আমরা একত্রিত হব একটি মাত্র লক্ষ্য নিয়ে, একই আকীদার ভিত্তিতে এবং একই বুদ্ধিবৃত্তিক পতাকাতলে। 

জামাত-সংক্রান্ত আমাদের আলোচনায় আমরা দেখিয়েছি যে, শরীয়ত অনুযায়ী পরিচালিত একটি সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টা ছাড়া আমাদের লক্ষ্য অর্জন অসম্ভব। আরো উল্লেখ করা হয়েছে যে, ইসলামের অনেক বিধান দলবদ্ধ না হয়ে একাকী আদায় করা অসম্ভব শরীয়ত বলে, একটি ফরয পালনের জন্য যে উপায়-উপকরণ অপরিহার্য, সেটি অর্জন করাও ফরয। আমাদের আদেশ করা হয়েছে ভালো কাজ, তাকওয়া ও আল্লাহর রজ্জু ধরার ক্ষেত্রে একে অপরকে সাহায্য করার জন্য। আমরা আরো দেখিয়েছি যে, দলবদ্ধ হয়ে কাজ করা ফরযে আইন, যা একজন মুসলিমও অবহেলা করতে পারবে না।

অতএব, সম্মিলিত প্রচেষ্টা হলো ইসলামি আন্দোলনের একটি জরুরি ভিত্তি। এর ফলে শক্তি বজায় থাকে। অন্যথায় ছাড়া ছাড়া হয়ে এলমেলো কাজ করলে আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়ে। কিন্তু এটাও ভাবতে হবে যে, যেমন তেমন একটা দল গড়ে তুললেই লক্ষ্য অর্জন হবে কি না। অন্য কথায় বললে, দল গঠনের এমন কোনো পদ্ধতি কি আছে,যেভাবে দল গড়লে উল্টো দুর্বলতাই বৃদ্ধি পাবে? মুসলিমদের এমন কোনো ফিরকা কি আছে, যাদেরকে বর্জন করাটাই আখেরে অধিক কল্যাণকর? 

প্রশংসনীয় সম্মিলিত প্রচেষ্টা হলো সেগুলো, যার ফলে হালাল মাধ্যম ব্যবহার করে জামাতের লক্ষ্য পূরণে সহায়তা হয়। কিন্তু যদি কোনো ব্যক্তি বা দলের সাথে জোট করার কারণে কাজ পিছিয়ে যায়, আল্লাহর সাহায্য আসা বন্ধ হয়ে যায়, তা হলে এই ধরনের সম্মেলন নিন্দনীয়। 

শরীয়তের আমাদের যেমন দলবদ্ধ হয়ে কাজ করার নির্দেশ দেয়, তেমনি কাদের সাথে হতে হবে আর কাদের সাথে হওয়া যাবে না বিষয়েও নির্দেশ দেয়। আমাদের মধ্যমপন্থা অবলম্বন করতে হবে। কোনো চরমপন্থার  দিকে যাওয়া যাবে না। এলোপাথাড়ি যার তার সাথে হাত মেলালেই হবে না। আবার একটু থেকে একটু 'ভুলের কারণেই কারে সাথে হাত মেলানো ত্যাগ করা যাবে না। অতি গ্রহণশীলতাও ঠিক নয়, অতি বর্জনশীলতাও ঠিক নয়। কোনটি গ্রহণ করতে হবে, আর কোনটি বর্জন করতে হবে- তা ঠিক ঠিকভাবে বুঝে নেওয়া আমাদের কর্তব্য। 

শরীয়তের বিধিনিষেধ, উম্মাহর অতীত-বর্তমানের বিভিন্ন ইসলামি আন্দোলনের ইতিহাস, আমাদের নিজেদের অভিজ্ঞতা, চারপাশের বাস্তবতা দেখে আমরা তিনটি স্পষ্ট সিদ্ধান্তে আসতে পারি। গ্রহণযোগ্য ঐক্যের বৈশিষ্ট্য হলো:

১। লক্ষ্যের ঐক্য

২। আকীদার ঐক্য

৩। আল্লাহ্‌ তাআলার দ্বীনের বুঝের ঐক্য

এই তিনটি শর্ত পূরণ হয়ে গেলে মত ও পদ্ধতির ভিন্নতা কোনো সমস্যা করবে না৷ এই তিনটি বিষয় ছাড়া অন্য বিষয়ে মতভেদ হতেই পারে। সেগুলো পথে কোনো বাধা নয়। কিন্ত এই তিনটি বিষয়ে মতপার্থক্য থাকলে কোনো ঐক্য হতে পারে না। শাখাগত ও ফিকহি মাসয়ালায় মতপার্থক্য থাকলে অসুবিধে নেই। আমাদের সালাফগণ কয়েক শতাব্দী ধরে অনেক ফিকহি মাসয়ালায় মতপার্থক্য করেছেন। হারাম মাসগুলোতে যুদ্ধ করা জায়েয কি না এ নিয়ে ফকীহগণ মতভেদ করেছেন। কেউ বলেন সুধুমাত্র ইহুদী, নাসারা ও মাজুসীদের থেকেই জিযিয়া নেওয়া যাবে। কেউ বলেন জাযিরাতুল আরবের বাইরে অবস্থানকারী পৌত্তলিক ও অন্যান্য কাফিরদের থেকেও জিযিয়া গ্রহণ করা যাবে এমন বৈচিত্র্যের আরো অসংখ্য উদাহরণ আছে। যেমন : কত দূরত্ব গেলে সালাত কসর করতে হবে, বিসমিল্লাহ সশব্দে পড়তে হবে নাকি নিঃশব্দে ইত্যাদি। 

যেসব মতভেদকে আলিমগণ বলেন “ইখতিলাফুত তানাউয়ু', সেগুলো একই জামাতের সদস্যদের মধ্যেও থাকতে পারে। পক্ষাস্তরে, জামাতের সাধারণ কর্মনীতির যেসব বিষয় শরীয়তের বিপরীত নয় এবং সঠিক, সেগুলো সকল সদস্য মেনে চলতে বাধ্য থাকবে। 

কিন্তু যেসব মতপার্থক্য আবার 'ইখতিলাফ তাদ্বাদ', তা হলে দুই পক্ষের যে-কোনো একটির সাথে ঐক্য জায়েয হবে না। ভুল দলটিকে সঠিকটির ব্যাপারে জানাতে হবে। তারা সঠিক পথে ফিরে আসলে জামাতে তাদের সাদরে বরণ করা হবে। যদি তারা ভুলের ওপরই অটল থাকে, তা হলে তাদের বর্জন করা ছাড়া আর কোনো পথ নেই। এ ধরনের মতপার্থক্যের উদাহরণ হলো মিউজিকের বৈধতা, মু'তা বিবাহের বৈধতা, আল্লাহর নাম ও গুণাবলির ক্ষেত্রে অপব্যাখ্যা করা ইত্যাদি। এমনটা বলা যাবে না যে, অতীতে কিছু আলিম এরকম মত দিয়েছেন বলে সেগুলো বৈধ হয়ে গেছে অথবা ইজতিহাদের দরজা বন্ধ করা যাবে না। বরং, যে-সকল আলিম ইজতিহাদ করে এসকল মতে পোঁছেছিলেন, তাঁরা ভুল করেছিলেন। এসব বিষয়ে সঠিক মত এখন উলামা, তুল্লাব ও আওয়াম সবার কাছেই পরিষ্কার। কোনো আলিমের মত ভুল হিসেবে প্রমাণিত হওয়ার পর তার অনুসরণ করা ঠিক নয়। আজকেও যে এসব ভুল মতের অনুসরণ করবে, তাকে সঠিক মত জানাতে হবে। আর সে ভুল মতে অটল থাকলে তাকে জামাতে গ্রহণ করা হবে না।

এখন উল্লেখিত শর্ত তিনটির ব্যাপারে আলোচনা করা যাক। লক্ষ্যের ঐক্য, আকীদার ঐক্য, আল্লাহ তাআলার দ্বীনের বুঝের ঐক্য।

যাদের উদ্দেশ্য আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ছাড়া অন্য কিছু, তাদের জামাতে গ্রহণ করা যাবে না। যারা গায়রুল্লাহর সন্তুষ্টি চায়, পার্থিব অর্জন লাভ করতে চায়, নিজেদের খেয়াল-খুশি পূরণ করতে চায়, তাদের আমরা প্রত্যাখ্যান করি।

নবীজি যখন বনু আমর বিন সা'সা' গোত্রকে ইসলামের দিকে আহ্বান করলেন, তারা একটি শর্ত দিতে চাইল। তা হলো নবীজির মৃত্যুর পর আরবের রাজত্ব তাদের হাতে দিতে হবে। নবীজি গুঁটি তাদের শর্ত প্রত্যাখ্যান করে তাদের ফিরিয়ে দেন। আল্লাহর সন্তুষ্টির বদলে পার্থিব লাভ অন্বেষণকারীদের তিনি গ্রহণ করেননি।

আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জনকে চূড়ান্ত উদ্দেশ্য বানায় না, এমন প্রত্যেককে বর্জন করা আমাদের দায়িত্ব। আমরা সকল জাতীয়তাবাদী ও সেক্যুলারিস্টদের প্রত্যাখ্যান করি। বরং আমরা তাদের সাথে শত্রুতা ও ঘৃণা পোষণ করি। আমরা তাদেরও প্রত্যাখ্যান করি, যারা শুধু পার্থিব জ্ঞান হাসিলেই ব্যস্ত থাকে, অথবা নিজেদের প্রবৃত্তিকে ইলাহ হিসেবে গ্রহণ করে, অথবা প্রকাশ্যে কবীরা গুনাহ করতেই থাকে। আর কেউ যদি সগীরা গুনাহ বা পাপাচারে লিপ্ত থাকে, তা হলে সেই গুনাহের ধরন অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে যে তাকে গ্রহণ করা কি জামাতের জন্য কল্যাণকর নাকি অকল্যাণকর। আকীদার মৌলিক বিষয়গুলোতে দ্বিমতকারীদেরকেও জামাতে অন্তর্ভুক্ত করা হবে না। কোনো পরিস্থিতিতেই কুফফার ও বিদআতিদের আমাদের জামাতে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না।

নবীজি বিদআতি গোষ্ঠী খাওয়ারিজদের সাথে যুদ্ধ করার আদেশ করেছেন। অথচ তারা সালাত আদায় করে, সাওম পালন করে, কুরআন তিলাওয়াত করে। সাহাবাগণ খাওয়ারিজদের সাথে যুদ্ধ করেছেন, তাদের হত্যা করেছেন, আর তা করে সন্তুষ্ট থেকেছেন। যারা তাদের সাথে লড়াই করতে অস্বীকৃতি জানায়, আব্দুল্লাহ ইবনু উমর (রাদিয়াল্লাহু আনহুমা) তাদের সাথে দূরত্ব বজায় রেখেছেন। এটি চিরন্তন বিষয়। আকীদার সকল বিষয়ে যারা সালফে সালিহীনের অনুসরণ করে না, সেসব বিদআতিদের বর্জন করা আমাদের কর্তব্য। খাওয়ারিজ, শিয়া, সুফি, মুরজিয়াহ, মুশাব্বিহা, মুআত্তিলাহ, মুতাওয়াকিফাহ (যারা মুখে ইসলামের ঘোষণাদানকারীদের সত্যিকার মুমিন বা কাফির বলে ঘোষণা করতে অস্বীকৃতি জানায়) এদের কাউকে আমরা গ্রহণ করব না। তাদেরও প্রত্যাখ্যান করা হবে, যাদের দ্বীনের বুঝ বিকৃত। আকীদার ক্ষেত্রে সালফে সালেহীনদের

সাথে দ্বিমতকারী ও দ্বীনের মধ্যে নতুন বিষয় উদ্ভাবনকারীদের সাথে আমরা হাত মেলাব না। আমাদের লক্ষ্য, আমাদের বুঝ, আমাদের ওয়ালা' ও বারাআ' এর ক্ষেত্রে দ্বিমতকারীদের আমরা প্রত্যাখ্যান করি। যারা ইসলাম বহির্ভূত কোনো পন্থায় কাজ করতে চায়, যেমন রাজনৈতিক দলের হয়ে কাজ করা, তাদেরও আমরা প্রত্যাখ্যান করি।

কৃপণতা ও ভীরুতার কারণে যাকাত দিতে ও জিহাদ করতে অস্বীকার করা এক ব্যক্তির বায়আত গ্রহণ করেননি রাসূলুল্লাহ এ। তিনি বলে দেন, "যাকাতও না, জিহাদও না! তা হলে তুমি জান্নাতে যাবে কী দিয়ে? " যাকাত, জিহাদ, হিসবাহ, দাওয়াত ইত্যাদির প্রতি যারা বিমুখ হয়, তাদের প্রত্যাখ্যান করা আমাদের কর্তব্য ও অধিকার। এজন্য কেউ আমাদের তিরস্কার করার অধিকার রাখে না। এখানে সাকীফ গোত্রের উদাহরণ টানা যাবে না, যারা যাকাত না দেওয়া ও জিহাদ না করার শর্তে ইসলাম কবুল করেছিল। নবীজি তাদের বায়আত গ্রহণ করলেও বলেছিলেন, "তারা (একসময়) যাকাত দেবে ও জিহাদ করবে।" আল্লাহ তাআলা তাঁকে ওহির মাধ্যমে বিষয়টি জানিয়ে দেন। তাই তিনি তাদের বায়'আত গ্রহণ করেন।

আকীদা, চূড়ান্ত উদ্দেশ্য, দ্বীনের বুঝ, লক্ষ্য, পথ, পাথেয়, শত্রুতা, মিত্রতার ব্যাপারে দ্বিমতকারীদের সাথে কোনো ঐক্য নেই। এতে বুদ্ধিবৃত্তিক অনৈক্য সৃষ্টি হয়। সঠিক শর্ত বাদ দিয়ে এ ধরনের ঐক্য গড়লে কেবল বিচ্ছিন্নতা ও ক্ষতিই বাড়বে। তৈরি হবে স্থবিরতা, বন্ধ হবে কাজের ময়দানের অগ্রগতি।

আমাদের দুর্গগুলো ভেতর থেকে ক্ষয়ে যাচ্ছে, কারণ আমরা ভ্রান্ত বিশ্বাস ও আদর্শধারীদের এখানে ঢুকতে দিয়েছি। ফলে আমাদের কাঠামোটাই হুমকির মুখে পড়ে গেছে। আমাদের দূর্গগুলো ভিড়ের চাপে হেলে পড়ছে। শত্রু আক্রমণ প্রতিরোধই করতে পারছে না, পাল্টা আক্রমণ করবে কীভাবে? মুসলিমদের প্রতি আমাদের পরামর্শ হলো ভাঙন সৃষ্টিকারী এসব আবর্জনা দ্রুত পরিষ্কার করুন। তারা যদি এ পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করে, তা হলে উত্তম। যদি তা অগ্রাহ্য করে, তা হলে আমরা তো বার্তা পৌঁছানোর দায়িত্ব পালন করেছিই।

হক ও হকপন্থীদের ছাড়া আর কারো সাথে হাত না মেলানো শিখতে হবে।

واعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا

"আর তোমরা সকলে মিলে দৃড়ভাবে আল্লাহর রজ্জু ধরে থাকো। আর নিজেদের মধ্যে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেয়ো না।"

এই আয়াতের ব্যাখ্যায় কুরতুবী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, "আল্লাহ তাআলা মুসলিমদের ওপর বাধ্যতামূলক করেছেন যে তারা তাঁর কিতাব দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে থাকবে এবং নিজেদের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দিলে এরই শরণাপন্ন হবে। তিনি আরো আদেশ দিয়েছেন বিশ্বাস ও কাজে কুরআন ও সুন্নাহ আঁকড়ে থাকার জন্য। এর ফলে ঐক্য বজায় থাকবে, অনৈক্য দূর হবে, দ্বীন ও দুনিয়ায় লাভবান হওয়া যাবে।”

আল্লাহ আমাদের আলিমগণকে রহম করুন। তাঁরা কতই-না জ্ঞানী ছিলেন! যারা ঐক্য চায়, অনৈক্য দূর করতে চায়, দ্বীন ও দুনিয়ার কল্যাণ চায়, তাদের অবশ্যই বিশ্বাস ও কাজকর্মে কুরআন-সুন্নাহর অনুগামী হতে হবে।

উল্লেখ্য, যেসব ফিরকার সাথে ঐক্য করা হারাম, তাদের থেকে দ্বীনি ও দুনিয়াবি প্রয়োজনে সাহায্য-সহযোগিতা নেওয়া নিষিদ্ধ নয়। ঐক্য গড়া আর সহযোগিতা চাওয়ার মাঝে ব্যাপক পার্থক্য বিদ্যমান। ফুকাহায়ে কিরাম কিছু শর্তসাপেক্ষে ইসলামের জন্য যুদ্ধ করা বাহিনীতে কাফিরদের নিয়োগ করাও বৈধ করেছেন। কেউ কেউ খাওয়ারিজদের সাথে মিলে কাফিরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা জায়েয বলেছেন। কিন্তু কাফিরদেরকে আমরা আমাদের দলে নেব না, খাওয়ারিজদেরকে আমাদের মাঝে রাখব না। অতএব, ঐক্য করা ও সহযোগিতা চাওয়ার মাঝে পার্থক্য স্পষ্ট।