের সীমারেখা কতটুকু?  

যখন প্রকৃত খিলাফাহ্ প্রতিষ্ঠিত হবে এরপর শারঈ নিয়ম অনুযায়ী বৈধ খলীফাহ্ মনোনীত হবেন তখন তার বাইআহ্ ও আনুগত্য উম্মাহর/মুসলিমদের উপর ওয়াজিব। এ বিষয়ে শারীআহতে যথেষ্ট দালীল-প্রমাণ ও দৃষ্টান্ত আছে, আলহামদুলিল্লাহ। 

তবে এক্ষেত্রে যেসব বিষয় স্মরণ রাখা জরুরি:

- আল্লাহ তায়ালার আনুগত্য হতে হবে শর্তহীন এবং কোন প্রকার সীমাবদ্ধতা ছাড়াই। এটাই প্রকৃত ইবাদাহ্। 

- রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অনুসরণও হতে হবে শর্তহীন, আর এর মাধ্যমেই কেবল আল্লাহর ইবাদাত করা সম্ভব। আল্লাহর নির্দেশ অনুসারে রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণ করার অর্থই হলো আল্লাহর আনুগত্য। 

- (সর্বশেষ) নাবী ও রসূল হিসেবে  রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি ঈমান ও আনুগত্যের ক্ষেত্রে কোন বিশেষ স্থান/দেশ ইত্যাদি বিবেচনা করার কোন প্রয়োজন বা সুযোগ নেই। অর্থাৎ যে যেখানেই থাকুক তাঁর প্রতি ঈমান আনতে হবে এবং তাঁর আনীত দীনের অনুসারী হতে হবে। এ ব্যাপারে কোন ছাড় নেই। এটাকে ইসলামের বাইয়াহ্ হিসেবেও অভিহিত করা হতো। 

- তবে রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আরেকটি পরিচয় ছিল ও আছে, তা হলো: মাদীনায় হিজরত করার পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তিনি দারুল ইসলাম বা ইসলামী রাষ্ট্রের ইমাম বা শাসকও ছিলেন। সে সময় (এ ইসলামী রাষ্ট্রে) তাঁর কর্তৃত্বের অনুসরণ করার দায়িত্ব শুধু তাদের উপরই আরোপ করা হয়েছিল যারা উক্ত রাষ্ট্রের বা কর্তৃত্বের অধীনে ছিলেন। বিধায়, সে সময় যারা এ কর্তৃত্বের বাইরে ছিল তাদের উপর রসূল (সঃ) উক্ত রাষ্ট্রের অধিবাসীদের মত আনুগত্য করার দায়িত্ব অর্পণ করেন নি। বরং কেউ হিজরত করে মাদীনাহ্য় আসলে তখনই তার উপর বাইয়াহ্ ও আনুগত্যের দায়িত্ব অর্পণ করেছেন। আল কুরআনের কিছু আয়াত এবং বিভিন্ন হাদীস ও রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের (বিশুদ্ধ) জীবনীগ্রন্থই এর প্রমাণ। 

- কোন ইসলামী রাষ্ট্রের আমীর কিংবা প্রকৃত খিলাফাহর খলীফাহ্ও তার শাসন-কর্তৃত্বের বাইরে কাউকে তার শাসন-কর্তৃত্বের অধীনস্থ বিবেচনা করতে পারবেন না, যতক্ষণ না সে বাস্তবেই তার কর্তৃত্বের অধীনে আসে। কারো জন্য এটা দাবি করার সুযোগ থাকলে স্বয়ং রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামই ছিলেন এর অধিকতর যোগ্য। সুতরাং কেউ যদি এরূপ দাবি করে তবে তা অবশ্যই শারঈ নিয়ম বহির্ভূত দাবি। কেননা, রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

عَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهَا قَالَتْ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم مَنْ عَمِلَ عَمَلاً لَيْسَ عَلَيْهِ أَمْرُنَا فَهُوَ رَدٌّ ٠

আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন,যে ব্যক্তি এমন কোন আমল করলো যে ব্যাপারে আমাদের নির্দেশনা নেই, তা প্রত্যাখ্যাত।

[সহীহ্ মুসলিম:বিচার-ফায়সালা অধ্যায় (كتاب الأقضية)]

عَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهَا قَالَتْ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم مَنْ أَحْدَثَ فِيْ أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ فِيْهِ فَهُوَ رَدٌّ ٠

আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘কেউ আমাদের এ শরী‘আতে নাই এমন কিছুর উদ্ভাবন  করলে তা প্রত্যাখ্যাত।

[সহীহ্ আল বুখারী: বিবাদ মীমাংসা অধ্যায় (كتاب الصلح)]

:খলীফাহর বাইয়াহ-আনুগত্য এবং অবাধ্যতা ও জাহিলিয়্যাহর মৃত্যু: 

যখন প্রকৃত খিলাফাহ্ প্রতিষ্ঠিত থাকে এবং উম্মাহ কর্তৃক শারঈ নিয়ম অনুযায়ী (বৈধ) খলীফাহ্ মনোনীত হন তখন তাঁর বাইয়াহ্ ও আনুগত্য করা (তাঁর অধীনস্থ) সকলের জন্য ওয়াজিব। আর এক্ষেত্রে তিনি যদি শারীআহ বিরোধী কোন নির্দেশ দেন তবে তা মানা যাবে না। কেননা, সহীহ্ আল বুখারীতে বর্ণিত আছে :

بَاب السَّمْعِ وَالطَّاعَةِ لِلْإِمَامِ مَا لَمْ تَكُنْ مَعْصِيَةً

مُسَدَّدٌ حَدَّثَنَا يَحْيَى بْنُ سَعِيدٍ عَنْ عُبَيْدِ اللهِ حَدَّثَنِي نَافِعٌ عَنْ عَبْدِ اللهِ عَنْ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ السَّمْعُ وَالطَّاعَةُ عَلَى الْمَرْءِ الْمُسْلِمِ فِيمَا أَحَبَّ وَكَرِهَ مَا لَمْ يُؤْمَرْ بِمَعْصِيَةٍ فَإِذَا أُمِرَ بِمَعْصِيَةٍ فَلاَ سَمْعَ وَلاَ طَاعَةَ ٠

অনুচ্ছেদ: ইমামের কথা শোনা ও মানা, যতক্ষণ তা নাফরমানীর কাজ না হয়।

আবদুল্লাহ্ (রাঃ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেছেন: যতক্ষণ আল্লাহর নাফরমানীর নির্দেশ দেয়া না হয়, ততক্ষণ (নিজের) পছন্দনীয় ও অপছন্দনীয় সকল বিষয়ে প্রত্যেক মুসলিমের জন্য তার কথা শ্রবণ ও আনুগত্য করা কর্তব্য। যখন নাফরমানীর নির্দেশ দেয়া হয়, তখন আর কোন মান্যতা ও আনুগত্য নেই।

[সহীহ্ আল বুখারী:কিতাবুল আহকাম]

তবে, যতক্ষণ পর্যন্ত খলীফাহ্ স্পষ্ট কুফরীতে লিপ্ত না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত তাকে খলীফাহ্ হিসেবে মানতে হবে। এ বিষয়ে অনেক হাদীস বর্ণিত আছে, তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, সহীহ্ আল বুখারীতে উবাদাহ ইবনুস সামিত (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে :

...  

فَقَالَ فِيمَا أَخَذَ عَلَيْنَا أَنْ بَايَعَنَا عَلَى السَّمْعِ وَالطَّاعَةِ فِي مَنْشَطِنَا وَمَكْرَهِنَا وَعُسْرِنَا وَيُسْرِنَا وَأَثَرَةً عَلَيْنَا وَأَنْ لاَ نُنَازِعَ الأَمْرَ أَهْلَهُ إِلاَّ أَنْ تَرَوْا كُفْرًا بَوَاحًا عِنْدَكُمْ مِنْ اللهِ فِيهِ بُرْهَانٌ ٠

আমাদের থেকে যে ওয়াদা তিনি (রসূলুল্লাহ্ স.) গ্রহণ করেছিলেন তাতে ছিল যে, আমরা আমাদের সুখে-দুঃখে, বেদনায় ও আনন্দে এবং আমাদের উপর অন্যকে অগ্রাধিকার দিলেও পূর্ণরূপে শ্রবণ ও আনুগত্যের বাই’আত (অঙ্গীকার) করলাম। আরও (বাই’আত করলাম) যে আমরা ক্ষমতা সংক্রান্ত বিষয়ে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে ঝগড়া করব না। কিন্তু যদি (তার মধ্যে) কুফরুন বাওয়াহ্ বা স্পষ্ট কুফরী দেখ, তোমাদের কাছে আল্লাহর তরফ থেকে যে বিষয়ে সুস্পষ্ট প্রমাণ বিদ্যমান, তাহলে আলাদা কথা। 

[সহীহ্ আল বুখারী: কিতাবুল ফিতান]

যখন প্রকৃত খিলাফাহ্ প্রতিষ্ঠিত থাকে এবং উম্মাহ কর্তৃক শারঈ নিয়ম অনুযায়ী (বৈধ) খলীফাহ্ মনোনীত হন তখন তাঁর বাইয়াহ্ ও আনুগত্য করা (তাঁর অধীনস্থ) সকলের জন্য ওয়াজিব। যদি কেউ তার আনুগত্য না করে কিংবা তার বাইয়াহ্ প্রত্যাহার করে এমতাবস্থায় মৃত্যুবরণ করে তবে তার মৃত্যুকে হাদীসে জাহিলিয়াতের মৃত্যু বলে আখ্যা দেয়া হয়েছে। যেমন হাদীসে বর্ণিত আছে:

عَنْ نَافِعٍ، قَالَ جَاءَ عَبْدُ اللَّهِ بْنُ عُمَرَ إِلَى عَبْدِ اللَّهِ بْنِ مُطِيعٍ حِينَ كَانَ مِنْ أَمْرِ الْحَرَّةِ مَا كَانَ زَمَنَ يَزِيدَ بْنِ مُعَاوِيَةَ فَقَالَ اطْرَحُوا لأَبِي عَبْدِ الرَّحْمَنِ وِسَادَةً فَقَالَ إِنِّي لَمْ آتِكَ لأَجْلِسَ أَتَيْتُكَ لأُحَدِّثَكَ حَدِيثًا سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَقُولُهُ سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ : مَنْ خَلَعَ يَدًا مِنْ طَاعَةٍ لَقِيَ اللَّهَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ لاَ حُجَّةَ لَهُ وَمَنْ مَاتَ وَلَيْسَ فِي عُنُقِهِ بَيْعَةٌ مَاتَ مِيتَةً جَاهِلِيَّةً ‏‏٠ ‏

নাফি (রহঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আবদুল্লাহ ইবনু উমার (রাযিঃ) আবদুল্লাহ ইবনু মুতী (রাযিঃ) এর নিকট এলেন তখন (হৃদয় বিদারক) হাররা-এর ঘটনা ঘটেছে এবং যুগটা ছিল ইয়াযীদ ইবনু মুআবিয়ার যুগ। তখন তিনি (ইবনু মুতী) বললেন, আবূ আবদুর রহমানের জন্য বিছানা পেতে দাও। তখন তিনি বললেন, আমি তোমার কাছে বসতে আসিনি, এসেছি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট যে হাদীস শুনেছি তা তোমাকে শুনাতে। আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি (আমীরের) আনুগত্য থেকে হাত গুটিয়ে নিয়ে মৃত্যুবরণ করে সে কিয়ামতের দিন আল্লাহর সাথে এমন অবস্থায় মিলিত হবে যে তার কোন দলীল থাকবে না। আর যে ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করলো আর তার ঘাড়ে আনুগত্যের কোন চুক্তি নেই তার মৃত্যু হবে জাহিলিয়াতের মৃত্যু। 

[সহীহ্ মুসলিম:প্রশাসন ও নেতৃত্ব অধ্যায়

 (كتاب الإمارة) 

 باب الأَمْرِ بِلُزُومِ الْجَمَاعَةِ عِنْدَ ظُهُورِ الْفِتَنِ وَتَحْذِيرِ الدُّعَاةِ إِلَى الْكُفْرِ ‏‏٠  

(পরিচ্ছেদ: ফিতনার যুগে মুসলিমদের জামাআহ আঁকড়ে থাকা অত্যাবশ্যক এবং কুফরের দিকে আহ্বানকারীদের সম্পর্কে সতর্ক থাকার নির্দেশ)]

এ হাদীসের ব্যাখ্যায় সহীহ্ আল বুখারীর ব্যাখ্যাগ্রন্থ ফাতহুল বারী-তে এসেছে: 

والمراد بالميتة الجاهلية وهي بكسر الميم أن يكون حاله في الموت كموت أهل الجاهلية على ضلال وليس له إمام مطاع لأنهم كانوا لا يعرفون ذلك , وليس المراد أن يموت كافرا بل يموت عاصيا ٠

আর (ميتة শব্দের মীম হরফে যের যোগে) জাহিলিয়্যাতের মৃত্যু বলতে যা বোঝায় তা হল, জাহিলী যুগের মানুষের ন্যায় ভ্রান্তির উপর মৃত্যুর মত এমতাবস্থায় যে তার কোন অনুসরণীয় ইমাম নেই; কারণ তারা এটা জানত না;(অর্থাৎ জাহিলী যুগের মানুষের কোন একক বা আম নেতৃত্ব ছিল না বরং প্রত্যেকেই পৃথক পৃথক গোত্রীয় নেতাদের অনুসরণ করতো।) এর দ্বারা উদ্দেশ্য নয় যে সে কাফের হয়ে মারা যায়, বরং সে অবাধ্য হয়ে মারা যায়।

এছাড়াও ইমাম নববী (রহঃ), ইমাম ইবনু তাইমিয়াহ (রহঃ) এবং অন্যান্য ইমামগণও এ বিষয়ে প্রায় অনুরূপ বলেছেন।

আর এসব/এরূপ হাদীসের উল্লিখিত শব্দসমূহের প্রয়োগের ব্যাপারে সালাফগণ সতর্ক ছিলেন। তাঁরা এ কারণে কারো বিরুদ্ধে এরূপ শব্দাবলী সুনির্দিষ্টভাবে প্রয়োগ করতেন না। বরং হাদীসের উদ্দেশ্য অনুযায়ী যারা এ আমল না করতো তাদেরকে ভয় প্রদর্শন করতেন।

জাহিলিয়াতের মৃত্যুর কথা এরূপ আরো অনেক হাদীসেই বলা হয়েছে, তার অর্থ কী? অনেকে অজ্ঞতাবশতঃ মনে করেন যে, এর দ্বারা (হয়তো) কুফর বুঝানো হয়েছে! আসলে বিষয়টি এরূপ নয়। বরং এর দ্বারা জাহিলিয়াতের বিশেষ কোন অভ্যাস বুঝানো হয়েছে এবং তা উল্লেখ পূর্বক মূলতঃ ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে। 

আরো বহু হাদীসে এরূপ কিছু পাপে লিপ্ত ব্যক্তিদের পাপের ভয়াবহতা ও সতর্কীকরণের বর্ণনা আছে, তবে এসব পাপে লিপ্তদেরকে কাফির বলা হয় নি। যেমন ইমাম বুখারী বর্ণনা করেছেন :

باب الْمَعَاصِي مِنْ أَمْرِ الْجَاهِلِيَّةِ

وَلاَ يُكَفَّرُ صَاحِبُهَا بِارْتِكَابِهَا إِلاَّ بِالشِّرْكِ لِقَوْلِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «إِنَّكَ امْرُؤٌ فِيكَ جَاهِلِيَّةٌ». وَقَوْلِ اللَّهِ تَعَالَى: (إِنَّ اللَّهَ لاَ يَغْفِرُ أَنْ يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَلِكَ لِمَنْ يَشَاءُ) ٠

حَدَّثَنَا سُلَيْمَانُ بْنُ حَرْبٍ، قَالَ حَدَّثَنَا شُعْبَةُ، عَنْ وَاصِلٍ الأَحْدَبِ، عَنِ الْمَعْرُورِ، قَالَ لَقِيتُ أَبَا ذَرٍّ بِالرَّبَذَةِ، وَعَلَيْهِ حُلَّةٌ، وَعَلَى غُلاَمِهِ حُلَّةٌ، فَسَأَلْتُهُ عَنْ ذَلِكَ، فَقَالَ إِنِّي سَابَبْتُ رَجُلاً، فَعَيَّرْتُهُ بِأُمِّهِ، فَقَالَ لِيَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم ‏ "‏ يَا أَبَا ذَرٍّ أَعَيَّرْتَهُ بِأُمِّهِ إِنَّكَ امْرُؤٌ فِيكَ جَاهِلِيَّةٌ، إِخْوَانُكُمْ خَوَلُكُمْ، جَعَلَهُمُ اللَّهُ تَحْتَ أَيْدِيكُمْ، فَمَنْ كَانَ أَخُوهُ تَحْتَ يَدِهِ فَلْيُطْعِمْهُ مِمَّا يَأْكُلُ، وَلْيُلْبِسْهُ مِمَّا يَلْبَسُ، وَلاَ تُكَلِّفُوهُمْ مَا يَغْلِبُهُمْ، فَإِنْ كَلَّفْتُمُوهُمْ فَأَعِينُوهُمْ ‏"‏‏.‏

পরিচ্ছেদ: পাপ কাজ জাহিলী যুগের অভ্যাস। আর শির্‌ক ব্যতীত অন্য কোন গুনাহ্‌তে লিপ্ত হওয়াতে ঐ পাপীকে কাফির বলা যাবে না।

যেহেতু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম [আবূ যার্ (রাযি.)-কে লক্ষ্য করে] বলেছেন: তুমি এমন ব্যক্তি, তোমার মধ্যে জাহিলী যুগের অভ্যাস রয়েছে। আর আল্লাহর বাণী: আল্লাহ্ তাঁর সাথে অংশীদার স্থাপন করার গুনাহ ক্ষমা করেন না। এছাড়া অন্যান্য গুনাহ যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন। (সূরাহ্ আন-নিসা: ৪৮)

মা’রূর (রহ.) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন: আমি একবার রাবাযা নামক স্থানে আবূ যার্ (রাযি.)-এর সঙ্গে দেখা করলাম। তখন তাঁর পরনে ছিল এক জোড়া কাপড় (লুঙ্গি ও চাদর) আর তাঁর ভৃত্যের পরনেও ছিল ঠিক একই ধরণের এক জোড়া কাপড়। আমি তাঁকে এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন: একবার আমি জনৈক ব্যক্তিকে গালি দিয়েছিলাম এবং আমি তাকে তার মা সম্পর্কে লজ্জা দিয়েছিলাম। তখন আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন, হে আবূ যার্! তুমি তাকে তার মা সম্পর্কে লজ্জা দিয়েছ? তুমি তো এমন ব্যক্তি, তোমার মধ্যে এখনো অন্ধকার যুগের স্বভাব বিদ্যমান। জেনে রেখো, তোমাদের দাস-দাসী তোমাদেরই ভাই। আল্লাহ্ তা’আলা তাদের তোমাদের অধীনস্থ করে দিয়েছেন। তাই যার ভাই তার অধীনে থাকবে, সে যেন তাকে নিজে যা খায় তাকে তা-ই খাওয়ায় এবং নিজে যা পরিধান করে, তাকেও তা-ই পরায়। তাদের উপর এমন কাজ চাপিয়ে দিও না, যা তাদের জন্য অধিক কষ্টদায়ক। যদি এমন কষ্টকর কাজ করতে দাও, তাহলে তোমরাও তাদের সে কাজে সহযোগিতা করবে।

[সহীহ্ আল বুখারী: কিতাবুল ঈমান]

মদ পানকারীর ব্যাপারেও জাহিলিয়্যাতের মৃত্যুর পরিণতির কথা হাদীসে বর্ণিত আছে:

  عن عبد الله بن عمرو ان رسول الله صلى الله عليه و سلم قال الخَمرُ أُمُّ الخَبائِثِ، ومَن شَرِبَها لم يَقبَلِ اللهُ منه صَلاةً أربَعينَ يَومًا، فإنْ ماتَ وهي في بَطنِه ماتَ مِيتةً جاهِليَّةً ٠

আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহুআলাইহি ওয়াসাল্লাম  বলেছেন: মাদকদ্রব্য হলো সকল অপবিত্রতা/মন্দের মূল, যে ব্যক্তি তা সেবন করবে, আল্লাহ তার চল্লিশ দিনের সলাত কবুল করবেন না। আর তা পেটে থাকাবস্থায় যদি সে মারা যায় তবে সে জাহিলিয়্যাতের উপর মৃত্যুবরণ করল।

[হাদীসটি সহীহ। সুনানু দারাকুতনী, তবারানী (মুজামুল ওয়াসীত)] 

এমনকি বহু সহীহ্ হাদীসে অনেক মন্দ   আমলকে কুফর...ইত্যাদি বলে ধমকি প্রদান করা হয়েছে। তবে তাতে শুধু জড়িত হলেই কেউ কাফির হয় না। যেমন সহীহ্ আল বুখারীতে বর্ণিত আছে:

عَنْ ابْنِ عَبَّاسٍ عَنْ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ لاَ يَزْنِي الزَّانِي حِينَ يَزْنِي وَهُوَ مُؤْمِنٌ وَلاَ يَسْرِقُ السَّارِقُ حِينَ يَسْرِقُ وَهُوَ مُؤْمِنٌ ٠

ইবনু আব্বাস (রাঃ) সূত্রে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ব্যভিচারী যখন ব্যভিচার করে, তখন সে মু’মিন থাকে না। এবং চোর যখন চুরি করে তখন সে মু’মিন থাকে না।

[সহীহ্ আল বুখারী:كتاب الحدود]

এরূপ অনেক দৃষ্টান্ত সহীহ্ হাদীসে বর্ণিত আছে। 

উল্লেখ্য, খলীফাহর বাইয়াহ্ ও আনুগত্য পৃথক কোন আমল নয়, বরং বাইয়াহ্ হলো আনুগত্যের অঙ্গীকার বা চুক্তি। এটা তখনই প্রাসঙ্গিক এবং প্রযোজ্য হবে যখন প্রকৃতপক্ষেই খিলাফাহ্ প্রতিষ্ঠিত হবে এবং প্রকৃত খিলাফাহ্ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর শারঈ নিয়ম অনুযায়ী বৈধ খলীফাহ্ মনোনীত হবেন। তার আগে খিলাফাহ্ ও খলীফাহর নামে বাইয়াতের দাবি সম্পূর্ণ বাতিল ও ভ্রান্ত। (প্রকৃত খিলাফাহ্ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সময় যিনি মুমিন ও মুজাহিদের আমীর ও অগ্রগামী থাকবেন তিনিও খলীফাহ হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারেন।)

আর, প্রকৃত খিলাফাহ্ ও খলীফাহ্ থাকাবস্থায় পৃথিবীর সকল প্রান্ত থেকে প্রত্যেক ব্যক্তিকে আলাদা আলাদা বাইয়াতের ঘোষণা দিতে হবে না বরং তখন সবাই ইসলামী হুকুমত মেনে চলবেন ইনশাআল্লাহ, এটাই তার বাইয়াহ্ ও আনুগত্য। এটাই সকলের জন্য যথেষ্ট, যতক্ষণ পর্যন্ত কেউ (শারঈ/পারিভাষিক অর্থে) বিদ্রোহ না করে। অর্থাৎ ইসলামী হুকুমতের স্বাভাবিক আনুগত্যের মধ্যে থাকাটাই হলো বাইয়াতভুক্ত থাকা। 

আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে সঠিক বুঝ দান করুন এবং যথাযথ আমল করার তাওফীকদান করুন । 

:খিলাফাহ্ আলা মিনহাজিন নুবুওয়্যাহ্:

    (خلافة على منهاج النبوة)

[নুবুওয়াতের আদর্শে প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত খিলাফাহ্]

এটা ইসলামী খিলাফাহর মধ্যে বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ অংশ। এটা দ্বারা মূলত খুলাফায়ি রশিদীন এবং যাদের বা খিলাফাহর যে অংশের কথা সরাসরি হাদীসে বর্ণিত আছে সেটাকেই বুঝায়।

যেমন হাদীসে এসেছে:

عَنِ حُذَيْفَةُ، قال: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: تَكُونُ النُّبُوَّةُ فِيكُمْ مَا شَاءَ اللهُ أَنْ تَكُونَ، ثُمَّ يَرْفَعُهَا إِذَا شَاءَ أَنْ يَرْفَعَهَا، ثُمَّ تَكُونُ خِلَافَةٌ عَلَى مِنْهَاجِ النُّبُوَّةِ، فَتَكُونُ مَا شَاءَ اللهُ أَنْ تَكُونَ، ثُمَّ يَرْفَعُهَا إِذَا شَاءَ اللهُ أَنْ يَرْفَعَهَا، ثُمَّ تَكُونُ مُلْكًا عَاضًّا، فَيَكُونُ مَا شَاءَ اللهُ أَنْ يَكُونَ، ثُمَّ يَرْفَعُهَا إِذَا شَاءَ أَنْ يَرْفَعَهَا، ثُمَّ تَكُونُ مُلْكًا جَبْرِيَّةً، فَتَكُونُ مَا شَاءَ اللهُ أَنْ تَكُونَ، ثُمَّ يَرْفَعُهَا إِذَا شَاءَ أَنْ يَرْفَعَهَا، ثُمَّ تَكُونُ خِلَافَةٌ عَلَى مِنْهَاجِ نُبُوَّةٍ ٠ 

روى الإمام أحمد في المسند

قال محققو المسند:إسناده حسن٠

হুজাইফাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত,তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহুআলাইহি ওয়াসাল্লাম  বলেছেন: তোমাদের মাঝে নুবুওয়াত (নুবুওয়াতের যুগ) থাকবে যতদিন আল্লাহ তায়ালা চান; অতঃপর আল্লাহ যখন ইচ্ছা  তা প্রত্যাহার করবেন। অতঃপর আসবে নুবুওয়াতের আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত খিলাফাহ্। আল্লাহ যতদিন ইচ্ছে তা রাখবেন। এরপর আল্লাহ যখন ইচ্ছে তা প্রত্যাহার করবেন। অতঃপর আসবে রাজতান্ত্রিক শাসন; আল্লাহ যতদিন ইচ্ছে তা রাখবেন। এরপর আল্লাহ যখন ইচ্ছে তা প্রত্যাহার করবেন। অতঃপর আসবে জুলুম-জবরদস্তি শাসন; আল্লাহ যতদিন ইচ্ছে তা রাখবেন। এরপর আল্লাহ যখন ইচ্ছে তা প্রত্যাহার করবেন। অবশেষে আসবে খিলাফাহ্ আলা মিনহাজিন নুবুওয়্যাহ্ তথা নুবুওয়াতের আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত খিলাফাহ্।  

[হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রহঃ) বর্ণনা করেছেন; মুহাক্কিকগণ বলেন: এর সনদ হাসান...]

অন্য হাদীসে এসেছে:

  عن جَابِرَ بْنَ سَمُرَةَ قَالَ سَمِعْتُ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ يَكُونُ اثْنَا عَشَرَ أَمِيرًا فَقَالَ كَلِمَةً لَمْ أَسْمَعْهَا فَقَالَ أَبِي إِنَّهُ قَالَ كُلُّهُمْ مِنْ قُرَيْشٍ٠

জাবির ইবনু সামুরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি যে, বারোজন আমীর হবে। এরপর তিনি একটি কথা বললেন যা আমি শুনতে পাইনি। তবে আমার পিতা বলেছেন যে, তিনি বলেছিলেন সকলেই কুরাইশ গোত্র থেকে হবে। 

[সহীহ্ আল বুখারী:কিতাবুল আহ্‌কাম (كتاب الأحكام); এছাড়াও সহীহ্ মুসলিম, আহমাদ ইত্যাদি]

রাসূলুল্লাহ (সঃ) আরো বলেছেন:

 الخلافة بعدي ثلاثون سنة ، ثم يكون ملكا عضوضا٠

আমার (ইন্তেকালের) পরে ত্রিশ বছর পর্যন্ত খিলাফত থাকবে, তারপর দন্তকর্তিত রাজ্য হয়ে যাবে। 

[এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ), ইমাম আবু দাউদ (রঃ), ইমাম তিরমিযী (রঃ) এবং ইমাম নাসাঈ (রঃ) প্রমুখ বর্ণনা করেছেন।]

খিলাফাহ্ আলা মিনহাজিন নুবুওয়্যাহ্ বা নুবুওয়াতের আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত খিলাফাহর সাথে এসব হাদীসের সম্পর্ক রয়েছে। এসব হাদীস থেকে আমরা  

আমরা নিশ্চিতভাবে জানতে/বুঝতে পারি: 

প্রথমতঃ খিলাফাহ্ আলা মিনহাজিন নুবুওয়্যাহর অন্তর্ভুক্ত হলো খুলাফায়ে রশিদীনের ত্রিশ বছর। আর তা হলো- আবু বাকর (রাঃ), উমার (রাঃ), উসমান (রাঃ) এবং আলী (রাঃ) প্রমুখ সাহাবীগণের শাসনামল। কেননা, সুনির্দিষ্টভাবে এই ৩০ বছরের কথা পূর্বোক্ত হাদীসে এসেছে। 

দ্বিতীয়তঃ এছাড়াও সুনির্দিষ্টভাবে এই উম্মাহর শেষদিকে মুহাম্মাদ ইবনু আবদুল্লাহ আল মাহ্দী এবং ঈসা (আঃ)-এর ব্যাপারে (কাঙ্ক্ষিত ও প্রশংসনীয় ভাষায়) হাদীসে বর্ণিত আছে। সুতরাং এটাও খিলাফাহ্ আলা মিনহাজিন নুবুওয়্যাহর অন্তর্ভুক্ত । 

তৃতীয়তঃ রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উম্মাহর মাঝে বারজন খলীফাহ্ এর অন্তর্ভুক্ত; তবে পূর্বোক্তগণ ছাড়া তাঁদের বাকিগণ অনির্দিষ্ট। তারা কে এবং কোন্ যুগের তা সুনির্দিষ্টভাবে দালীল ছাড়া বলা সম্ভব নয়। কিছু হাদীসের বর্ণনা অনুযায়ী অনেকে ইমাম হাসান ইবনু আলী (রাঃ) এবং উমার ইবনু আব্দিল আযীয (রহঃ)-কেও তাঁদের অন্তর্ভুক্ত মনে করে থাকেন; আর এছাড়া সুনির্দিষ্টভাবে কে খিলাফাহ্ আলা মিনহাজিন নুবুওয়্যাহর অন্তর্ভুক্ত তা নিশ্চিত করে বলার সুযোগ নেই এবং কোন প্রয়োজনও নেই। বরং 

চতুর্থতঃ প্রত্যেকেরই  খিলাফাহ্ আলা মিনহাজিন নুবুওয়্যাহর আদর্শ অনুসরণ করার নিয়্যাত ও প্রচেষ্টা থাকতে হবে। এটাই প্রকৃত কর্তব্য। 

উল্লেখ্য, খিলাফাহ্ আলা মিনহাজিন নুবুওয়াহর প্রথম ও প্রধান অংশ হলো খুলাফাউ রশিদীন। খুলাফাউ রশিদীনের যুগের সকল মানুষের উপর তাঁদের অনুসরণ করা যেমন জরুরি, তেমনি অন্য সকল যুগের মানুষের জন্যই এ খুলাফাউ রশিদীন-এর সুন্নাহর অনুসরণ করা ওয়াজিব। যেমন হাদীসে বর্ণিত আছে, এ দীর্ঘ হাদীসটির শেষাংশ উল্লেখ করছি:  

فَقَالَ الْعِرْبَاضُ: صَلَّى بِنَا رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ذَاتَ يَوْمٍ، ثُمَّ أَقْبَلَ عَلَيْنَا فَوَعَظَنَا مَوْعِظَةً بَلِيغَةً ذَرَفَتْ مِنْهَا الْعُيُونُ وَوَجِلَتْ مِنْهَا الْقُلُوبُ، فَقَالَ قَائِلٌ: يَا رَسُولَ اللَّهِ كَأَنَّ هَذِهِ مَوْعِظَةُ مُوَدِّعٍ، فَمَاذَا تَعْهَدُ إِلَيْنَا؟ فَقَالَ أُوصِيكُمْ بِتَقْوَى اللَّهِ وَالسَّمْعِ وَالطَّاعَةِ، وَإِنْ عَبْدًا حَبَشِيًّا، فَإِنَّهُ مَنْ يَعِشْ مِنْكُمْ بَعْدِي فَسَيَرَى اخْتِلَافًا كَثِيرًا، فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِي وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الْمَهْدِيِّينَ الرَّاشِدِينَ، تَمَسَّكُوا بِهَا وَعَضُّوا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ، وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الْأُمُورِ، فَإِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ، وَكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلَالَةٌ٠ صحيح

আল-ইরবাদ (রাঃ) বললেন, একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে সঙ্গে নিয়ে সালাত আদায় করলেন, অতঃপর আমাদের দিকে ফিরে আমাদের উদ্দেশ্য জ্বালাময়ী ভাষণ দিলেন, তাতে চোখগুলো অশ্রুসিক্ত হলো এবং অন্তরগুলো বিগলিত হলো।

তখন এক ব্যক্তি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! এ যেন কারো বিদায়ী ভাষণ! অতএব আপনি আমাদেরকে কি নির্দেশ দেন? তিনি বলেন: আমি তোমাদেরকে আল্লাহভীতির, শ্রবণ ও আনুগত্যের উপদেশ দিচ্ছি, যদিও সে (আমীর) একজন হাবশী গোলাম হয়। কারণ তোমাদের মধ্যে যারা আমার পরে জীবিত থাকবে তারা অচিরেই প্রচুর মতবিরোধ দেখবে। তখন তোমরা অবশ্যই আমার সুন্নাত এবং আমার হিদায়াতপ্রাপ্ত খলীফাহগণের সুন্নাত অনুসরণ করবে, তা দাঁত দিয়ে কামড়ে আঁকড়ে থাকবে। সাবধান! (দীনে) প্রতিটি নব আবিষ্কার সম্পর্কে! কারণ প্রতিটি নব আবিষ্কার হলো বিদআহ এবং প্রতিটি বিদআত হলো ভ্রষ্টতা। 

[হাদীসটি সহীহ্। আবু দাউদ:কিতাবুস সুন্নাহ্

 (كتاب السنة:بَابٌ فِي لُزُومِ السُّنَّةِ), 

এছাড়াও হাদীসটি তিরমিযী, আহমাদ ইত্যাদি কিতাবে বর্ণিত আছে।]

খলীফাতুল্লাহ্ (خليفة الله)

 বা আল্লাহর খলীফাহ্ বলা যা কি?

সাধারণত কোন খলীফাহকে আল্লাহর খলীফাহ্ বলা হয় না বা বলা যায় না। যেমন, এ উম্মাহর সর্বপ্রথম খলীফাহকে খলীফাতুর রসূল বা রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর খলীফাহ্ বলা হতো। তারপর উমার (রাঃ)-কে খলীফাতুল মুসলিমীন বা আমীরুল মুমিনীন বলা হয়েছে।  এরপর পরবর্তী খলীফাহ্গণকে খলীফাতুল মুসলিমীন বা আমীরুল মুমিনীন এবং এছাড়াও আরো বিভিন্ন উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে, যেমন: মালিক, সুলতান ...ইত্যাদি। 

তবে একটি হাদীসে মাহদীকে খলীফাতুল্লাহ্ বলা হয়েছে, তবে হাদীসটি (সনদ) শক্তিশালী নয়:

عَنْ ثَوْبَانَ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ ـ صلى الله عليه وسلم ـ ‏"‏ يَقْتَتِلُ عِنْدَ كَنْزِكُمْ ثَلاَثَةٌ كُلُّهُمُ ابْنُ خَلِيفَةٍ ثُمَّ لاَ يَصِيرُ إِلَى وَاحِدٍ مِنْهُمْ ثُمَّ تَطْلُعُ الرَّايَاتُ السُّودُ مِنْ قِبَلِ الْمَشْرِقِ فَيَقْتُلُونَكُمْ قَتْلاً لَمْ يُقْتَلْهُ قَوْمٌ ‏"‏ ‏.‏ ثُمَّ ذَكَرَ شَيْئًا لاَ أَحْفَظُهُ فَقَالَ ‏"‏ فَإِذَا رَأَيْتُمُوهُ فَبَايِعُوهُ وَلَوْ حَبْوًا عَلَى الثَّلْجِ فَإِنَّهُ خَلِيفَةُ اللَّهِ الْمَهْدِيُّ ‏"‏ ‏.‏

সাওবান (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: তোমাদের একটি খনিজ সম্পদের নিকট পরপর তিনজন খলীফার পুত্র নিহত হবে। তাদের কেউ সেই খনিজ সম্পদ দখল করতে পারবে না। অতঃপর প্রাচ্যদেশ থেকে কালো পতাকা উড্ডীন করা হবে। তারা তোমাদেরকে এত ব্যাপকভাবে হত্যা করবে যে, ইতোপূর্বে কোন জাতি তদ্রূপ করেনি। অতঃপর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও কিছু বলেছেন, যা আমার মনে নেই। তিনি আরো বলেন: তাকে আত্মপ্রকাশ করতে দেখলে তোমরা বরফের উপর হামাগুড়ি দিয়ে হলেও তার সাথে যোগদান করো। কারণ সে আল্লাহর খলীফা মাহ্দী।

[ইবনু মাজাহ : কিতাবুল ফিতান। 

অনেক ইমাম এ হাদীসের সনদকে দ্বঈফ (যঈফ) বলেছেন, আবার কোন কোন ইমাম সহীহও বলেছেন। শাইখ আলবানীও (রহঃ) যঈফ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।]

উল্লেখ্য, এ হাদীসটি সহীহ্ হলে শুধু মাহদী (আঃ)-এর ক্ষেত্রেই 'আল্লাহর খলীফাহ্' শব্দটি প্রযোজ্য হবে। (যেহেতু তিনি অন্য খলীফাহদের মতো জনগণের মাশওয়ারাহর মাধ্যমে মনোনীত হবেন না। বরং তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকেই মনোনীত, যা আমরা আবু দাউদে বর্ণিত হাদীস দ্বারা জানতে পারি।) 

আর যদি 'আল্লাহর খলীফাহ্' সংক্রান্ত উপরে বর্ণিত হাদীসটি সহীহ্ না হয় তবে আর কিছু না বললেও চলবে, ইনশাআল্লাহ। 

আল্লাহ তায়ালার অনুগ্রহে খিলাফাহ্ সম্পর্কে কিছুটা বিস্তারিত এবং খলীফাহ্ ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করলাম, যেহেতু এসব বিষয়ে পৃথকভাবে/অন্যত্র আলোচনা করেছি। আগ্রহী ভাইগণ তা দেখে নিতে পারেন, ইনশাআল্লাহ। 

প্রবন্ধের সারকথা:

আলহামদুলিল্লাহ, 

খিলাফাহ্ ও খলীফাহ্ শীর্ষক প্রবন্ধের এ পর্যায়ে আমরা আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তুর অতি সংক্ষিপ্ত রূপ উপস্থাপন করছি,

এক নজরে খিলাফাহ্ ও খলীফাহ্:

# খিলাফাহ্ অর্থ: প্রতিনিধিত্ব, শাসন-কর্তৃত্ব, রাজত্ব, নেতৃত্ব, ক্ষমতা ইত্যাদি। আর খলীফাহ্ অর্থ: স্থলাভিষিক্ত, প্রতিনিধি, শাসক, আমীর, নেতা ইত্যাদি। 

# আল্লাহর পক্ষ থেকে খিলাফাহর ওয়াদা সম্বলিত আয়াত (২৪:৫৫) নাযিল হয়  মাদীনায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কয়েক বছর পর এবং তা চলমান থাকাবস্থায়।  

# আল্লাহ তায়ালা যে (২৪:৫৫) আয়াতের মাধ্যমে মুমিনদেরকে খিলাফাহর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, এতেই প্রমাণিত হয় যে, মাদীনাহ্ ইসলামী রাষ্ট্র বা ইমারাহ (এবং ভবিষ্যৎ খিলাফাহর কেন্দ্র) হলেও তখনও তা (আয়াতে বর্ণিত কাঙ্ক্ষিত) খিলাফাহ্ ছিল না, বিধায় তার ওয়াদা সম্বলিত আয়াত নাযিল হয়েছে।  

# আল্লাহর পক্ষ থেকে 'খিলাফাহ্ ফিল আরদ'-এর ওয়াদা করা হয়েছে; অর্থাৎ, পৃথিবীতে বা জমিনের শাসন-ক্ষমতা-কর্তৃত্ব দানের ওয়াদা করা হয়েছে। সাথে সাথে আল্লাহর মনোনীত দীন প্রতিষ্ঠা ও নিরাপত্তার ওয়াদা করা হয়েছে। যদিও তখন মাদীনায় উক্ত তিনটি বিষয়ই ছিল, তবে তখনও তা আয়াতে উল্লিখিত ওয়াদার (কাঙ্ক্ষিত) মানে ছিল না; বিধায় আল্লাহ তায়ালা তখন এগুলোর ওয়াদা করেছেন।  

# মনে রাখতে হবে, 'আরদ' শব্দ দ্বারা পৃথিবী, ভূমি ইত্যাদি বুঝায়, এবং কম বা বেশি বড় বা ছোট ভূমি, জমি, এলাকা, অঞল, দেশ, রাষ্ট্র ইত্যাদি সবই বুঝায়। 

# কিন্তু এই আয়াতে 'আরদ' শব্দ দ্বারা নিছক একখণ্ড জমি বা যে কোন ধরণের কোন দেশ বা ভূমি বুঝানো হয়নি। যদি এরূপ বুঝাতো তবে ঐ সময়ের মাদীনাহ্কেই  বুঝাতো, কেননা তখন মাদীনাহ্ দুর্বল হলেও একটি ইসলামী ভূমি বা রাষ্ট্র ছিল। কিন্তু তার প্রভাব, কর্তৃত্ব উল্লেখযোগ্য মানের ছিল না।         

# অর্থাৎ শুরুতে/তখনও মাদীনাহ্ একটি রাষ্ট্র হলেও কাঙ্ক্ষিত মানের খিলাফাহর প্রভাব-কর্তৃত্ব-নিরাপত্তা তখনও প্রতিষ্ঠিত হয়নি, আর কেউ তা দাবিও করেননি। বরং পূর্বোক্ত আলোচনা থেকে জানা যায়, তখনও সাহাবীগণ (রাঃ) এসব বিষয়ের আকাঙ্ক্ষা করতেন। উক্ত আয়াত নাযিলের প্রেক্ষাপট এটা।  

# তখন বৈশ্বিক শক্তির তুলনায় এমনকি আঞ্চলিক শক্তির তুলনায় মাদীনাহ্ ছিল ছোট ও দুর্বল রাষ্ট্র এবং অন্য শক্তিগুলোর তুলনায় মাদীনাহর নিরাপত্তাও ছিল দুর্বল। 

# আল্লাহ তায়ালার সাহায্যে মাদীনাহ্ ধীরে ধীরে শক্তিশালী হতে থাকে, একপর্যায়ে আঞ্চলিক বড় শক্তি মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে মাদীনাহ্ আঞ্চলিক বড় শক্তি হয়ে উঠে। 

# এরপর তা চতুর্দিকে বিস্তৃত ও শক্তিশালী হতে থাকে, 

# অবশেষে রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবনের শেষদিকে তৎকালীন বৈশ্বিক শক্তি বা পরাশক্তিদ্বয় রোম ও পারস্যের সীমান্ত অঞ্চলেও মাদীনাহর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।

# ঐ সময় উক্ত পরাশক্তিদ্বয় তাদের সীমান্ত অতিক্রম করে মাদীনাহ্কে আক্রমণ করার সাহস পায়নি।  

অপরপক্ষে (রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবনের শেষদিকে) নতুন বিশ্বশক্তি মাদীনাহ্ ঐ পরাশক্তিদ্বয়ের সাথে পাল্লা দেয়ার যোগ্যতা অর্জন করে। ফলে রোম ও পারস্যের সীমান্তের কিছু অঞ্চলেও মাদীনার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত/বিস্তৃত হতে থাকে।  

# বস্তুতঃ আল্লাহর ওয়াদাকৃত খিলাফাহর প্রথম বাস্তব রূপ প্রকাশিত/প্রতিষ্ঠিত হয়েছে রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবনের শেষদিকে।

# তৎকালীন বৈশ্বিক বৃহৎ শক্তির সাথে পাল্লা দিতে সক্ষম এরূপ উল্লেখযোগ্য যে শাসন-কর্তৃত্ব রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সময় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো, তাকেই আল্লাহর প্রতিশ্রুত খিলাফাহর প্রথম বাস্তব রূপ হিসেবে উক্ত আয়াতের তাফসীরে উল্লেখ করা হয়েছে।

# এটিই ছিল আল্লাহর প্রতিশ্রুত খিলাফাহর বাস্তব রূপের প্রথমাংশ।

# এরপর রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহুআলাইহি  ওয়াসাল্লাম বিদায় নিলে তাঁর স্থলাভিষিক্ত তথা খলীফাহ্ মনোনীত হন তাঁরই সাথী আবু বাকর (রাঃ)।

# তখন থেকে উক্ত খিলাফাহ্ পর্যায়ক্রমে আরো বড়, বিস্তৃত ও শক্তিশালী হতে থাকে। 

উল্লেখ্য, এ সময় (রসূল স. এর মৃত্যুর পর) আরব উপদ্বীপের অনেক এলাকার (বিশেষত নও মুসলিমদের মধ্যে) ব্যাপকভাবে দীন ত্যাগের প্রবণতা দেখা দেয়, তবে তারা সবাই এক অঞ্চলে একত্রে সংগঠিত ছিল না, বরং তা ছিল বিক্ষিপ্ত বিদ্রোহ; আল্লাহর দয়ায় আবু বাকর (রাঃ) এবং সাহাবীগণ (রাঃ) দৃঢ়ভাবে এই (অভ্যন্তরীণ) বিদ্রোহ দমন করে কয়েক মাসের মধ্যেই পরিস্থিতি পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন।

# একই সাথে রোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে জিহাদী অভিযান পরিচালিত হচ্ছিল, যদিও তখন মুরতাদ গোষ্ঠীর উত্থান হচ্ছিল। তবুও এ অভিযান পরিচালিত হয়।

কেননা, মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে রসূল (সঃ) রোমানদের বিরুদ্ধে উসামা (রাঃ)-এর নেতৃত্বে একটি বাহিনী প্রেরণ করেছিলেন, তাঁর মৃত্যুর পর আবু বাকর (রাঃ)ও ঐ বাহিনীর অভিযান বহাল রাখেন, আল্লাহর রহমাতে তাঁরা এ অভিযানের কাঙ্ক্ষিত সফলতা অর্জন করেন।

# এরপর থেকেই দুই বিশ্বশক্তি রোম ও পারস্যের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক জিহাদ শুরু হয়, এবং এর ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকে। 

# এরপর উমার (রাঃ)-এর খিলাফাহর সময় রোমান ও পারস্য সাম্রাজ্য বিজিত হয়। এর মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী শুধু ইসলামী খিলাফাহ্ই একমাত্র বৈশ্বিক শক্তি হিসেবে দৃশ্যমান হয়। 

# এরপর উসমান (রাঃ)-এর খিলাফাহর সময় তা আরো বিস্তৃত হয়।

# শত শত বছর পৃথিবীর উল্লেখযোগ্য অঞ্চলে এ খিলাফাহর কর্তৃত্ব (কমবেশি) অব্যাহত ছিল। 

# তারপর পর্যায়ক্রমে তা দুর্বল হতে থাকে এবং এক পর্যায়ে বিলীন/বিলুপ্ত হয়।

# এখন খিলাফাহ্শূন্য পৃথিবীতে খিলাফাহ্ অর্জন না করেই তা দাবি করার অর্থ হলো নিজেদের অজ্ঞতা ও ক্ষুদ্র স্বার্থচিন্তার প্রকাশ ঘটানো; বিধায়- 

# ঐসব বাজে চিন্তা ও কর্মকাণ্ড বাদ দিয়ে কাঙ্ক্ষিত খিলাফাহ্ অর্জনের জন্য পৃথিবীর উল্লেখযোগ্য কর্তৃত্ব অর্জনের প্রচেষ্টাকে আরো ঐক্যবদ্ধ ও জোরালো করতে হবে।

# এভাবে যখন বর্তমান পৃথিবীর পরাশক্তি বা বৃহৎ শক্তিগুলোর সাথে পাল্লা দেয়ার মতো শক্তিশালী ইসলামী ইমারাহ্ প্রতিষ্ঠিত হবে, তখন আর কাল্পনিক খিলাফাহর ঘোষণা দিতে হবে না। বরং প্রকৃত খিলাফাহ্ তথা এর ক্ষমতা দৃশ্যমান হবে এবং এর বৈশ্বিক শক্তি ও শাসন কর্তৃত্ব যথাযথ প্রয়োগ করা হবে, ইনশাআল্লাহ। 

# যখন খিলাফাহ্ প্রতিষ্ঠিত ছিল তখন তা বুঝানোর জন্য মানুষকে খিলাফাহর স্বরূপ সম্পর্কে পৃথক বা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করার প্রয়োজন ছিল না, যা বর্তমানে খিলাফাহ্ বিহীন সময়ে বিস্তারিত বর্ণনা করার প্রয়োজন হয়েছে।  

# প্রকৃতপক্ষে যখন উল্লেখযোগ্য ইমারাহ্ বা  কর্তৃত্ব তথা খিলাফাহ্ প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় তখন দাবি করার কোন প্রয়োজনই নেই। বাস্তব রূপ ও আমলই যথেষ্ট। বরং এরূপ অবাস্তব দাবি তারাই করে থাকে যাদের বাস্তবে এরূপ ক্ষমতা অর্জিত হয়নি।

# শারীআহ্তে খিলাফাহ্ অর্জনের জন্য সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা করার তাগিদ রয়েছে, কিন্তু খিলাফাহ্ ঘোষণা করতে বলা হয়নি। আর এটা ঘোষণার বিষয় নয়।

# হ্যাঁ, যখন বাস্তবেই খিলাফাহ্ প্রতিষ্ঠিত হবে তখন/তারপর খলীফাহ্ মনোনীত ও ঘোষণা করা হবে। তবে এটা কারো বিচ্ছিন্ন ঘোষণার মাধ্যমে হবে না। বরং তা অবশ্যই শারঈ নিয়ম-বিধান-প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন হবে। অন্যথায় তা গ্রহণযোগ্য হবে না। 

# এমন যেন না হয়, খিলাফাহ্ প্রতিষ্ঠা বা অর্জনের খবর নাই, কেউ খলীফাহ্ দাবি করে বসে কিংবা কিছু লোক একজনকে খলীফাহ্ ঘোষণা দিতে থাকে! আর কিছু লোক আবেগে তার/তাদের অনুসরণ করতে থাকে!! এ নিয়ে দলাদলি বা উম্মাহর মাঝে বিবাদ বাড়তে থাকে!!!... অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে যথাযথ ইলমের অনুসরণ করতে হবে। 

# খিলাফাহ্ প্রতিষ্ঠিত/অর্জিত হওয়ার পর খলীফাহ্ মনোনীত/ঘোষণা করা সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট শারঈ বিষয়সমূহ স্মরণ রাখতে হবে:

# প্রথমতঃ যার নেতৃত্বে খিলাফাহ্ অর্জিত হবে অর্থাৎ যখন খিলাফাহ্ প্রতিষ্ঠিত হবে তখন যিনি মুজাহিদীনের আমীর থাকবেন তিনিই স্বাভাবিক বা অনিবার্যভাবে উক্ত (খলীফাহর) দায়িত্ব পালনের জন্য অধিকতর যোগ্য। 

# এরপরও যদি তিনি নতুন কাউকে খলীফাহ্ মনোনীত করতে চান নিয়ম অনুযায়ী করতে পারেন। তখন কিংবা তার মৃত্যুর পরই কেবল নতুন খলীফাহ্ মনোনীত করার প্রসঙ্গ আসবে এবং নতুন খলীফাহ্ মনোনীত করতে হবে।   

# খলীফাহ্ মনোনীত করার জন্য শারীআহতে নির্ধারিত যোগ্যতা/অযোগ্যতা বিবেচনা করা যেমন জরুরি তেমনি জরুরি বিষয় হলো খলীফাহ্ মনোনীত করার যথাযথ  উপায় ও প্রক্রিয়া অবলম্বন করা।

# প্রথমতঃ মুকাল্লাফ বা শারঈ বিধান পালনে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তির জন্য নির্দিষ্ট যোগ্যতা বা গুণাবলী আছে এমন ব্যক্তিকে বাছাই করতে  হবে। যেমন: মুসলিম, পুরুষ, বালিগ বা প্রাপ্তবয়স্ক, বিবেকবান, স্বাধীন... ইত্যাদি। 

# দ্বিতীয়তঃ খলীফাহ্ হিসেবে কিংবা মুসলিমদের দায়িত্ব পালনে অন্যান্য বিশেষ যোগ্যতাও থাকতে হবে। যেমন, আদিল বা ন্যায়নিষ্ঠ, আলিম/মুজতাহিদ, সংশ্লিষ্ট দায়িত্ব বা রাষ্ট্র ও যুদ্ধ পরিচালনায় দক্ষ, দীনে অগ্রগামী বা অভিজ্ঞ... ইত্যাদি। 

# এসব বিষয়ে অনেকে সমান হলে (উক্ত সকল যোগ্যতাসহ) কুরাইশী ব্যক্তিকে অগ্রাধিকার দেয়া হবে।

# শুধু এরূপ যোগ্যতা থাকলেই হবে না। বরং সংশ্লিষ্ট সকল যোগ্যতায় উত্তীর্ণ ব্যক্তিকে যথাযথ নিয়ম ও প্রক্রিয়া অবলম্বন করে মনোনীত করতে হবে। 

# খিলাফাহর কেন্দ্র থেকে খলীফাহ্ মনোনীত হতে হবে,

# কেন্দ্র থেকে যে কেউ খলীফাহ্ নির্ধারণ বা ঘোষণা করলেই হবে না বরং খিলাফাহ্ বা কেন্দ্রের কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ কর্তৃক খলীফাহ্ মনোনীত হতে হবে, আর এই কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষকে 'আহলুল হাল্লি ওয়াল আকদ' বলা হয়। অনিবার্যভাবে তাঁরাই দীনে অগ্রগামী এবং উম্মাহর অনুসরণীয় ব্যক্তিবর্গ। 

# তাদেরকে বা তাদের সিদ্ধান্তকে পুরো উম্মাহ্ মেনে চলে। কেননা, তারা উম্মাহর প্রবীণ, অভিজ্ঞ ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ এবং উম্মাহর প্রকৃত প্রতিনিধি। 

# মুসলিমদের সাথে তথা মুসলিমদের পক্ষ থেকে আহলুল হাল্লি ওয়াল আকদ-এর কার্যকর মাশওয়ারা হতে হবে এবং একজনের বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হতে হবে।

# উম্মাহর/আহলুশ শুরার প্রায় সবাই বা অধিকাংশ কারো বিষয়ে একমত হওয়ার পর (ব্যতিক্রম) এক/দুজন দ্বিমত পোষণ করলেও প্রায় সকলের/অধিকাংশের ঐকমত্য অনুযায়ী তার খলীফাহ্ হতে বাধা নেই, তবে আহলুশ শুরার কেউ প্রথমে ভিন্নমত পোষণ করলেও অধিকাংশ আহলুশ শুরার সাথে তিনি/তারাও একমতাবলম্বী হবেন, যেভাবে আনসার সাহাবীগণের কেউ কেউ প্রথমে ভিন্নমত পোষণকরলেও পরে তারা আবু বাকর (রাঃ)-কে খলীফাহ্ মনোনীত করার ব্যাপারে ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন।   

✅ আহলুল হাল্লি ওয়াল আকদ/আহলুশ শুরাই যথাযথ প্রক্রিয়ায় খলীফাহ্ মনোনীত করবেন এবং তারা প্রথম বাইয়াহ প্রদান করবেন বা অঙ্গীকারাবদ্ধ হবেন   

✅ আবু বাকর, উমার, উসমান...(রাঃ) যেভাবে খলীফাহ্ মনোনীত হয়েছেন তা সমন্বিতভাবে অনুসরণীয়। 

✅ এক্ষেত্রেও শারঈ নীতির পরিপূর্ণ অনুসরণ করতে হবে।

✅ স্মরণীয় যে, খলীফাহ্ মনোনীত করার এ পুরো প্রক্রিয়া অবলম্বন করতে হবে প্রকৃত খিলাফাহ্ অর্জিত/প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এবং নতুন খলীফাহ্ মনোনীত করার সময়। এর আগে খিলাফাহ্ ঘোষণা এবং খলীফাহ্ মনোনীত করার কোন ব্যাপার নেই। 

✅ যদি শারঈ নিয়ম অনুযায়ী নতুন খলীফাহ্ বৈধভাবে মনোনীত হন তবে তার বাইয়াহ্ ওআনুগত্য করা ওয়াজিব। 

✅ আর যদি শারঈ নিয়ম অনুযায়ী বৈধভাবে খলীফাহ্ মনোনীত না হন তবে তার বাইয়াহ্ ও আনুগত্য করা বা না করার উভয় সুযোগ শারীআহতে আছে। যদি তাকে সরিয়ে নতুন কাউকে শারঈ নিয়ম অনুযায়ী বৈধভাবে মনোনীত করার সুযোগ ও সক্ষমতা থাকে এবং উম্মাহর মাঝে ব্যাপক রক্তপাত ছাড়াই তা করা যায় তবে উম্মাহর বৃহৎ স্বার্থে তা করা উত্তম। আর এর বিপরীত অবস্থা হলে উম্মাহর বৃহৎ স্বার্থে তখন তা না করাই উত্তম।

✅ যতক্ষণ পর্যন্ত খলীফাহ্ কিতাবুল্লাহ্ ও সুন্নাহ্ অনুযায়ী খিলাফাহ্ পরিচালনা করছেন ততক্ষণ পর্যন্ত তার আনুগত্য করতে হবে। তবে কোন অবৈধ-অন্যায় আদেশ মানা যাবে না। তবে এরূপ কোন অবৈধ-অন্যায় আদেশ দিলেও তাকে খলীফাহ হিসেবে মানতে হবে, শুধু ঐসব অবৈধ-অন্যায় আদেশের আনুগত্য ছাড়া। শুধু এ কারণেই তাকে পদচ্যুত করা যাবে না। বরং    

✅ খলীফাহ্ যদি সামগ্রিক/সাধারণভাবে কিতাবুল্লাহ্ ও সুন্নাহ্ অনুযায়ী খিলাফাহ্ পরিচালনা না করে বা 'কুফরুন বাওয়াহ্' বা সুস্পষ্ট কুফরে লিপ্ত হয় এবং অবিলম্বে সংশোধন না করে তবে তাকে পদচ্যুত করতে হবে বা এ জন্য তার বিরুদ্ধে কিতাল করতে হবে।  

✅ প্রকৃত খিলাফাহ্ ও বৈধ খলীফাহ্ মনোনীত হওয়ার পর তার অধীনস্থদের উপরই (তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত আছে বিধায়) তার বাইয়াহ্ ও আনুগত্যের কর্তব্য প্রযোজ্য হবে।

✅ তার অধীনস্থের বাইরেও অনেক মুসলিম থাকতে পারে। তারা যদি খিলাফাহ্ অধ্যুষিত ভূমিতে আগমন করতে না পারে কিংবা খলীফাহর পক্ষ থেকে উক্ত এলাকা দখলের মাধ্যমে তাদেরকে খিলাফাহ্/খলীফাহর কর্তৃত্বের অন্তর্ভুক্ত করতে না পারেন তবে তাদের উপর খলীফাহর (কর্তৃত্বের অন্তর্ভুক্ত নাগরিকদের মতো) বাইয়াহ্ ও আনুগত্য প্রযোজ্য হবে না। 

তবে তারা তাদের এলাকার/পার্শ্ববর্তী মুমিন-মুজাহিদগণের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দীনী আমল বাস্তবায়নে সদা সচেষ্ট থাকবেন।  

✅ আর উভয় দিক থেকেই এরূপ ভূমিকে খিলাফাহ্/খলীফাহর কর্তৃত্বের অন্তর্ভুক্ত করার প্রচেষ্টা ত্বরান্বিত করতে হবে। অবশ্য এক্ষেত্রে মূল ভূমিকা রাখার দায়িত্ব খলীফাহর উপরই বর্তায়।

✅ অবশ্য এসব বিচ্ছিন্ন মুসলিমদের দায়িত্ব হলো প্রকৃত খিলাফাহ্ ও বৈধ খলীফাহর বিষয়টি মাথায় রেখে কাজ করা এবং যথাসম্ভব তার সাহায্য ও সহায়তা নিয়ে দীনী দায়িত্ব পালন অব্যাহত রাখা। কেননা, এসব বিচ্ছিন্ন অঞ্চল বা ভূমিতে যখনই ইসলামী শারীআহ্ প্রতিষ্ঠিত হবে তখনই তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে উক্ত (পূর্বে প্রতিষ্ঠিত) ইসলামী খিলাফাহ্/বৈশ্বিক ইসলামী রাষ্ট্র/ইসলামী ইমারাহর অন্তর্ভুক্ত হিসেবেই গণ্য হবে।

✅ দীনের সকল বিষয়ের মতো এসব বিষয়েও ইলম অর্জন করা এবং দীনের প্রকৃত অনুসরণে সচেষ্ট হওয়া জরুরি । 

আল্লাহ তায়ালা নিম্নোক্ত বাণী সদা স্মরণ রাখা জরুরি:

 یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اَطِیۡعُوا اللّٰهَ وَ اَطِیۡعُوا الرَّسُوۡلَ وَ اُولِی الۡاَمۡرِ مِنۡکُمۡ ۚ فَاِنۡ تَنَازَعۡتُمۡ فِیۡ شَیۡءٍ فَرُدُّوۡهُ اِلَی اللّٰهِ وَ الرَّسُوۡلِ اِنۡ کُنۡتُمۡ تُؤۡمِنُوۡنَ بِاللّٰهِ وَ الۡیَوۡمِ الۡاٰخِرِ ؕ ذٰلِکَ خَیۡرٌ وَّ اَحۡسَنُ تَاۡوِیۡلًا ٠

হে মুমিনগণ, তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর ও আনুগত্য কর রাসূলের এবং যারা তোমাদের মধ্যে উলুল আমর (তথা কর্তৃত্বের অধিকারী ও আলিমদের)। অতঃপর কোন বিষয়ে যদি তোমরা মতবিরোধ কর তাহলে তা আল্লাহ ও রসূলের কাছে অর্পণ কর - যদি তোমরা আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি ঈমান রাখ। এটিই উত্তম এবং পরিণামে উৎকৃষ্টতর।

[সূরাহ আন নিসা:৫৯]  

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআলা আরো বলেন:

 یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اَطِیۡعُوا اللّٰهَ وَ اَطِیۡعُوا الرَّسُوۡلَ وَ لَا تُبۡطِلُوۡۤا اَعۡمَالَکُمۡ ٠

হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর এবং রাসূলের আনুগত্য কর। আর (তা না করে) তোমরা তোমাদের আমলসমূহ বিনষ্ট করো না। 

[সূরাহ মুহাম্মাদ:৩৩]

            

আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে সকল অন্যায় থেকে হিফাজত করুন, এবং যথাযথ ইলম ও আমলের তাওফীক দান করুন।      

আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে তাঁর দীনের (সহীহ্) ইলম অর্জন ও যথাযথ সৎআমল সম্পাদন করার তাওফীক দান করুন। 

ربنا اغفرلنا ولاخواننا الذين سبقونا بالايمان

   ولا تجعل في قلوبنا غلا للذين امنوا 

       ¤ ربنا انك رءوف الرحيم

 ربنا اغفرلنا ذنوبنا واسرافنا في امرنا وثبت 

   ¤ اقدامنا وانصرنا علي القوم الكافرين

 سبحانك اللهم وبحمدك اشهد ان لا اله الا

     - انت استغفرك و اتوب اليك